রাত যত গভীর হয় পাতায়ার ওয়াকিং স্ট্রিট তত সরব হয়
‘ভাই, আপনার লোকেশন শেয়ার করেন।’ গণনার ভুলে সুবর্ণভূমি বিমানবন্দর থেকে দলছুট হয়ে আমি ভিন্ন বাসে একা ফিরছি। এ কারণে ২০ মিনিট আগে ছেড়ে যাওয়া বাসে থাকা অন্য ১২ ক্র্যাব সদস্যরা আমাকে নিয়ে চিন্তিত। তাই তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে ‘ক্র্যাব থাইল্যান্ড ট্যুর’ নামে ফেসবুক গ্রুপটি এভাবে নক করে ভিডিও ও অডিও কলের মাধ্যমে বলতে গেলে সারাক্ষণই সঙ্গ দিল। শুধু তাই না, বাস পাতায়ায় পৌঁছানোর পর ৭১ টেলিভিশনের পারভেজ রেজা, যমুনা টিভির তুহিন আবদুল্লাহ ও রেডিওর সিনিয়র সাংবাদিক শরীফ ভাই অন্যদের হোটেলে পাঠিয়ে আমার জন্য স্টেশনে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
বাস ছাড়ার সময় বাস কন্ডাকটর ৬টায় পাতায়ার শেষ স্টেশনে পৌঁছার ঘোষষা দিয়েছিলেন। বাস পৌঁছানোর পর ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি জাস্ট ৬টাই বাজে। এদিকে ট্যুরের মূল আয়োজক যিনি আগের দিনই পৌঁছেছিলেন সেই শাহিন সারাক্ষণ কোথায় নামতে হবে, এরপর রাস্তার বিপরীত দিক থেকে টুকটুক (হিউম্যান হলার) চড়ে হোটেলে কীভাবে পৌঁছাতে হবে, সে ব্যাপারে দিক-নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি তখনও জানেন না আমি দলছুট হয়ে গেছি। তা যা-ই হোক, বাসস্টেশন থেকে চারজন টুকটুকিতে চড়ে হোটেলে পৌঁছালাম।
সেই ভোররাতে ওঠার পর থেকে পাতায়া পর্যন্ত টানা জার্নিতে শরীর ভীষণ ক্লান্ত থাকায় দ্রুত চাবি নিয়ে হোটেল রুমে পৌঁছে প্রথমেই গোসল করে ফ্রেস হয়ে বিশ্রাম নিলাম।
এরই মধ্যে অনেকেই পর্যটন শহর পাতায়ার নানা সৌন্দর্যের সন্ধানে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়েছে। আগেই বলা হয়েছিল গ্রুপ বেঁধে বের হলে নানা কারণে দেরি হবে। একজন আসবে তো আরেকজন রেডি হবে না। এ নিয়ে মনোমালিন্য হবে। সে কারণে পাতায়ায় পৌঁছার পর দু-একজন করে নিজেদের মতো করে ঘুরতে বের হলো।
হোটেলে বিশ্রাম নিয়ে আমি ও আমার রুমমেট শাহিন বের হলাম। আজ থেকে ১৬ বছর আগে বিয়ের পর হানিমুনে পাতায়ায় এসেছিলাম। হোটেল থেকে পায়ে হাঁটা মিনিট পাচেক হেঁটে পাতায়া বিচে গিয়ে হতাশই হলাম। বিচের আশপাশের ফুটপাতের রাস্তা ভাঙাচোরাই দেখলাম। শাহিন জানাল, সংস্কার কাজ চলায় বেহাল এ দশা।
পাতায়া পর্যটন শহর। এ শহরে একজন পর্যটককে পরিপূর্ণ দিতে ছোটবড় শপিংমল, হরেক রকম খাবার রেস্টুরেন্ট, নাইট ক্লাব, ড্যান্স বার, জাহাজ ভ্রমণসহ সব আয়োজন রয়েছে। এ শহরে পতিতাবৃত্তি বৈধ পেশা। তবে পর্যটকদের তারা সম্মান করে। জোর-জবরদস্তি বা টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়ার ধান্দা করে না। এখানে সারারাত পর্যটকের পদচারণা মুখরিত থাকে। হাই ভলিউমে গান বাজতে থাকে।
ওয়াকিং স্ট্রিটের দুই পাশে মদের বার, রেস্টুরেন্ট, ডিসকো বারসহ নানা আয়োজন। মদ ও সেক্স এখানে ডালভাত তবে কেউ জবরদস্তি করে না। একান্তই পর্যটকের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে তিনি কী করবেন। পাতায়া ওয়াকিং স্ট্রিটে প্রতি রাতে কত হাজার লাখ ডলার ব্যয় হয় তার কোনো হিসাব নেই। কৌতূহলবশত একটি ডিসকো বারে ঢুঁ মারতে প্রবেশপথে হাতে সিল মেরে দেয়া হলো। ভেতরে আধো আলো-েঅন্ধকারে হাই ভলিউমে গান বাজছে। ছেলেমেয়েরা গানের তালে উদ্দাম নাচ নাচছে আর মেয়েরা পর্যটকদের পাশে বসে বিয়ারসহ বিভিন্ন হার্ড ড্রিঙ্কস সার্ভ করছে। কেউবা শিশা সেবনে ব্যস্ত। রাস্তায় হেঁটে কখন যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে যায় তা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না।
ওয়াকিং স্ট্রিটে টার্কিশ আইসক্রিম বিক্রেতাদের আইসক্রিম বিক্রির সময় প্রদর্শিত কলাকৌশল ও কসরত সব বয়সী মানুষকে খুবই আনন্দ দেয়। এছাড়া এখানকার সামুদ্রিক অর্থাৎ সি ফুডের প্রতিও পর্যটকদের বিশেষ আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। অ্যাকুরিয়ামে রাখা কাঁকড়া, চিংড়ি ও অন্যান্য তাজা সামদ্রিক মাছ খেতে চাইলে কেজি দরে কিনে অর্ডার করলে গরম গরম রান্না করা খাবার হাজির হবে।
এখানে অনেক বিদেশিকে অতিরিক্ত মদ্যপানে বেসামাল হয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। পাতায়াতে ফুট ম্যাসাজ খুব জনপ্রিয়। রাস্তার পাশে সুন্দর সাজানো গোছানো বিশাল দোকানে হেঁটে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত পর্যটকরা ফুট ম্যাসাজ করান। সর্বনিম্ন ৫০-১০০ বাথ (থাই মুদ্রা) থেকে মিনিট ঘণ্টার হিসাবে ফুট ম্যাসাজ চলে। রাস্তায় মেয়েরা দলবেঁধে দাঁড়িয়ে বা বসে থেকে লম্বা সুরে ‘ম্যাসাজ’ বলে পর্যটকদের ডাকে তবে কাউকে জোর করে না।
ওয়াকিং স্ট্রিটের শেষ মাথায় ফেরি ঘাট। যেখান থেকে দিনের বেলায় কুরাল আইল্যান্ডসহ বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে জাহাজ ও স্পিডবোট ছেড়ে যায়। পর্যটকদের বিনোদনের জন্য নানা প্যাকেজ। ফেরি ঘাটে রাতের বেলায় সুনসান নীরবতা বিরাজ করে। সেখানে তৃতীয় লিঙ্গের একজনকে করুণ সুরে ভায়োলিন বাজাতে দেখা যায়। পর্যটকরা তার গান শুনে সাহায্য করে।
এখানে দরিদ্র ফুল বিক্রেতারা ফুল হাতে রাস্তা ও মদের বারের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। অনেকেই নানাভাবে সারারাত আনন্দ স্ফূর্তি করে ফেরার পথে ফুল কিনে তাদের আর্থিক সাহায্য দিয়ে যেতে দেখা যায়। রাতের শেষে ওয়াকিং স্ট্রিটে হাই ভলিউমের বাজনার শব্দ কমে আসতে থাকে। দিনের শুরুতে পর্যটকরা ঘুমাতে যায়।
চলবে…
এমইউ/এসআর/পিআর