রাজস্থানে আনন্দ ভ্রমণ : পর্ব ০৬
অরূপ কুমার ভট্টাচার্য
৭ অক্টোবর সকালে হোটেল আকাশদীপের রেস্টুরেন্টে গরম গরম জলখাবার খেয়ে চললাম জয়সালমির ফোর্টের উদ্দেশ্যে। আমাদের গাইড সাদ্দাম বেশ তরতাজা যুবক। হিন্দি, ইংরেজি দুটো ভাষায়ই তুখোড়। মুকেশ ভাটিয়া সকালে সাদ্দামকে ডেকে আমাদের জয়সালমির ফোর্ট ও হাভেলিগুলো ভালো করে দেখিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। দক্ষিণা ৩০০ টাকা।
সোনার কেল্লা (জয়সালমির ফোর্ট): পাকিস্তান সীমান্তছোঁয়া এ মরুশহরের নামকরণ হয়েছে রাজপুত ভাট্টিগোষ্ঠীর শাসক রাজা রাওয়াল জয়সয়ালের নামে। প্রায় ৯০০ বছর আগে রাজা জয়সয়াল লোদুর্ভা থেকে রাজ্যপাট গুটিয়ে এনে এখানে রাজত্ব স্থাপন করেন। তার আগে থেকেই আরব, মিশর, পারস্য, ইউরোপের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য পথের নিয়ন্ত্রক ছিল এ স্থান। ১১৫৬ সালে জয়সয়াল ত্রিকূট পাহাড়ের ওপর নির্মাণ করেন এ দুর্গ। তখন এর নাম ছিল ত্রিকূটগড়। বহু যুদ্ধের সাক্ষী এ দুর্গ। রাজস্থানে চিতোরের পর এটিই সবচেয়ে পুরোনো দুর্গ।
ভারতে এটিই একমাত্র দুর্গ; যেখানে অতীত রাজ-রাজড়া, আমির-ওমরাহ, অভিজাত বণিকদের বংশধরেরা এখনো বসবাস করেন। সারা জয়সালমির শহরের প্রায় অর্ধেকের বাস এ দুর্গের ভেতরে। দোকান, বাজার, পোস্ট অফিস, হাসপাতাল, থানা, হিন্দু মন্দির, জৈন মন্দির, মসজিদ সবই আছে এর ভেতরে। নতুন দু’একটা পোড়া মাটির ইটের তৈরি বাড়ি ছাড়া, সবই তৈরি হলুদ পাথর দিয়ে। তাই এ শহরের আরেক নাম ইয়েলো সিটি। সীমান্তবর্তী হওয়ায় সামরিক দিক থেকেও এ স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজস্থানি নৃত্যকলা ও সংগীতের জন্যও বিখ্যাত জয়সালমির। এখানে গ্রীষ্মে যেমন প্রচণ্ড গরম, শীতে তেমন কনকনে ঠান্ডা। তবে দিনের বেলা ঠান্ডা কমই থাকে, বাড়ে রাতে। পর্যটনই এ শহরের মূল আয়ের উৎস।
গাইড সাদ্দামের দেখানো পথ ধরে এবার চললাম সোনার কেল্লা দেখতে। বাইরে থেকে কেল্লা দেখে মনটা বেশ চনমনিয়ে উঠল। ঢালু পাথর বাঁধানো পথ বেয়ে উঠে বিশাল বড় ফটক পেরিয়ে প্রবেশ করলাম দুর্গের ভেতর। ঢুকে কিন্তু সিনেমায় দেখা গা ছমছমে সোনার কেল্লার সঙ্গে ঠিক যেন মেলাতে পারলাম না। লোকের ভিড়, মোটরসাইকেলের দাপাদাপি, হাজারও দোকান, পসরা সাজিয়ে দোকানদার হাঁকাহাঁকি করছে। হই-হট্টগোলের পরিবেশ। নেই কোনো ময়ূর। যা দেখে ভয়ে আতঙ্কিত হয়েছিলেন ড. হাজরা (ভবানন্দ)। আরও একটু এগিয়ে গেলাম, দেখি এদিক-ওদিক চলে গেছে সরু রাস্তা দুর্গের অভ্যন্তরে। সেই রাস্তায় পৌঁছেই পেলাম রাজস্থানি দুর্গের আসল স্বাদ।
কেল্লার ভেতরে মেঘদরবার, রংমহল, দেওয়ান-ই-আম, রানি দরবার দর্শনীয়। এখানকার ছাদের ওপর থেকে জয়সালমিরের অনুপম সৌন্দর্য দেখার অভিজ্ঞতাও দুর্লভ। এ ছাদে দাঁড়িয়ে দৃশ্যপট ক্যামেরাবন্দি করে আমরা এগিয়ে চললাম একেকটি কক্ষ দর্শনে। কেল্লায় দেখলাম প্রাচীনত্বের কারণে ঐশ্বর্যের জৌলুস জয়পুরের কেল্লাগুলো থেকে অনেকটাই কম, গঠন কৌশলও বেশ প্রাচীন। আমাদের টিমের সবচেয়ে ছোট সদস্য বাবুয়া (৩ বছর) কেল্লার আঁকাবাঁকা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে তার বাবাকে বলছে, ‘বাবা, রাজাদের মাথা খারাপ ছিল। তাই এরকম বাড়ি করেছে।’ গাইড সাদ্দাম কথাটি বুঝতে পেরে একটু হেসে আমাদের বলল, ‘কেল্লায় বারবার বহিঃশত্রু আক্রমণ করত, তাই এরকম গুপ্ত পথ।’ তবে আশ্চর্য বিষয়, কেল্লার ভেতরে একেকটি জায়গায় এত আরামদায়ক শীতল বাতাস তা সত্যিই অভূতপূর্ব।
এ দুর্গের আরও দুটি আকর্ষণ আছে। একটি হলো ‘জৈসলু কুয়া’, অপরটি ‘গজমহল’। যদিও দুর্গের ইতিহাস নবীন কিন্তু এই কুয়ার ইতিহাস মহাভারতের সময়ের। কথিত আছে, জৈসলু কুয়া ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার সুদর্শন চক্র দিয়ে অর্জুনের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য খনন করিয়ে ছিলেন। পরবর্তীকালে জয়সলের নামে এ কুয়ার নাম হয় জৈসলু।
১৮৮৪ সালে গজমহলের নির্মাণ করিয়েছিলেন মহারাওয়ল গজসিংহ। এ মন্দিরের ফুল, লতা, পাতা প্রভৃতির কারুকাজের তুলনা নেই। তেমনি অতুলনীয় মহারাওয়ল মূলরাজ দ্বিতীয় দ্বারা নির্মিত রংমহল ও মোতিমহল। রংমহলে মুঘল ও রাজপুত শৈলীর চিত্রকলার অপূর্ব সংগ্ৰহ আছে। মোতিমহলেও ওই রকম দুর্লভ কিছু প্রাচীন চিত্র আছে।
প্রায় ঘণ্টা দুই সময় নিয়ে আমরা ফোর্ট দর্শন করে বেরিয়ে আসব। হঠাৎ ছেলে বলল, ‘বাবা মুকুলের বাড়ি, সেটা দেখবে না?’ আমার তখন সম্বিত ফিরল। এতক্ষণ রাজ ঐতিহ্য দেখতে দেখতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম। আমি সঙ্গে সঙ্গে গাইড সাদ্দামকে বললাম, ‘ভাই মুকুলের বাড়ি দেখাবে না?’ এক গাল হেসে সাদ্দাম বলল, ‘জরুর।’ কেল্লার পেছন দিকে একটু গিয়েই দেখতে পেলাম সেই বাড়ি। সত্যজিৎ রায়ের সোনার কেল্লা সিনেমার মুকুলের বাড়ি। ইতিহাস আর বর্তমান মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে এখানে।
হাভেলি: এরপর দুর্গ থেকে বেরিয়ে গলিপথের মধ্যে হেঁটে চললাম সেলিম সিং কি হাভেলি দেখার উদ্দেশ্যে। সোনার কেল্লা থেকে প্রায় ১০ মিনিট হাঁটা পথে গিয়ে হাজির হলাম হাভেলির সামনে। টিমের নারী বাহিনী বেশ বিরক্ত এতটা পথ তাদের হাঁটাবার জন্য। গাইডের কাছে শুনলাম এ হাভেলি একজন নায়েবের। যা কিনা এ অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন বাড়ি। হলুদ বর্ণের এ বিশাল বিশাল হাভেলি কত ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে। রাজস্থানি জাফরির গঠনশৈলী এ হাভেলিগুলোতে বড়ই আকর্ষণীয়।
সেলিম সিং কি হাভেলি দেখে আবার হাঁটা পথে চললাম গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায়। কিন্তু আবার সেই গাড়ির বিভ্রাট। এতটা পথ হেঁটে এসে দেখি গাড়ি দাঁড়িয়ে নেই। ড্রাইভারকে ফোন করতে বলল, ‘ফোর্টের পার্কিংয়ে আছি। ৫ মিনিটে আসছি।’ পাঁচ মিনিট পনেরো মিনিট হয়ে গেল গাড়ি আর আসে না। এদিকে রোদের তাপ বাড়ছে। আমারও মাথা গরম হতে শুরু করেছে। প্রায় ৩০ মিনিট পর দেখি গাড়ি এলো কিন্তু এ কী দৃশ্য! আমাদের বুক করা গাড়ি থেকে অন্য লোক নামছে। আর মাথা ঠিক রাখতে পারলাম না। যা মুখে এলো গাড়ির ড্রাইভারকে তা বললাম। শেষ পর্যন্ত আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম, ‘দরকার হলে আমি লোকাল পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাব।’ আমার উগ্রমূর্তি দেখে ড্রাইভার বেশ ভয় পেয়ে গেছে বুঝতে পারলাম। কোন কথা না বলে আমাদের পৌঁছে দিলো পাটোয়া কি হাভেলির পার্কিংয়ে। এখান থেকে অটো করে পাটোয়া কি হাভেলির সামনে হাজির হলাম।
পাটোয়া কি হাভেলি ও নাথমল জি কি হাভেলি: জয়সালমিরের দুই বণিক ভাইয়ের হাভেলি এ দুটো। যারা ব্যবসা করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিল। প্রয়োজন হলে তারা রাজাদেরও অর্থ ধার দিতেন। বর্তমানে সরকার অধিকৃত এ হাভেলির ভেতর মিউজিয়াম গড়ে উঠেছে। আমরা চারিদিকে ঘুরে ঘুরে এর গঠনশৈলী উপভোগ করলাম। ছবি তুললাম বেশ রাজপুত মহারাজের মতো।
হাভেলি দেখে অটো করে গাড়ি পার্কিংয়ে এসে দেখি যে ট্রাভেলসের গাড়ি বুক করেছিলাম, তার মালিক মি. রাঠোর একটি অন্য ট্যাম্পু ট্রাভেলা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। করজোরে গাড়ি বিভ্রাটের জন্য ক্ষমা চেয়ে এ নতুন গাড়ির বন্দোবস্ত করে দিয়ে বললেন, ‘স্যার, এ গাড়িই আপনার সঙ্গে যোধপুর পর্যন্ত থাকবে। আর সমস্যা হবে না।’ আমি আর কথা না বাড়িয়ে হোটেল আকাশদীপের পথে চললাম।
হোটেলে ফিরে দুপুরে গরম গরম বাঙালি খানা ভাত, ডাল, আলুপোস্ত, বাঁধাকপির তরকারি আর ডিমের ঝোল সহযোগে মধ্যাহ্ন ভোজ সম্পন্ন করে একটু বিছানায় গড়িয়ে নিলাম। নতুন ড্রাইভার সুরজ সিংকে বললাম, ‘তিনটার আগে হোটেল থেকে বেরোচ্ছি না।’
চলবে...
লেখক: সহকারী শিক্ষক, বিবেকানন্দ মিশন আশ্রম শিক্ষায়তন, হলদিয়া, কলকাতা।
এসইউ/এমএস