লাউয়াছড়ার গহীন অরণ্যে একদিন
আশরাফুল আযম খান
লাউয়াছড়া বাংলাদেশের একটি জাতীয় উদ্যান। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় এর অবস্থান। সাড়ে বারোশ’ একর জমিতে ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগে এ বনের পত্তন করা হয়। বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৬ সালে এ বনকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে। এখানে রয়েছে দুর্লভ ও বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির বিচিত্র গাছ, কীট পতঙ্গ, প্রাণি ও পাখি। পৃথিবী থেকে বিলুপ্তপ্রায় এক প্রজাতির উল্লুক আর বিষধর সাপের জন্য উদ্যানটি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে একটি আকর্ষণীয় স্থান।
বনের রূপবৈচিত্র দেখলে এটিকে ন্যাচারাল বন মনে হলেও এটি আদি প্রাকৃতিক বা ভার্জিন বন নয়, কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট একটি বন। বৃটিশরা এ দেশে এসে বিশেষত সিলেট বা কাছার অঞ্চলে চা বাগানের পত্তন, রেল লাইন তৈরি এবং জাহাজ নির্মাণে প্রাকৃতিক বনের ভান্ডারকে ধ্বংস করে দেয়। পরবর্তীতে কাঠের দুষ্প্রাপ্যতা রোধ করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জায়গায় কৃত্রিম বন সৃজনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে ১৯৩৫ সালে এখানে বিভিন্ন গাছ-গাছালি রোপণ করা হয়।
পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশীয় আর বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদের বংশ বিস্তারের কারণে এটি ভার্জিন ফরেস্টের রূপ ধারণ করে। এ সময় বৃহত্তর সিলেটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে বনভূমি ধ্বংস করা হলে, সেসব বনভূমি থেকে নানা প্রজাতির পশুপাখি, কীটপতঙ্গ এ বনে এসে আশ্রয় নেয়। তাই এ বনকে কোন কোন প্রকৃতি বিশেষজ্ঞ বন্যপ্রাণির জন্য ‘বুনোজীব দ্বীপ-তুল্য’ বা ‘নুহুর নৌকা’ বলে অভিহিত করেছেন।
ঢাকার কংক্রিট জঙ্গল, রুটিন জীবনের একঘেঁয়েমি, ক্লান্তিকর ব্যস্ততাগুলো পেছনে ফেলে চার বন্ধু দু’দিনের জন্য হারিয়ে গিয়েছিলাম প্রকৃতির বিচিত্র ভান্ডার উদ্ভিদ-প্রাণির ঐশ্বর্যের রূপরাজ্য লাউয়াছড়ার এই বনে।
ন্যাশনাল পার্কে প্রবেশ করা মাত্রই আপনি দেখবেন, চারিদিকে হাল্কা অন্ধকার রাস্তায় দু’পাশের বৃক্ষগুলো দিবাকরের আলোকরশ্মিকে আটকে রেখেছে। একটু বনের ভেতরে এসে বৃক্ষসারির মগডালে চোখ রাখুন। দেখবেন, দল বেঁধে বানর আর হনুমান লাফালাফি করছে। আবেকটু ভেতরে প্রবেশ করলে আপনার চোখে পড়তে পারে খাটাস, বনমোরগ, উল্লুক, বন বিড়াল, মেছোবাঘসহ বিভিন্ন জীবজন্তু। বনের সবুজ লতা-পাতার আচ্ছাদন, বিশাল বৃক্ষরাজি, জীব-জন্তুর হুংকার, ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ, বানরের লাফালাফি, উল্লুকের ডাকাডাকি একটু সময়ের জন্য হলেও আপনাকে কোন এক রহস্যময় অজানা জগতে নিয়ে যাবে। জীবনে এনে দেবে নতুন শিহরণ এবং অভিজ্ঞতার আস্বাদন।
কোথাও কোথাও এ বনানী এত গভীর যে, সূর্যের আলো এর মাটিতে পড়ে না। সূর্যের আলোর প্রত্যাশায় এ বনের গাছগুলো যেন নিজেদের মধ্যে এক চিরন্তন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। তাই গভীর বনের গাছগুলো বেশ লম্বা। এই যুথবদ্ধ লম্বা গাছগুলো উপরে উঠে সবুজ পাতার এক ঘন চাঁদোয়া তৈরি করেছে, যা আপনাকে শীতল মধুরিমায় আচ্ছন্ন করবে। অথচ আপনার হৃদয় হয়ে উঠবে উষ্ণ।
চিরহরিৎ এ বনে আপনার জন্য প্রকৃতি বিছিয়ে রেখেছে পাতার নরম পাপোস। মাটির উপর পড়ে থাকা পাতার এ ঘন পাপোসের ওপর দিয়ে হাঁটলে এর মর্মর ধ্বনি এক অনাস্বাদিত সুরের মুর্ছনায় যেন আপনাকে মাতোয়ারা করবে।
এখানে সবসময় শুনতে পাবেন ঝিঁঝিঁ পোকার ঐকতান। যেন তারা সমস্বরে প্রকৃতির অন্তরের কোরাস গেয়ে উঠছে। এদের সাথে গলা মেলায় ঘাস ফড়িংয়ের দল। পর্যটকরা একে ‘দ্য মিউজিক অব ফরেস্ট’ বলে অভিহিত করেছেন।
বন ও প্রকৃতির সৌন্দর্যের সবটি পেতে চাইলে আপনাকে নীরবতা বজায় রাখতে হবে। এ রাজ্য বন্যপ্রাণির। তাই কথা না বলে বা নিঃশব্দে আপনি হেঁটে গেলে বনের অধিবাসী বানর, উল্লুক, কাঠবিড়ালি, সাপ, মেছোবাঘও দেখতে পাবেন। উপভোগ করতে পারবেন নানা প্রকারের পাখি ও প্রাণির ডাক। এ ডাক আপনাকে জীবনের এক ভিন্ন রকমের অভিজ্ঞতা দেবে।
বন মানুষের আদি নিবাস। মানুষ প্রকৃতির অংশ ছিল। কিন্তু মানুষের উৎপাদনশীলতা আর উদ্ভাবনী ক্ষমতা মানুষকে প্রকৃতি থেকে করেছে পৃথক। আধুনিক নগর সভ্যতার মানুষ তাই প্রকৃতি হতে বিচ্ছিন্ন। জঙ্গল আর বনানীময় পরিবেশে গেলে মানুষ প্রকৃতি থেকে তার এই বিচ্ছিন্নতার বেদনা একটু সময়ের জন্য হলেও যেন উপলব্ধি করতে পারেন। এখানে এলে মানুষ খোঁজ পেতে পারে আপন আদি অস্তিত্বের।
অতীতকে সযত্নে আগলে রাখে প্রকৃতি। এ কথার সত্যতা পেলাম সিঁড়ির মতো খাঁজকাটা পাহাড়ি পথ ধরে উঁচু এক পাহাড়ের শীর্ষে। সেখানে অনেক বছর ধরে বাস করছে নৃগোষ্ঠী খাসিয়া সম্প্রদায়। ‘ফরেস্ট ভিলেজার’ নামে পরিচিত এই খাসিয়াদের ১৯৪০ সালে এখানে আনা হয় ব্রিটিশদের উদ্যোগে। খাসিয়াদের দাবি, তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার তাদের এখানে নিয়ে আসে বন রক্ষার জন্য। তখন জীবন ধারনের জন্য সীমিত আকারে জুম চাষ করার অধিকার দেওয়া হয়েছিল তাদের।
কিন্তু বর্তমানে বনের বিস্তীর্ণ অংশজুড়ে চলছে খাসিয়াদের পান ও লেবুর চাষ। খাসিয়াদের নতুন পান তোলার কাজকে ‘লবর’ বলা হয়। এদের উৎপাদিত পানকে ‘খাসিয়া পান’ বলে।
খাসিয়ারা পাহাড়ে পান ও লেবু চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করলেও এদের পোশাক, জীবনাচারে এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। তাদের বাড়ি-ঘরগুলোতে শহুরে বাঙালিদের মতোই ইট-সিমেন্টের প্রাচুর্য লক্ষ্য করা গেল। এরা আগের মতো ধর্মবিশ্বাসে প্রকৃতিপূজারীও নয়। এদের পুঞ্জিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে শেত পাথরের গির্জা আর ক্রুশবিদ্ধ যিশু। সৌর বিদ্যুতের কল্যাণে এ প্রত্যন্ত বনাঞ্চলে খাসিয়াদের ঘরে ঘরে চলছে ডিশ টিভি, হাল আমলের ভারতীয় জনপ্রিয় সিরিজ। খাসিয়া পুঞ্জির সবচেয়ে উঁচু জায়গায় নিজেদের জন্য স্থাপিত ভাঙাচোরা এক স্কুল ঘরে প্রত্যক্ষ করা গেল- এক কিশোরের হাতে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন।
লাউয়াছড়া কাগজে-কলমে ১২৫০ একর হলেও প্রকৃত বন বড়জোর ৩শ’ একর হবে। আর বাকিটা সময়ের সাথে সাথে অ্যাগ্রো ফরেস্টে পরিণত হয়ে পড়েছে। দিন দিন বাড়ছে এর অ্যাগ্রো ফরেস্টের আয়তন।
লাউয়াছড়ার ৮ কিলোমিটার বুক চিড়ে চলে গেছে ঢাকা-সিলেট রেল লাইন। দিনে বেশ কয়েকবার এ পথে রেল যাওয়া-আসা করে। মানুষের যোগযোগের প্রয়োজনে রেল লাইন স্থাপিত হলেও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ বনে রেলের চাকার নিচে পড়ে প্রতি বছর অনেক প্রাণির অপমৃত্যু ঘটে। এছাড়াও রেলের শব্দ প্রাণিদের অভয়ারণ্যে ভয়ের কারণও। রেল লাইন অপসারণ করে বনের বাইরে পুনঃস্থাপন করলে এ জগৎকে আরও নিরাপদ করা যায়। কথা বলে জানা গেল, বনের মাঝের এ রেল লাইনটি পর্যটকদের জন্য আবার বিশেষ আকর্ষণও বটে। পর্যটকদের ছবি তোলার একটি প্রিয় জায়গা এটি। বিশ্ববিখ্যাত অস্কারজয়ী হলিউডের সিনেমা ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটিন ডেইজ’র শুটিং হয়েছিল জঙ্গলের এ রেল লাইনে। দৃশ্যে চলন্ত ট্রেনের সামনে একঝাঁক বুনো হাতি এসে দাঁড়ালে সিনেমার নায়ক ডেভিড নিভেন রেল লাইন থেকে নেমে যান এবং নতুন এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখী হন।
গোখরা ও রাজ গোখরার মত বিষধর সাপের জন্য বিখ্যাত এই লাউয়াছড়া। তবে সব পর্যটকদের সৌভাগ্য হয় না গোখরা দর্শনের। সৌভাগ্যের বরপুত্রের আশীর্বাদ নাকি মন্দভাগ্যের ফের? এখানে বেড়াতে এসে এক বৃহৎ আকারের বিষধর গোখরা সাপের সাক্ষাৎ ঘটে আমাদের। সাক্ষাৎ না বলে এটি গোখরা সাপের শিকারও বলা যায়। খাসিয়াপুুুঞ্জি থেকে ফেরার সময় লাউয়াছড়ার ঘন জঙ্গলের মাঝে নিচু ভাগের দুর্গম ছড়া দিয়ে দু’পাশের মনলোভা প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলোকন করতে করতে আমরা হাঁটছিলাম। দু’পাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য আমাদের তন্ময় করে তুলেছিল। এমন সময় হঠাৎ ফস্ করে ফণা তুলে আমাদের পথরোধ করে দাঁড়ায় এক মস্ত বড় গোখরা। আমাদের দলের অগ্রভাগের থাকা গাইড ভাগ্যক্রমে এ বিষধর গোখরার ছোবল থেকে মুক্তি পায়। এমন ভয়ার্ত পরিস্থিতির মুখে পড়ে আমরা ভ্রমণের আনন্দ কিছু সময়ের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম।
মানুষের লোভ আর মুনাফার কষাঘাতে লাউয়াছড়ার রূপময় সাম্রাজ্যের অনেকখানি ধ্বংস হয়েছিল ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন। সেদিন আমেরিকান অক্সিডেন্টাল কোম্পানির অদূরদর্শিতার কারণে গ্যাসকূপের এক প্রকাণ্ড বিস্ফোরণে লাউয়াছড়ার মাগুরছড়া অংশের বিস্তীর্ণ গাছপালা পুড়ে কয়লা হয়ে যায়। সেই সাথে নষ্ট হয়ে পড়ে প্রাণির বাস্তু পরিবেশ। মানবসৃষ্ট এ দুর্যোগ প্রকৃতির এ রাজ্যের যে অসামান্য ক্ষতি করে গেছে, তা কখনো ফিরে পাওয়া যাবে না। মাগুরছড়ার অংশে গেলে এখনো সে ধ্বংসযজ্ঞের প্রমাণ মেলে।
প্রকৃতি গবেষক ও প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের জন্য লাউয়াছড়া খুব প্রিয় একটি স্থান। শুধু তা-ই নয়, এটিকে আমাদের দেশের জীববৈচিত্রের জন্য একটি স্বর্ণখনি বললে বাহুল্য হবে না। এ বনের বিশেষত্ব এই যে, এ বনে বাস করে পৃথিবী থেকে বিলীয়মান হতে যাওয়া অনেক ছোট-বড় প্রাণি। তাই এটিকে যেকোন মূল্যে রক্ষা করতে হবে।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট।
এসইউ/পিআর