হায়দরাবাদের প্রাণকেন্দ্র চারমিনার
প্রতিটি শহরের একটি সিম্বল বা প্রতীক থাকে। নিউইয়র্কের স্ট্যাচু অব লিবার্টি, লন্ডনের বিগ বেন, প্যারিসের আইফেল টাওয়ার, হায়দরাবাদের চারমিনার। শহরটির গোড়াপত্তনের সাথে চারমিনার জড়িয়ে আছে। চারমিনার ছাড়া হায়দরাবাদের আলোচনা লবণ ছাড়া তরকারির মতো। বিস্তারিত জানাচ্ছেন সামীউর রহমান শামীম-
দক্ষিণ ভারতের প্রসিদ্ধ শহরগুলোর একটি হায়দরাবাদ। শহরটি তেলেঙ্গানা রাজ্যের রাজধানী। ২০১৪ সালে অন্ধ্র প্রদেশ বিভক্ত হয়ে অন্ধ্র প্রদেশ ও তেলেঙ্গানা পৃথক দুটি রাজ্যে পরিণত হয়। তখন থেকে হায়দরাবাদ যৌথভাবে দুটি রাজ্যের রাজধানী। অন্ধ্র প্রদেশের রাজধানী অমরাবতি ২০২৫ সাল নাগাদ সার্বিকভাবে রাজধানীতে পরিণত হবে।
হায়দরাবাদ প্রতিষ্ঠা: ষোড়শ শতাব্দী থেকে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত দাক্ষিণাত্য মালভূমি পাঁচটি সালতানাতে বিভক্ত ছিল। সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ছিল গোলকোণ্ডা সালতানাত বা কুতুবশাহী সালতানাত। হায়দরাবাদের গোড়াপত্তন এ কুতুবশাহী রাজবংশের পঞ্চম ও সবচেয়ে প্রসিদ্ধ শাসক মুহাম্মাদ কুলি কুতুব শাহের মাধ্যমে। ১৫৮০ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি শাসনভার গ্রহণ করেন।
গোলকোণ্ডা বা কুতুবশাহী সালতানাতের শাসনকার্য চলতো গোলকোণ্ডা কেন্দ্রিক। বর্তমান হায়দরাবাদ শহর থেকে ১১ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত গোলকোণ্ডা দূর্গ। ‘কোণ্ডা’ শব্দের অর্থ ‘পাহাড়’, ‘গোলকোণ্ডা’ অর্থ ‘গোলাকৃতির পাহাড়’। বর্তমানে গোলকোণ্ডা হায়দরাবাদ জেলার একটি তহশিল।
চারমিনার নির্মাণ: বর্তমান হায়দরাবাদ শহরের আয়তন সাড়ে ছয়শ’ বর্গ কিলোমিটার। হায়দরাবাদ মেট্রোপলিটনের আয়তন ৭,২৫৭ বর্গ কিলোমিটার। ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে হায়দরাবাদ কিন্তু এত বড় ছিল না। সুলতান মুহাম্মাদ কুলি কুতুব শাহ গোলকোণ্ডা দূর্গের বাইরে একটি শহর গড়ে তোলার আদেশ জারি করেন। শহরটি হবে স্বর্গের মতো। হতে হবে অতুলনীয়। দায়িত্ব পড়ে সালতানাতের প্রধানমন্ত্রী মীর মোমিনের ওপর। ১৫৯১ সালে সুলতানের আদেশে, প্রধানমন্ত্রীর পরিচালনায় গড়ে তোলা হয় চারমিনার। মুসি নদী ও চারমিনারকে কেন্দ্র করে দাঁড়ায় হায়দরাবাদ। বর্তমানে এলাকাটি পুরান হায়দরাবাদের অন্তর্ভুক্ত।
আজকের চারমিনার: তৎকালীন চারমিনার ছিল হায়দরাবাদের কেন্দ্র। এটি মূলত মসজিদ ও মাদরাসা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। একালে সেখানে মসজিদ বা মাদরাসার কোন কার্যক্রম নেই। দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন সকাল দশটায় দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয় চারমিনার এবং বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত খোলা থাকে। ভারতীয়দের জন্য প্রবেশমূল্য ২৫ রুপি (প্রায় ৩০ টাকা) হলেও ভিনদেশিদের জন্য ৩০০ রুপি (প্রায় সাড়ে তিনশ’ টাকা)। তবে বাংলাদেশিরা খুব সহজেই ২৫ রুপির টিকিট কেটে ঢুকে যেতে পারেন।
হায়দরাবাদ এখন সেই ষোলো শতকের ১২ মাইল পরিধির ছোট শহর নেই। শহরের পরিধি বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ছয়শ’ বর্গ কিলোমিটার। হয়েছে নতুন হায়দরাবাদ ও হাইটেক সিটি। তবে পুরান হায়দরাবাদের কিছুটা ছোঁয়া পাওয়া যায় চারমিনার এলাকায় গেলে। চারমিনারকে কেন্দ্র করে এখনো টিকে আছে পুরান হায়দরাবাদ। পাশেই মক্কা মসজিদ। মক্কা মসজিদের নির্মাণকাল চারমিনারের পরে। প্রায় বিশ হাজার মানুষ একত্রে নামাজ আদায় করতে পারে মক্কা মসজিদে। দুই ঈদের নামাজে অসংখ্য মুসল্লিতে ভরে ওঠে পুরো এলাকা। রমজানের প্রতিটি রাতে চারমিনার দেখার মতো। সারারাত উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে। অসংখ্য কবুতর মক্কা মসজিদজুড়ে উড়ে বেরায় অনবরত।
জার্মান স্কলার জ্যান পিপারের মতে, ‘হায়দরাবাদ শহরটি গড়ে উঠেছিল চারমিনারকে কেন্দ্র করে এবং চারমিনারের মুখ ছিল পশ্চিম দিক। চারমিনার থেকে ৭৬ মিটার (প্রায় আড়াইশ’ ফুট) উত্তরে একটি ফোয়ারা, যা চার কোণা বিশিষ্ট বড় চৌবাচ্চার মাঝে অবস্থিত। যার নাম চারসু কা হাউস অর্থাৎ চারদিকের ফোয়ারা।… আরেকটি ফোয়ারা ছিল, যেটির নাম গুলজার হাউস, এখন সেটি বিলুপ্ত।’
জার্মান ভদ্রলোক দীর্ঘ বর্ণনা দিয়ে গেছেন। তার বর্ণিত চারসু কা হাউস এখন মক্কা মসজিদ কমপ্লেক্সের ভেতরে। চারমিনারকে কেন্দ্র করে বসে মেলার মতো বিশাল বাজার। হরেক রকম জিনিস কম দামে মেলে। ধর্মীয় সামগ্রী তথা জায়নামাজ, টুপি, পাগড়ি, তসবিহ ইত্যাদির ব্যাপক আয়োজন। সুগন্ধির মেলা। দেশ-বিদেশের নানা ধরনের সুগন্ধি মেলে এখানে।
আমার একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি, আমি আর এক আরব বন্ধু চারমিনার গেছি। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা হলে ছুটলাম আতর তথা সুগন্ধির দোকানে। আমার বন্ধুর দেশীয় এক বন্ধু তাকে বলেছে, কিছু সুগন্ধি নিয়ে যেতে। ওদের দেশে না-কি ব্যাপক দাম। হায়দরাবাদে মেলে বেশ কম দামে। এক দোকানে দেখি দু’জন আরব যুবক অনেক সুগন্ধি কিনছে। আমার বন্ধু আমাকে আস্তে করে বলল, এরা এগুলো দেশে নিয়ে বিক্রি করবে। মানে ব্যবসার উদ্দেশে কিনছে।
হায়দরাবাদি স্থানীয় চুড়ি ও শাড়ির দোকানের বিশাল সারি। সেই সাথে মুক্তোর শহর খ্যাত হায়দরাবাদের মুক্তার গহনার মূল দোকানগুলোও গড়ে উঠেছে চারমিনারকে কেন্দ্র করে। অবশ্য অনেক হকার হাতে করে মুক্তার গহনা বিক্রি করে কম দামে। চারমিনার এলে তাদের দেখা পেতেই হবে। লাইটারে আগুন জ্বেলে গহনায় আঁচ দিয়ে তা যে ‘আসল’ এটা প্রমাণের ব্যর্থ চেষ্টা করে। মূলত গহনা নিতে চাইলে সেখানে গড়ে ওঠা অনুমোদিত দোকান থেকে না কিনলে ঠকে যাওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা আছে। বিয়ের বাজার করার পরিকল্পনা থাকলে হায়দরাবাদের চারমিনার এলাকার বিকল্প নেই। বর ও কনের উভয়ের পোশাকের ছড়াছড়ি। রয়েছে ছোট-বড় শো-রুমও।
চারমিনারের ঠিক পাশেই একটি দোকানে ইরানি চা বিক্রি হয়। সাথে নানা ধরনের কুকিজ। ছুটির দিনগুলোতে সিরিয়াল ধরে চা-কুকিজ কিনতে লাইনে দাঁড়িয়ে ব্যাপক বেগ পেতে হয়।
শেষ করতে চাই বিখ্যাত ঐতিহাসিক ফিরিশতার (১৫৬০-১৬২০) হায়দরাবাদ নিয়ে বর্ণনার সংক্ষেপ উল্লেখ করে, ‘গোলকোণ্ডার পরিবেশ কেমন যেন বদ্ধ লাগছিল মুহাম্মাদ কুলি কুতুবের। তারপর গোলকোণ্ডা থেকে আট মাইল দূরে একটি শহর গড়ে তুললেন। শহরটির নাম হায়দরাবাদ হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। তৎকালে এর পরিধি ছিল ১২ মাইল; শহরটির প্রধান সড়কগুলো ভারতবর্ষের অন্যান্য শহরের সড়কগুলো থেকে প্রশস্ত ও পরিষ্কার। এর বাতাস সুবিমল।’
মুঘল জমানার ঐতিহাসিক ফিরিশতার মতো আমিও বলতে চাই, কেউ যদি জীবনের প্রতিদিনের বৃত্তের ভেতর ঘুরে বদ্ধ বোধ করে। মুক্ত বাতাসের খোঁজ করে। তবে সে যেন মুহাম্মাদ কুলি কুতুবের নির্মল বাতাসের জন্য গড়ে তোলা হায়দরাবাদে ঘুরে যায়। দেখে যায় ঐতিহ্যের কিছু চিহ্ন। নিয়ে যায় কিছু স্মৃতি। বিমল বাতাস।
সূত্র:
১. সায়দা ইমাম সম্পাদিত দ্য আনটোল্ড চারমিনার (রাইটিংস অন হায়দরাবাদ)
২. নরেন্দ্র লুথারের হায়দরাবাদ থ্রো ফরেন আইস প্রবন্ধ
লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, দ্য ইংলিশ অ্যান্ড ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজেস ইউনিভার্সিটি, (ইএফএল-ইউ), হায়দরাবাদ।
এসইউ/এমএস