জাপান ভ্রমণে যে কারণে মুগ্ধ হবেন
অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার, অদেখাকে দেখার অদম্য আগ্রহ মানুষের জন্মগত। তাই ভ্রমণ বিষয়ক লেখালেখির শেষ নেই। সে অর্থে এ লেখা ভ্রমণকাহিনি নয়। শুধু জাপানে কাটানো চৌদ্দ দিনের আনন্দ স্মৃতি। জাপান ঘুরে এসে লিখেছেন স্বপ্নিল চৌধুরী—
আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সাথে ১৪ দিনের জাপান সফরের সুযোগ হয়েছে। জাপানের ইউশি ইয়াকির সাথে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশের চুক্তির আলোকে ‘ইউশি কালচারাল এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম’র আওতায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১০ সদস্যের শিক্ষক-শিক্ষার্থী প্রতিনিধি দল ১৪ দিনের জন্য জাপান গিয়েছিলাম। এর নেতৃত্ব দিয়েছেন সোশ্যাল সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. তৌফিকুল ইসলাম মিথিল স্যার। প্রতিনিধি দলের অন্য সদস্যের মধ্যে ছিলাম আমি, ফাবিহা ইয়াসমিন, সোমাইয়া আকন্দ আঁচল, আবরার শাহরিয়ার বিন আসাদ, শেখ জুলকার নাঈন জামিউ, অন্তরা সরকার, খালিদ ইবনে হাসান, ফারিহা হোসেন মিথিলা, জান্নাত আরা নিসা।
জীবনের প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। আমার মতো অনেকের প্রথমবারের মতো বিদেশ সফর। আমি একদম চিন্তিত কিংবা বিচলিত নই বরং আনন্দে ভাসছি। সূর্যোদয় আর জাপানকে একসাথে দেখার সৌভাগ্য- ভাবতেই অবাক লাগছে। অনেকটা ভাগ্যবানও বটে। জাপানের নাগরিক রোটারিয়ান ইউশি ইয়াকির আমন্ত্রণে তার খরচে জাপান যাচ্ছি। প্রোগ্রামের মূল উদ্দেশ্য একটাই- জাপানের ভাষা, সংস্কৃতি, উন্নত প্রযুক্তি আর টেকসই উন্নয়ন সম্পর্কে জানা।
রাত ১১টায় ফ্লাইট। যথারীতি সবাই জাপানে যাওয়ার উদ্দেশে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে আমাদের পূর্বনির্ধারিত ফ্লাইট বাতিল হয়েছিল। পূর্বনির্ধারিত ওসাকা বিমানবন্দরের পরিবর্তে আমরা নারিতা বিমানবন্দরের ফ্লাইট ধরেছিলাম। নারিতা বিমানবন্দরে নামার পর আমরা ক্ষণে ক্ষণে মুগ্ধ হয়েছি। বিশ্বাসই হচ্ছিল না, দীর্ঘ বিমানযাত্রার ধকল আর রাতের আঁধার কাটিয়ে আমরা সূর্যোদয়ের দেশ জাপানে।
> আরও পড়ুন- ইউরোপের রোমান্টিক ডেসটিনেশন স্ক্যান্ডিনেভিয়া
বিমানবন্দরের মেইন গেইটে আসার পর দেখি আমাদের রিসিভ করার জন্য ইউশি ইয়াকি চলে এসেছেন। সবাইকে দেখার পর এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন, বারবার সেই হাসিমাখা মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। নারিতা বিমানবন্দরের পাশের স্টেশন থেকে এক্সপ্রেস ট্রেনে উঠলাম। বিমানযাত্রার ক্লান্তি সত্ত্বেও ট্রেনের জানালা দিয়ে জাপানের যে টুকরো ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠলো এককথায় চোখজুড়ানো ও আবেশময়। শিল্প আর প্রযুক্তির প্রকৃত মেলবন্ধনের দেশে এসে সবাই অভিভূত। চারপাশে পিকচার পোস্ট কার্ডের মত সুদৃশ্য কাঠের ছোট ছোট ঘর। সেখানকার ছিমছাম রাস্তা দেখে মন ভরে গিয়েছিল।
এক্সপ্রেস ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম। গন্তব্য মিনামি কুসাতসো স্টেশন। বুলেট ট্রেনে যেতে হবে। বুলেট ট্রেনের কথা শুনে সবাই শিহরিত হয়েছিলাম। প্রথমবারের মতো বুলেট ট্রেনে যাত্রা। বুলেট ট্রেনে উঠলাম। ট্রেন চলছে দ্রুতগতিতে। চলমান ট্রেনের দু’পাশে ঘর-বাড়ি, গাছ-পালা ও মাঝে মাঝে ধানক্ষেতের সৌন্দর্য মন কেড়ে নেওয়ার মতো। যা দেখি তা-ই মনে হয় কোন এক দক্ষ শিল্পীর সৃষ্টি। কেবল ইট, পাথর, কংক্রিটের নিয়মিত অট্টালিকাই নয় বরং এরসঙ্গে সুনিপুণভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও।
স্টেশন থেকে নেমে সোজা চলে গেলাম ইউশি ইয়াকির প্রথম বাড়িতে। ১৪ দিন আমরা এখানেই থাকবো। ডুপ্লেক্স বিল্ডিং। সেখানে পৌঁছার পর দেখলাম আমাদের সাহায্য করার জন্য কানা ওয়াদা, সিজোনো থাকবে সবসময় আমাদের সাথে।
জাপানে আমরা অনেকগুলো শিক্ষামূলক কার্যক্রম এবং সেমিনারে অংশগ্রহণ করি। তারমধ্যে ওহমি এনভায়রনমেন্ট কনভারসেশন ফাউন্ডেশনের সেমিনার, কোনান-চুবু ওয়াটার পিউরিফিকেশন সিস্টেম পরিদর্শন, মিনোরি নার্সারি স্কুল পরিদর্শন, শিগা প্রিফেকচার হাসপাতাল পরিদর্শন এবং সেমিনারে অংশগ্রহণ, ইউশিকাওয়া পিউরিফিকেশন প্লান্ট, লেইক ভিওয়া জাদুঘর, হিরোশিমা জাদুঘর, মিয়াজিমা আইসল্যান্ড, মাতসুইয়ে ক্যাসেল, শিমানে ইউনিভার্সিটি, সেইকসুয়ে হাউস আর অ্যান্ড ডি ইনস্টিটিউট, কিয়োটো ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সাল স্টুডিও জাপান, কিনকাকা-জি (গোল্ডেন টেম্পল), কিটো রেলওয়ে জাদুঘর পরিদর্শন করেছি।
> আরও পড়ুন- সিঙ্গাপুরে সূর্যাস্ত দেখার ৩টি চমৎকার জায়গা
সফরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল রয়েল ওকসো হোটেলে শিগা প্রিফেকচার ওতসু রোটারি ক্লাবের সেমিনার এবং ডিনার পার্টি। সেখানে আমাদের শিক্ষিক এবং প্রতিনিধি দলের সমন্বয়ক মিথিল স্যার বাংলাদেশের বিশুদ্ধ পানির সমস্যা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন। সবশেষে আমরা সবাই বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে ডিনার পার্টিতে অংশগ্রহণ করি। ডিনার পার্টিতে বাংলাদেশের সংস্কৃতি কিছুটা তুলে ধরার সুযোগ পাই। বাংলা গান, নৃত্যে যেন একখণ্ড বাংলাদেশ উপস্থাপিত হলো। তাছাড়া ইউশি ইয়াকির আমন্ত্রণে তার বাসায় জাপানের ঐতিহ্যবাহী টি ফেস্টিভালে অংশগ্রহণ করি। সেখানে তারা জাপানের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে ছিলেন। যা ছিল একটি বিচিত্র অভিজ্ঞতা।
এর পাশাপাশি আমরা কিয়োটো ইউনিভার্সিটির দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক কর্মকাণ্ডের প্রধান ড. ফুজিতার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করি এবং সেমিনারে অংশগ্রহণ করি। মিনোরি নার্সারি স্কুলের পিচ্চি বাচ্চাদের সাথে কাটানো মুহূর্তটা ছিল সবচেয়ে উপভোগ্য। স্কুলের ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকার সাথে জাপানের লাল-সাদার মিল পেয়ে দারুণ উল্লসিত। আমাদের উপস্থাপনায় পিচ্চিগুলো দারুণ অভিভূত হয়েছিল। কম সময়ের মাঝে আমাদের খুব আপন করে নিয়েছিল। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে প্রকাশ পায় বাংলাদেশ সম্পর্কে জানার আগ্রহ। আমাদের দেশকে তাদের ভালো লাগে, তারা বড় হয়ে বাংলাদেশ ভ্রমণের ইচ্ছা প্রকাশ করে। আসার সময় এক পিচ্চি আমার কোল থেকে নামতেই চাচ্ছিল না। ওই পিচ্চির মায়াভরা মুখটি ভেসে উঠছে আমার চোখের সামনে।
জাপানিদের উন্নত রুচিবোধ, সৌন্দর্যজ্ঞান, নীতিধর্ম, শ্রমলব্ধ সাধনা, প্রকৃতিবন্দনা এবং শিল্পচর্চার প্রতি ভালোবাসা আমাদের আকৃষ্ট করেছে। জাপানে মুগ্ধ হওয়ার মতো সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে সময়জ্ঞান। তারা যে সময়ে রেল, বাস, বিমান ছাড়ার কথা বলবে, তার একমিনিটও হেরফের হবে না। প্রযুক্তির তীর্থক্ষেত্র জাপানের সাথে আমাদের সময়ের ব্যবধান তিন ঘণ্টা। কিন্তু সার্বিক ক্ষেত্রে ব্যবধান মনে হয় কয়েক আলোকবর্ষ দূরে।
আমরা দেখলাম, জাপানি শিক্ষাব্যবস্থা কতোটা জীবনমুখী। ১৪ দিনে আমাদের গাড়ির হর্ন কিংবা পুলিশের গাড়ির সাইরেনের শব্দ শোনার সুযোগ হয়নি। অন্যসব উন্নত দেশের মতই জাপানে হর্ন বাজানো বোধহয় অসভ্যতার পর্যায়ে পড়ে। সবচেয়ে ভালো লাগছিল স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থার ভেলকি দেখে। লাল, হলুদ আর সবুজ আলোর কেরামতিতে রাস্তার ট্রাফিক সুনিয়ন্ত্রিত। আইনের প্রতি সম্মান জানাতে অভ্যস্ত জাপানিরা আইন ভাঙার কথা ভাবতেও পারে না। ছোট-বড়, ছেলে-বুড়ো সবার হাসিমুখ, মুখের ভাষায় প্রভেদ থাকলেও আন্তরিকতার আত্মীক ভাষার কল্যাণে জাপানি মানুষের আতিথেয়তায় নিশ্চিত মুগ্ধ হবেন, আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি বারবার। যেখানেই যাবেন, শুনবেন ‘আরিগাতো গুজাইমাস’।
> আরও পড়ুন- এক শহরেই ৭ দর্শনীয় স্থান
শিক্ষা সফরে যে জিনিস আমাদের সবার মন ছুঁয়ে গেছে, তা হলো- জাপানিদের আন্তরিকতা ও অতিথিপরায়ণতা। একটি সমৃদ্ধশালী দেশের মানুষ এত বিনয়ী হতে পারে, তা নিজের চোখে না দেখলে হয়তো বিশ্বাসই হতো না। জাপানে ১৪ দিনে যত জায়গায় গিয়েছি, যতজনের সাথে দেখা হয়েছে, কিছু না কিছু উপহার পেয়েছি। আমাদের ব্যাগ আর লাগেজ তাদের উপহারে পরিপূর্ণ ছিল। ইউশি ইয়াকি সান যার কল্যাণে আমরা জাপানে ১৪ দিন ভ্রমণ করলাম, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। সেইসঙ্গে মিথিল স্যারের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ, তিনি না থাকলে হয়তো আমরা এতকিছু সহজে জানতে পারতাম না।
ফিরে আসার সময় ইউশি ইয়াকি সান, সুগিওকা সান, কানা ওয়াদা, সিজুনু, ইউকি, সুজুকি সান, ফুরুকি সানসহ সবার চোখে পানি দেখে বুঝতে বাকি থাকলো না যে, এই অল্প কয়েক দিনে তারা আমাদের কতো ভালোবেসেছেন, আপন করে নিয়েছেন। এমন আবেগঘন মুহূর্তে আমরাও আমাদের চোখের পানি আটকে রাখতে পারিনি। চোখের জলে সবাইকে বিদায় দিয়ে জাপানি বন্ধুদের ভালোবাসা এবং লাল-সবুজের পতাকা বুকে নিয়ে ১৪ দিনের জাপান সফর শেষে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দিলাম। রচনা করে এলাম জাপান-বাংলাদেশ বন্ধুত্ব আর ভালোবাসার নতুন সেতুবন্ধন।
এসইউ/এমএস