রাজস্থানে আনন্দ ভ্রমণ : পর্ব ০৩
অরূপ কুমার ভট্টাচার্য
জয়পুরের হোটেল রয়াল শেরাটনে বেশ জমিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে আমরা চললাম জয়পুরের অন্যতম আকর্ষণ শহর থেকে ১১ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত অম্বর ফোর্টের উদ্দেশ্যে। আরবল্লি পর্বতের ঢালে অনেক ইতিহাস ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই অম্বরফোর্ট।
অম্বর ফোর্ট: অতীতে রাজপুত রাজাদের রাজধানী ছিল অম্বর। পঞ্চদশ শতকে অম্বর দূর্গ নির্মাণ শুরু করেন রাজা মান সিংহ। এটি শেষ হয় প্রায় একশ’ বছর পর। দূর থেকে শহরটিকে দেখতে লাগে আমের মত, সে কারণে এর নাম রাখা হয় ‘আমের’। আবার অনেকের মতে দেবী অম্বার নামানুসারে নাম হয় অম্বর বা আমের। লাল হলুদ বেলে পাথর আর মার্বেল দ্বারা নির্মিত অম্বর দূর্গ যেন আস্ত এক শহর। জঙ্গল, প্রাসাদ, জলাধার কী নেই এখানে। জয়পুর থেকে অম্বর ফোর্ট যাওয়ার পথটি অপূর্ব। পাহাড়ি পথের স্বাদ অনুভব করলাম এ পথে। একটি নির্দিষ্ট জায়গায় এসে আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। এ স্থান থেকে ছোট জিপ গাড়ি অথবা হাতির পিঠে চড়ে উঠতে হয় ফোর্টের তোরণদ্বার পর্যন্ত। আমরা দুটি জিপ ভাড়া করে এগিয়ে চললাম এই পথে। সেই প্রাচীনকালের পাথুরে পথ। গাইড বলল, পুরাতন ঐতিহ্য বজায় রাখতেই এই পথের আধুনিকীকরণ হয়নি।
অম্বর ফোর্টের তোরণদ্বার দিয়ে প্রবেশ করে কিছু সিঁড়ি উঠেই অসাধারণ কারুকার্য করা দেওয়ান-ই-আম, রাজপুত রাজাদের দরবার কক্ষ। এরপর বিখ্যাত গণেশ পোল, চোখ ফেরানো যায় না, এত সুন্দর। এই গণেশ পোল পার হয়ে মূল অম্বর প্রাসাদ। আমাদের গাইড মহাশয় একে একে নিয়ে গেলেন জয় সিংহের বারো জন রানির জন্য তৈরি বারোটি মহলে। এরপর শীষ মহল, যশ মন্দির, সোহাগ মন্দির, জয় মন্দির, সুখ নিবাস প্রভৃতি। শীষ মহলের কাঁচ ও আয়নার কারুকাজ দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। এত বছর আগে এই কারুকার্য কিভাবে সম্ভব! কাঁচ ও আয়নার এক অদ্ভুত শৈল্পিক দক্ষতায় তৈরি দেওয়ান-ই-খাস। সিংহ দরজার পাশে পাথরের নকশা ও জাফরি কাজ করা। দরজায় রুপার কারুকার্য করা শীতলামাতা মন্দির। দেখলাম যশোরেশ্বরী দেবীর মূর্তি। যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যকে পরাজিত করে যশোরেশ্বরী দেবীকে অম্বর নিয়ে আসেন রাজা মান সিংহ। অম্বর ফোর্টের উপর থেকে দেখা যাচ্ছে অসাধারণ সুন্দর মাওথা লেক। লেকের বাগানটিও বেশ সাজানো গোছানো।
রাজপুত স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন এই অম্বর প্রাসাদ। এই প্রাসাদের মধ্যে দেওয়ানী আম অর্থাৎ প্রজাদের সঙ্গে মহারাজের মিটিং হল। তিন দিক খোলা, ধূসর বর্ণের ছাদ দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি মর্মরের ৪০ স্তম্ভের উপর। স্তম্ভের শিরে হাতির সূক্ষ্ম কারুকার্য সুন্দর।
চকের দক্ষিণে ১৬৩৯ সালে জয় সিংয়ের তৈরি গণেশ পোল। এটিও মোজাইক অলঙ্করণ ও সুন্দর চিত্রে শোভিত। মনোহর বাগিচার চারপাশে গড়ে উঠেছে একেকটি মহল। এই প্রাসাদের মিউজিয়ামে হাতির দাঁতের কাজ, পাথরের কাজ, ও অভিনব চিত্রশৈলী সত্যিই অতুলনীয়।
কয়েক ঘণ্টার পরিদর্শনে এই প্রাসাদ দেখে শেষ করা অসম্ভব। কিন্তু কিছু করার নেই, সময়ের দাসত্বে আমরা বদ্ধ। তাই প্রায় ঘণ্টা দুই অম্বর ফোর্ট পরিদর্শন করে মনের বিরুদ্ধেই চললাম জয়পুরের সিটি প্যালেসের দিকে। আমি সারথি নরেন্দ্রকে বললাম, এখন বরং জল মহলের কাছে গিয়ে বসি। কাল দেখব বাকিগুলো। কিন্তু সারথি বলল, এখন যা রোদের তাপ। তাতে জল মহলের কাছে বসতে ভালো লাগবে না। আমি আপনাদের আগামীকাল সকালে আনব। সেই মতো আমরাও চললাম সিটি প্যালেসের দিকে। কিন্তু আমাদের মহিলা মহল কেনাকাটায় বেশ পটু। সিটি প্যালেসের কাছে নানা দোকান দেখে তারা আর নিজেদের সামলাতে পারল না। কেনাকাটার জন্য দোকানে ঢুকে পড়ল। ঘড়ির কাঁটা তো কারুর জন্য থেমে থাকবে না। ওদিকে বিকেল ৫টা বাজতেই সিটি প্যালেসের টিকিট কাউন্টার বন্ধ হয়ে গেল। কী করা যায়! আমি তখন সারথি নরেন্দ্রকে বললাম, এখন তো রোদের আর তেজ নেই। আমাদের জল মহলের কাছে নিয়ে চলো। সারথি মানুষটি বেশ ভালো। সে আবার আমাদের নিয়ে চলল জল মহলের পথে।
জল মহল: তিন দিকে পাহাড় আর মাঝখানে ছয় কিলোমিটার লম্বা বিশাল নীল জলের হ্রদ, তারই মাঝে মহল। এই হ্রদের মাঝখানে ১৭৯৯ সালে জল মহলটি নির্মাণ করেন মহারাজ প্রতাপ সিং। জল মহল হলো মহারাজা প্রতাপ সিংয়ের তৈরি গ্রীষ্মাবাস। সরোবরের জলে ৫ তলা প্রাসাদ।
আরেক দিকে পর্যটকদের জন্য বিনোদনকেন্দ্র। এর প্রবেশমুখে চলত ঐতিহ্যবাহী নাচ-গানের আসর। মহল থেকে হ্রদে নামার জন্য একাধিক সিঁড়ি রয়েছে। সবুজ পাহাড়ের গায়ে হলুদ রঙের এই মহল বেশ নজর কাড়ে। এখন আর জল মহল এ পর্যটকদের যেতে দেওয়া হয় না।
আমরা যখন সরোবরের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলাম; তখনও দিনদেবের প্রভায় জল মহল তার অনবদ্য রূপে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। আমরা সরোবরের পাড়ে বসার জায়গায় আরাম করে বসে জল মহলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকলাম। আইসক্রিম আর ভুট্টা ভাজা সহযোগে আমাদের বৈকালিক আড্ডার আসর জমে গেল। রসিক বাঙালি এই আড্ডার আসর পেলে আর কী চায়। তার সাথে যদি এই রকম পরিবেশ পাওয়া যায়, তবে তো কথাই নেই। ইতোমধ্যে সূর্য পশ্চিম দিগন্তে অস্তমিত হয়েছে। জল মহলের চারিদিকে বৈদ্যুতিক আলো বাতি জ্বলে উঠেছে। সেই আলোর রোশনাইয়ে জল মহল যেন নতুন রূপে সেজে উঠছে। মনের মধ্যে উপলব্ধি করলাম, মহারাজাদের সেই আনন্দ উজ্জ্বল উপভোগ্য সন্ধ্যার জলসার আসরখানি। আর ক্যামেরাবন্দি করলাম সেই নয়নাভিরাম দৃশ্যরূপ।
চলবে...
লেখক: সহকারী শিক্ষক, বিবেকানন্দ মিশন আশ্রম শিক্ষায়তন, হলদিয়া, কলকাতা।
এসইউ/পিআর