ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ভ্রমণ

বসন্তে রাঙ্গামাটির পাহাড়ি সৌন্দর্য

জুয়েল থিওটোনিয়াস | প্রকাশিত: ০৫:২৮ পিএম, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বাংলাদেশের পাহাড়ে আগুনের রঙ-তেজ কান্না হাসির দোল দোলানো। একে তো সেখানে অশান্তির আগুন যেন অনির্বাণ; হলদে লালাভ আগুনে ভস্ম-ধূসর হয় স্বপ্ন-জীবন, ক্ষুণ্ন হয় সম্প্রীতি। এর মাঝেও ক্ষণিকের কিংবা চকিতের বর্ণিল আগুন জীবনকে করে তোলে আনন্দময়। ‘জীবন যেখানে দ্রোহের প্রতিশব্দ, মৃত্যুই সেখানে শেষ কথা নয়’ যেহেতু, সেহেতু আলাদা করে বসন্তবরণের বালাই পাহাড়ে নেই। কেননা পাহাড়ের আগুনের রঙ যতটা না কামরঙা, তারচেয়েও বেশি রক্তিম দ্রোহের। প্রতিটি ঋতুই স্বমহিমায় এখানে বিরাজ করে। কেননা পাহাড়ের মানুষ বিশেষত আদিবাসীরা প্রকৃতি-নিবিড়। যা হোক, ওই রঙিন সুখের অনলসমাচারই আজকের পাঠ্য। এ সমাচার বসন্তের এ জন্মের। বসন্তের এ জন্ম বলতে এবারের ফাল্গুনের আগমন।

ঢাকা থেকে আমরা দু’জন, আমি আর দিশা রওনা হবার সময় থেকেই সীমাহীন উত্তেজনা। কতোদিন পর পাহাড়ে! আহারে! নিছক ভ্রমণের উদ্দেশে নয়, জীবনে জীবন মেলাবার চেষ্টা। বাড়তি একটা আগুন জ্বলছিল আমাদের মাঝে। বেতন হয়নি তখনও, বন্ধুদের কল্যাণে ধারের টাকায় সাধ্য-সাধ্যের সম্মিলন।

rangamati-in

কুয়াশা ভেদ করে রবির কিরণ যখন চোখের পাতায় চুমু খেল, ঘুম নিজে থেকেই পালালো। ততোক্ষণে রাঙ্গামাটির রাজ্যসীমায়। প্রায় ৬ মাস পর এলাম। সদরের চম্পকনগরে বসন্তের ফুল অশোকের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতের পর নন্দিতা চাকমার বাড়িতে হাতমুখ ধুয়ে জমপেশ নাস্তা সেরে সামান্যতম দেরি না করে বনরূপা থেকে আমরা সিএনজি রিজার্ভ করলাম ১৫০০ টাকায়। গন্তব্য খাগড়াছড়ি সদরের আগে বিজিতলা এলাকার গরগয্যাছড়ি গ্রামে। আমাদের সফরসঙ্গী নন্দিতা চাকমা নিজেও, গরগয্যাছড়ি তার বাবার বাড়ি এলাকা। এমনিতে রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি বিরতিহীন বা গেইটলক বাস ভাড়া ১৫০ টাকা আর লোকাল ১২০ টাকা। পৌঁছতে লাগবে দু’ঘণ্টার কিছু বেশি। দূরত্ব ৫৭ কিলোমিটার।

যেতে যেতে খাবারের গল্প করা যাক। পুরো সফরে প্রতিবেলা আতপ চালের ভাত খেয়েছি। প্রতিটি বাড়িতেই অভিন্ন তরকারি হিসেবে ছিল সিদোল আর চিংড়ি শুটকি দিয়ে সেদ্ধ লাউশাক, ডুমুর সিমের হুরবো, পাজন, জুমের বেগুন ও বরবটি দিয়ে মাশরুমের ঝোল, কাঁচা কাঁঠালের তরকারি, দেশি মুরগি, মটরশুটি আর হাঁসের ডিম।

বিজিতলা পর্যন্ত শিমুল-পলাশের একটা গাছও চোখে না পড়ায় মন বেজার হলো। তবে ট্রাফিক জাম দেখেছি ঘিলাছড়ি বাজারে। একে তো সেখানে হাটবার, তাকে সহায়তা করেছে পিকনিক পার্টির বাসগুলো। হাটের বিষয়টি ভালো লেগেছে, কী প্রাণচঞ্চল! হাট মানেই একরকম মেলা। আর দেখেছি ধুলা পুরো পথজুড়ে তবে আমাদের ঢাকার মতো দূষিত নয়। ধুলা মেখেই প্রাণচঞ্চল মানুষ যার যার কাজে ব্যস্ত। নানিয়াচর পর্যন্ত দুদিকে পাহাড় আর পাহাড়, আর সবুজের আধিক্য। তার পর থেকে পাহাড় চলে গেল দূরে, আশপাশের রং ধারণ করলো ধূলি-ধূসর, আর কৃষকের যত্নে থাকা ফসলি ক্ষেত। চোখে পড়েছে দুরন্ত শিক্ষার্থীরা। খাগড়াছড়ি পর্যন্ত কয়েকটি প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয় চোখে পড়েছে, উপাসনালয় চোখে পড়েছে, তবে কোন হাসপাতাল চোখে পড়েনি, উপজেলা কেন্দ্র ছাড়া কোন হাসপাতাল-ক্লিনিক নেই, এক উপজেলা থেকে আরেক উপজেলার মাঝের দূরত্বে আছে শুধু স্বাস্থ্যকেন্দ্র, তা-ও বাজার এলাকাগুলোতে। খাগড়াছড়ি সদর থেকে পানছড়িতে যাবার সময়ও একই চিত্রের প্রতিফলন পেয়েছি।

rangamati-in

বগাছড়ি ১৪ মাইল এলাকায় করুণা বনবিহার চোখে পড়লো, ৩০ ফুটের মতো উঁচু সোনালি রঙের ধ্যানরত বুদ্ধ যেন সব দেখে রাখছেন। রাখছেন তো? বছর ২ আগে এই বনবিহারের জায়গা নিয়ে আদিবাসী-সেটেলার বাঙালিদের মধ্যে গণ্ডগোল হয়েছিল। বিজিতলা পর্যন্ত গুনতেও খেয়াল ছিল না যে, এতোবার সেনাবাহিনীর চেকপোস্টের মুখোমুখি হয়েছি, ব্যাপারটা প্রচণ্ড বিরক্তিকর, নিরাপত্তার নামে হেনস্তা।

বিজিতলা এসে সিএনজি ডানে মোড় নেয়। গরগয্যাছড়ি খাগড়াছড়ির এক অবিদিত গ্রাম। অবিদিত কেননা এখানে ‘সম্মানিত পর্যটক’দের পদধূলি পড়ে না। তাতে কী-ই বা আসে যায়? এমন গ্রাম স্বগর্বিত। শুভদৃষ্টি পড়তেই দেখি ওই সুখাগ্নির আহ্বান। যেন পরম মমতায় কোলে তুলে নেবে। একলা এক শিমুল গাছ অথচ ওতেই সে একশ’। পুষ্পে পুষ্পে নিজের অঙ্গ ভরে যতটা প্রসারিত হতে পারে, তারচেয়েও বড় সৌন্দর্যআভা সৃষ্টি করে। নিঃশব্দ বৃক্ষের সেই বাণী সশব্দ পক্ষীকূল সানন্দে জানান দেয়। এ এলাকায় শিমুল গাছ আছে, পলাশ নেই বললেই চলে। আর এমন না যে শিমুল গাছে এলাকা এলাকা ছেয়ে থাকে, সংখ্যায় খুব না তবে চোখে পড়ে। মানসপটে এসবের ছাপচিত্র আঁকতে আঁকতে কখন জানি কিরণবালা চাকমার বাড়িতে পৌঁছে যাই, নন্দিতা চাকমার বড় বোন তিনি। কিরণবালার ছোট ছেলে থাকে এখানে, বড় ছেলে সদরে, যাওয়া-আসা করে থাকেন তিনি। তাদের উষ্ণ অভ্যর্থনায় বিগলিত হই। মধ্যাহ্ন ভোজের আগে গ্রামের আশপাশ খালি পায়ে হেঁটে বেড়াই আমরা, কখনো গ্রামের মূল পথ, কখনো ক্ষেতের আল। শিমুল গাছ আরেকটা চোখে পড়ে, আর কতো যে পাখি! আমাদের দেখে স্বাগত জানালো নাকি বকলো বোঝার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই।

তাগিদের ধারাবাহিকতায় খেয়েই রওনা হই। এবারও সিএনজি রিজার্ভ, জনপ্রতি ১০০ টাকা। এবার দল আরেকটু ভারি, কিরণবালা চাকমা সঙ্গী, সে যাবে তার বড় ছেলের বাড়িতে সদরে। ২০১৫ সালে বন্ধু মিতু বিদেশ চলে যাওয়ার আগ দিয়ে এসেছিলাম খাগড়াছড়িতে। এরপর আজ। দিশাও এসেছে প্রায় ১ যুগ পর। দক্ষিণ খবংপড়িয়ায় কিরণবালাকে তার ছেলের বাড়িতে রেখে সেখানে চা খেয়ে আমরা যাই উত্তর খবংপড়িয়ায় জবা চাকমার বাড়িতে। ব্যাগ রেখে জবাদি ও তার মেয়ে নিকিতা চাকমার সাথে স্থানীয় পৌষ মেলায় যাবার সময় অটো ঠিক করে চড়ে বসামাত্রই হুট করে রাস্তা থেকে লোক এসে অটোতে উঠে পড়ে। আমি ভাবলাম লোকাল সিস্টেমে যাব হয়তো, পরে জানলাম যে রিজার্ভই, লোকটা জবাদির স্বামী ত্রিদিপ চাকমা। এ নিয়ে হাসাহাসি চলতে চলতে মেলায় পৌঁছাই, স্থানীয় মেলা, ছোট তবে বারোয়ারি। বেশিক্ষণ থাকলাম না। বের হয়ে পথের ধারে এক মারমা নারীর সুনিপুণ হাতে তৈরি শুকনো ভাপা পিঠা খাই, শুকনো মানে তেলে ভাজা না। অসাধারণ! রাতে জবাদির বাড়িতেই খাওয়া-থাকা হয়।

rangamati-in

পরদিন সকালে স্থানীয় মাজন দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে ত্রিদিপদা নিয়ে যায় তার বাড়ির পেছনে চেঙ্গি নদীর পাড়ে, পাড়জুড়ে ভুট্টা আর আখের ক্ষেত। কী পবিত্র এক সকাল! সূর্য তখনও কুসুম কুসুম। শুকনো মৌসুম বলে নদীর জলধারা কুলকুল বইছে, বর্ষায় তো দু’কূল ছাপিয়ে যায়। পা ভেজানোর সময় চোখে পড়লো ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের প্লেট গ্লাস বালিতে আটকে আছে নদীর মাঝখানে, সম্মানিত পর্যটকদের কৃতিত্বের ছাপ। বেশিক্ষণ থাকতে পারি না, ত্রিদিপদা তাড়া দেন। নাস্তা সেরে ত্রিদিপদার মোটরবাইকে চড়ে বসি, গন্তব্য পানছড়ির শান্তিপুর অরণ্য কুটির বৌদ্ধবিহার। দূরত্ব ১৭ কিলোমিটার, পানছড়ি ২০ কিলোমিটার। এবার এ পথে কিছুক্ষণ পরপরই একটি দুটি শিমুল গাছ সহাস্যে নিজের অবস্থান জানান দিয়েছে। ত্রিদিপদা ভূমি কর্মকর্তা, ফলে তার চেনা মানুষের অভাব নেই। রাস্তায় বহুবার কুশল বিনিময়ের জন্য থামতে হয়েছে, চা-নাস্তা খেতে হয়েছে বহুবার অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতো। বৌদ্ধবিহারের আগে চেঙ্গি নদীর ওপর নির্মিত সেতু পার হতে হয়, নিচে রাবার ড্যাম। বৌদ্ধবিহারের স্থানটি সত্যিকার অর্থেই শান্তিপুর, তপোবন যাকে বলে। সুনির্দিষ্ট তথ্য না পেলেও ত্রিদিপদার মতে, ৫০০ একরের কম হবে না এর সীমানা। হাতে সময় কম থাকায় নাতিদীর্ঘ পদব্রজ করি আমরা, দেখা হয় ৫০ ফুট উচ্চতার বুদ্ধমূর্তিকে। এখানেও নাকি সেটেলার বাঙালিরা প্রায়ই ঝামেলা করে। কবে যে থামবে এসব!

সদরে ফিরে কিরণবালার বড় ছেলের বাড়িতে দুপুরের আহার সেরে রাঙ্গামাটিগামী বাসে চড়ে বসি আমি, দিশা আর নন্দিতা চাকমা। বাসের তথ্য আগেই দেওয়া। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, নন্দিতা চাকমা আমাদের জানিয়েছিলেন, খাগড়াছড়ির যেসব বাড়িতে আমরা গিয়েছিলাম, প্রতিটিতেই আমাদের সম্পর্কে খোঁজ নিতে এসেছিল পাহাড়ের আদিবাসীদের একাধিক রাজনৈতিক সংগঠনের লোকজন। রাঙ্গামাটি শহরে প্রবেশের আগে দূর পাহাড়ের ওপাশে দিনমণি ডুব দেওয়ার সময় নানা চিন্তা ভর করে মনে, মোটাদাগে বললে একটাই প্রশ্ন, পাহাড় তুমি শান্ত হবে কবে? এই যে সেনাশাসন, এই যে বিদ্রোহ-স্বাধীকার আন্দোলন, এই যে রেষারেষি-অসম্প্রীতি, কবে থামবে?

রাঙ্গামাটির বনরূপায় নেমে বাজার সদাই কিনে নন্দিতা চাকমার বাড়িতে পাঠিয়ে দেই। এরপর দেখা করি বন্ধু মুকুল ত্রিপুরা, নুকু চাকমা দিদি, পারমিতা চাকমার সাথে।

rangamati-in

পরদিন রাতে বাসে করে ফেরা। তার আগে দুপুরে দীপজয় খিসা ও নিশা চাকমা নামে এক যুগলের বিয়ে উপাখ্যানে সামিল হই। এর বৃত্তান্ত তুলে ধরা সময়সাপেক্ষ। সে গল্প আরেকদিন। তবে এটুকু বলা-ই যায় যে, আমরা বেশ মাঞ্জা মেরে তাতে সামিল হয়েছিলাম, দেখা হয়েছিল অনেক পরিচিত মানুষের সাথে।

বিদায় মুহূর্তে মননে একটাই দর্শন, ভালো থেকো পাহাড় নিজের মতো করে। দ্রোহের অগ্নিবাণে শান্তির অগ্নিবীণা ঝংকার তুলুক।

কীভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে রাঙ্গামাটি আর খাগড়াছড়িগামী বাস অহরহ। কলাবাগান, ফকিরাপুল, কমলাপুর, সায়েদাবাদ থেকে ছাড়ে। ভাড়া নন এসি ৬০০, এসি সাড়ে ৯শ’ থেকে দেড় হাজার পর্যন্ত।

rangamati-in

কী দেখবেন: পার্বত্য ৩ জেলা স্বভাবগতভাবেই সুন্দর। এরপরও রাঙামাটির সুভলং, কাপ্তাই লেক, বিলাইছড়ি, সাজেক, ডিসি বাংলো, ঝুলন্ত সেতু; খাগড়াছড়ির রিছাং ঝরনা, অপু ঝরনা, দেবতা পুকুর, আলুটিলা গুহা পর্যটক-জনপ্রিয়। তাছাড়া কোন এক গ্রামে গিয়েও ভালো সময় কাটানো যাবে।

কোথায় থাকবেন: ওই দুই জেলায় থাকার জন্য হোটেল-মোটেলের অভাব নেই। সদরগুলোতে ছোট মানের থেকে মাঝারি মান পর্যন্ত হোটেল-মোটেল আছে। রুম ভাড়া থেকে ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা।

কী খাবেন: বাঙালি খাবার সবই পাওয়া যায় শহরে এবং পর্যটন কেন্দ্রগুলোতেও। তাছাড়া পাহাড়ি আদিবাসীদের খাবারের রেস্তোরাঁও আছে। ন্যায্যমূল্যে পাওয়া যাবে, খরুচে খাবারও আছে।

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন