সীতাকুণ্ডের ইকোপার্ক ও চন্দ্রনাথ পাহাড় ভ্রমণ
আজহার মাহমুদ
যারা প্রকৃতি পছন্দ করেন, তারা সবসময় প্রকৃতির পেছনেই পড়ে থাকেন। আমারও তেমন ইচ্ছে করে। তবে কাজ আর সময়ের জন্য সবসময় সেটা পারি না। তবে যখনই সময় পাই; তখনই সেটা কাজে লাগাই। ঈদের লম্বা ছুটিতে চারদিকে বেড়াচ্ছি; তবুও মনে হচ্ছে যেন আনন্দ নেই। দূরে কোথাও যাবো। পাহাড়, ঝরনা আর প্রকৃতির সাথে মিশে যাবো।
বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ হলো। মাত্র তিন বন্ধু রাজি হলো। যাবো সীতাকুণ্ড। সীতাকুণ্ডে যাওয়ার মতো দুটি স্থান রয়েছে। একটি ইকোপার্ক, আরেকটি চন্দ্রনাথ মন্দির। ইকোপার্কে রয়েছে সহস্রধারা এবং সুপ্তধারা নামে দুটি ঝরনা। আর চন্দ্রনাথ মন্দির দেখতে হলে প্রায় ১২০০ ফুট উপরে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ায় যেতে হবে।
ঠিক করলাম, প্রথমে ইকোপার্কে যাবো। কারণ ঝরনায় মন হারাতে আমার বেশ লাগে। ভোর ৭টায় চট্টগ্রামের এ কে খান থেকে বাসে উঠলাম। যেতে যেতে আধা ঘণ্টা লাগলো। ৩০ টাকা দিয়ে ইকোপার্কের গেটের সামনে বাস থেকে নামলাম। বাস থেকে নেমেই একটি রেস্টুরেন্ট নাস্তা করলাম। তারপর ইকোপার্কে প্রবেশ করলাম।
প্রথমেই আমাদের যেতে হবে সুপ্তধারা ঝরনায়। ঝরনায় যেতে একটু কষ্ট করতে হয়, সেটি হলো গিরিপথে প্রায় দশ মিনিট হাঁটতে হয়। ঝরনাটা গভীর নির্জনে, তাই একা যাওয়া একটু ঝুঁকিপূর্ণ। তবে ৪-৫ জন গেলে কোন সমস্যা নেই। যদি কখনো এক-দুই জন যান, তাহলে ছিনতাইয়ের আশঙ্কা থাকে। তাই অন্য কোন দলের সাথে মিলেমিশে যাওয়াই উত্তম।
আমরাও কয়েকটি দল মিলেমিশে গিয়েছিলাম। কঠিন পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একসময় সুপ্তধারা ঝরনাটা দেখতে পাই। স্থানীয়রা একে ছোট ঝরনা বলে। কিন্তু এত বড় একটি ঝরনাকে কেন ছোট ঝরনা বলে তা অবশ্য এখনো আমার অজানা থেকে গেছে। অনেকবার সেটা জানতে চেয়েও পারিনি। বের করতে পারিনি মূল রহস্য।
যা হোক, ঝরনাটা দেখেই মন প্রশান্তিতে ভরে গেলো। একসাথে তিনটি ঝরনা এর আগে কোথাও দেখিনি। আর ঝরনার দৃশ্যটা আমায় এখনো মুগ্ধ করে। এমন সুন্দর ঝরনা আমি আগে কখনো দেখিনি।
ঝরনার ডান সাইডের পাহাড় বেয়ে বেয়ে উঠে গেলাম ঝরনার একদম উপরে। উপরের অংশটা আসলেই অসাধারণ। তিন দিক থেকে ছোট তিনটি ঝরনার পানি বেয়ে পড়ছে। সেই পানি আবার নিচে বড় ঝরনা হয়ে বেয়ে বেয়ে পড়ছে। সত্যিই অসাধারণ। সময়ের স্বল্পতার কারণে দ্রুত ঝরনার পানিতে গোসল সেরে কিছু স্মৃতিমাখা ছবি নিয়ে আরেকটি ঝরনা সহস্রধারার উদ্দেশে রওনা দিলাম।
মাত্র একটি ধারা যার, তাকে কেন সহস্রধারা ঝরনা কেন বলে; সেটাও আমার কাছে রহস্য। স্থানীয়দের ভাষায়, এ ঝরনার নাম বড় ঝরনা। সুপ্তধারার মতো বড় ঝরনাকে কেন ছোট ঝরনা বলে আর সহস্রধারার মতো ছোট ঝরনাকে কেন বড় ঝরনা বলে, তা স্থানীয়দের সাথে কথা বলেও জানতে পারলাম না। ঝরনার সাথে নামের এই বৈপরীত্য থাকার পেছনে আসলেই কি রহস্য আছে? আমার ভেতর প্রশ্নটা আজও কাজ করে।
কঠিন পথ পেরিয়ে এ ঝরনায়ও অনেকটা সময় প্রকৃতি আর মানুষের আনন্দ দেখলাম। এরপর ইকোপার্কের ভেতরেই একটি ওয়াচ টাওয়ার আছে, সেখান থেকে মোটামুটি অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। সেখান থেকে প্রকৃতি দেখতে এতই চমৎকার যে, বলে বোঝানো অসম্ভব। এককথায় অপূর্ব।
দুটো ঝরনা দেখার পর দুপুরের খাবার খেয়ে রওনা দিলাম চন্দ্রনাথ পাহাড়ে অবস্থিত চন্দ্রনাথ মন্দির দেখার জন্য। ইকোপার্কের ভেতর দিয়ে একটি রাস্তা আছে, সেটি দিয়ে কম সময়ে মন্দিরে যাওয়া যায়। কিন্তু সেই রাস্তায় নাকি প্রায় ডাকাতি হয়। তাই কর্তৃপক্ষ সেই রাস্তা দিয়ে যেতে দেয় না। তবে বড় দল হলে কোন সমস্যা নেই।
আমরা ইকোপার্ক দিয়ে না গিয়ে ইকোপার্ক থেকে বের হয়ে গেলাম। এবার মূল রাস্তা দিয়ে চন্দ্রনাথের দিকে রওনা দিলাম। যদি কেউ না চেনেন, তবে স্থানীয়দের কাছে জিজ্ঞেস করলে দেখিয়ে দেবে।
পাহাড়ের সামনে এসে পৌঁছলাম। যখন পাহাড়ের সামনে দাঁড়ালাম; তখন চার জনের ভেতরে দুই জন বলল, এত বড় পাহাড়ে ওঠা অসম্ভব! পরে আমি আর আরেকজন তাদের নিচে রেখে পাহাড় বেয়ে ওঠা শুরু করলাম। হাফাতে হাফাতে অবশেষে চন্দ্রনাথ মন্দিরে পৌঁছলাম। সে যে কী আনন্দ। এত পরিশ্রমের পর যখন চন্দ্রনাথ মন্দির দেখতে পেলাম; তখন তো ভীষণ আনন্দ লাগবেই।
চন্দ্রনাথ মন্দির থেকে চারদিকটা সত্যি অসাধারণ। দূরে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে আর চারদিকে যেন পাহাড়ের ঢেউ খেলা করছে।
কীভাবে যাবেন: চট্টগ্রামের অলংকার মোড় বা এ কে খান থেকে সীতাকুণ্ডের লোকাল মিনিবাস রয়েছে। সেই মিনিবাস যোগে বা বড় বাসে করেও যেতে পারেন। লোকাল বাস ভাড়া নেবে ৩০-৪০ টাকা। তবে একটু আরামে যেতে চাইলে ৫০-৮০ টাকা খরচ করে ডাইরেক্ট বাসেও যেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে বাসের হেলপারকে বলে রাখতে হবে ইকোপার্কের গেটে নামিয়ে দিতে। না হলে আপনাকে সীতাকুণ্ড বাজার এলাকায় নিয়ে যাবে, অন্য এলাকায়ও নিয়ে যেতে পারে।
যদি ঢাকা থেকে যেতে চান তাহলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে যাওয়ার পথেই বন্দরনগরী চট্টগ্রামে প্রবেশের আগেই পড়বে সীতাকুণ্ড শহর। সেখানে নেমে ফকিরহাট বাসস্ট্যান্ড থেকে সিএনজি কিংবা অটোরিকশা দিয়ে ইকোপার্ক এবং চন্দ্রনাথ মন্দিরে যেতে পারবেন।
কোথায় থাকবেন: সীতাকুণ্ডে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে ভালো রেস্টুরেন্টও। তবে চাইলে সারাদিন ঘোরাঘুরি করে রাতে চলে আসতে পারেন চট্টগ্রাম শহরে। এখানে আপনি যেকোনো মানের হোটেল বা রেস্টুরেন্ট পেয়ে যাবেন। থাকা-খাওয়ার জন্য চট্টগ্রাম শহরে বিভিন্ন মান ও দামের আবাসিক হোটেল-মোটেলের সুব্যবস্থা রয়েছে।
লেখক: শিক্ষার্থী, বিবিএ-অনার্স, ওমরগনি এমইএস বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, চট্টগ্রাম।
এসইউ/জেআইএম