ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ভ্রমণ

টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ- শেষ পর্ব

ভ্রমণ ডেস্ক | প্রকাশিত: ১২:৩১ পিএম, ৩১ জুলাই ২০১৮

যারা সবার সঙ্গে ভ্রমণের আনন্দটুকু ভাগাভাগি করতে চান; তারা ভ্রমণকাহিনি লিখে সবাইকে জানান। ২০১৬ সালে টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ করেছিলেন তাসলিমা খানম বীথি। বিস্তারিত জানাচ্ছেন আজ শেষ পর্বে-

আ ন ম বজলুর রশীদের ‘আমাদের দেশ’ কবিতাটি চমৎকার আবৃত্তি করছিলেন মিসেস পীর। কাঁঠাল গাছ, আম গাছ, কলা গাছ, বাঁশঝাড়, সবুজ ধানক্ষেতের মাঠ-ঘাট পেরিয়ে আমাদের গাড়ি চলছে যখন। হঠাৎ ধাক্কা! কি ব্যাপার? ওহ মেঠোপথে গর্ত থাকায় গাড়ির চাকা আটকে যায়। আমরা সবাই গাড়ি থেকে নেমে মেঠোপথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলাম; তখন চোখ যায় একজন মুক্তিযোদ্ধার বাড়ির দিকে। বাইরে থেকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ ছিমচাম আর পরিপাটি। বাড়ির সামনে গম্বুজের মতো খাড়া বিশাল বিশাল খড়ের গাদা। বেলা ১২টায় আমরা বিশ্বম্বরপুর আসি। সামনে শাহ আরফিনের মাজার। তবে শারফিন নামে পরিচিত। গাড়ির জানালার দিকে তাকাতেই গ্রামের ছোট্ট মেঠোপথ দিয়ে বই-খাতা বগলে করে হেঁটে যাচ্ছে সারিবদ্ধ কয়েকজন কিশোর-কিশোরী। অন্যদিকে কৈশোরে বেড়ে ওঠা দুরন্তপনা, শিশু-কিশোরদের গ্রাম্য পুকুরে ঝাঁপাঝাঁপি আর লাফালাফি দেখে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কথা মনে পড়ছিল। শৈশব নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘ছেলেবেলায় আমরা জানতাম না, ছেলেবেলা এত স্বপ্ন আর মাধুর্যপূর্ণ আছে। ছেলেবেলা খুবই একটা আতঙ্কজনক সময়। স্যারদের বা আম্মা-আব্বার হাত শুধু আমাদের কানের দিকে আদর আপ্যায়ন করার জন্য এগিয়ে আসতে চায়। স্কুলে মার খেতে হয়, অপমান সহ্য করতে হয়। ছোট বলে উপেক্ষা, অবহেলার মধ্যে পড়তে হয়। সুতরাং শিশুর কাছে শৈশব কিন্তু এত সুন্দর সময় নয়। শৈশব সুন্দর হয়, যখন আমরা শৈশবকে হারাতে থাকি এবং শুধু শৈশব না, যে কোন জিনিস সুন্দর হয়ে ওঠে যখন আমরা একবার হারাতে থাকি।’

তখন আমারও মনে হলো- সত্যিই তো গ্রামের এই শিশুরা জানে না, তাদের জীবনে সবচেয়ে সুন্দর সময় পার করছে। গাছে গাছে কৃষ্ণচূড়াকে দেখে মনে হচ্ছে- রক্তিম হয়ে ফুটেছে আমাদেরকে স্বাগত জানানোর জন্য। যাত্রীবাহী মোটরসাইকেল ছুটে যাচ্ছে তাদের গন্তব্যে। পীর স্যারের কাছ থেকে জানতে পারি। প্রতি বাইক ১৫০ টাকা করে ভাড়া নেয়। যাত্রীরা ইচ্ছেমতো মোটরসাইকেলে করে যে কোন স্থানে যেতে পারেন। তাহিরপুর ইউনিয়ন পরিষদে পৌঁছতে পৌনে ১টা। তখন পীর স্যার দৈনিক যুগান্তরের প্রতিনিধি আজাদ সাহেবকে কল করে বললেন আমাদের ভ্রমণে যোগ দিতে। পীর স্যারের আন্তরিকতা, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, স্নেহ আমাকে সবসময় মুগ্ধ করে। শনির হাওরের কাছে আসতেই গাইড হিসেবে মোস্তফা কামালকে গাড়িতে উঠান। তিনি অবসরপ্রাপ্ত একজন শিক্ষক। ডানপাশে শনির হাওর আর বামপাশে জাদুকাটা নদী, মধ্য দিয়ে ছুটে যাচ্ছি টাঙ্গুয়ার হাওরের দিকে। শনির হাওরের পাশ দিয়ে বৌলাও নদী বয়ে গেছে। বৌলাও নদী দেখে মিসেস পীর ও শামীমা আপা এক সাথে বলে উঠলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বীরপুরুষ’ কবিতাটি-
‘মনে কর যেন বিদেশ ঘুরে
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে
তুমি যাচ্ছ পালকি তে মা চড়ে
দরজাটুকু একটু ফাঁক করে।’

tangua

৮.
অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ১টা ২৫ মিনিটে আমাদের গাড়ি এসে থামে টাঙ্গুয়ার হাওরে, খোলা আকাশের নিচে সবুজ প্রান্তরে। আহ! চারদিকে শুধু পানি আর পানি। পানির এমন অপরূপ রূপে চোখ জুড়িয়ে যায়, মনকে উদাসী করে তোলে। আমাদের জন্য একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। টাঙ্গুয়ার হাওরের স্বচ্ছ নীল জলরাশি, সাথে সোনালি রোদে আর জলের বুক চিড়ে চলছে আমাদের ইঞ্জিন নৌকা। ইঞ্জিন নৌকার উপরে যে যার মত করে আমরা বসি। জম্পেস আড্ডায় ইঞ্জিন নৌকা চলছে। মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতি কন্যাকে দেখছি। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে ইচ্ছে করছে-
‘বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপর
একটি শিশিরবিন্দু।’

নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলাম প্রাকৃতিক সৌর্ন্দয ঘেরা সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলার মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত টাঙ্গুয়ার হাওরের মাঝে। যেখানে মেঘালয় পাহাড় থেকে ৩০টিরও বেশি ঝরনা এসে মিশেছে এই হাওরে। স্বচ্ছ টলমলে জলের নিচে দেখা যায় ঘাস। অতিথি পাখি কখনো জলকেলি, কখনো খুনসুটিতে কিংবা খাবারের সন্ধানে এক বিল থেকে অন্য বিলে, এক হাওর থেকে অন্য হাওরে গলায় প্রাণকাড়া সুর তুলে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে। এ হাওরের একটি প্রবাদ আছে- ‘নয় কুড়ি বিল, ছয় কুড়ি কান্দার টাঙ্গুয়ার হাওর।’ এ বিশাল জলভূমি টাঙ্গুয়ার হাওরে শীতের শুরু থেকে অস্ট্রেলিয়া, সাইবেরিয়াসহ বিভিন্ন শীত প্রধান দেশ থেকে হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে হাওরের পাশ্ববর্তী শনি, মাটিয়ান, কানামিয়াসহ আশপাশের হাওরে অতিথি পাখি অবস্থান নেয়। এদের মধ্যে মৌলতি হাঁস, বালিহাঁস, লেঞ্জা সরালি, পিয়ারি, কাইম, কালাকুড়া, রামকুড়া, মাছরাঙা, কানিবক, পানকৌড়িসহ অনেক পাখি খাবারের সন্ধানে এক হাওর থেকে অন্য হাওরে ডানা ঝাপটে অবাধ বিচরণ করে। আর বর্ষাকালে হাওরে পাওয়া যায় নানা প্রজাতির মাছের দেখা। নানা প্রজাতির বনজ ও জলজ প্রাণী হাওরের সৌন্দর্যকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে। বর্ষায় টাঙ্গুয়ার হাওর এক বিশাল সমুদ্রের রূপ ধারণ করে আর শীতের সময় আরো আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। তবে আমরা বর্ষাকালে না যাওয়াতে সেই সৌন্দর্য দেখা থেকে বঞ্চিত হলাম।

টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ জলাশয়। উন্মুক্ত আকাশ, মেঘালয় পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য। মাছ, বন, পাখি, জীববৈচিত্র, নির্মল বায়ু হাওরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। জলাশয়গুলো যেন ছোট ছোট সমুদ্র। সব মিলিয়ে সৌন্দর্যের এক প্রাকৃতিক রূপসী কন্যা। হাওর আর পাহাড়ি সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভূমি এ পর্যটন অঞ্চল। একবার গেলে বারবার যেতে ইচ্ছে করবে। বলতে ইচ্ছে করবে, ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা।’

হঠাৎ চোখ যায় জেলেদের দিকে। নদীর হাঁটু পানিতে স্থানীয় জেলেরা মাছ ধরছে, আর নদীর দুই পারে নুড়িবালি ছড়িয়ে রয়েছে। সূর্যের আলোতে চিকচিক করছে সেই বালু। টিলার পেছনে নদীর ওপারে দাঁড়িয়ে আছে মায়াবিনী মেঘালয়, যার আঁচলে সব সময় খেলা করে রূপের রানিরা।

৯.
আগে থেকেই দুপুরের খাবার রান্না করে রাখা হয়েছিল। ইঞ্জিন নৌকার উপরে বসেই ওয়ান টাইম প্লাস্টিক প্লেটে রোস্ট, মাছের ভর্তা ও টমেটো টক দিয়ে দুপুরে লাঞ্চ করা হয়। মাছের ভর্তাটা দারুণ ছিল। মনে হলে এখনো জিহ্বায় জল আসে। তবে খাওয়ার সময় ওয়ান টাইম প্লেটে ভাত খেতে হয়েছে সর্তকভাবে। কারণ প্লেট কিছুটা পাতলা থাকায় পরে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।

tangua

টাঙ্গুয়ার হাওরের বিলবোর্ডে গিয়ে আমাদের ইঞ্জিন নৌকাটি থামে। আমরা নেমে হিজল আর করচের সারিবদ্ধ গাছের মাঝ পথ ধরে হেঁটে যাই বিলবোর্ডের সম্মুখে। হিজল করচের দৃষ্টিনন্দন সারি হাওরকে করেছে মোহনীয়। বিলবোর্ডের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ক্যামেরার ক্লিকে হাওরের রূপের রানিকে বন্দি করি। চারদিকে সবুজের সমারোহ। চোখ যেন ফেরাতে ইচ্ছে করছে না।

১০.
গৌধূলি লগ্নে ইঞ্জিন নৌকায় উঠি আমরা। চারদিকে তাকিয়ে দেখি হাওরের গাছপালা আর কিছু মানুষ দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হঠাৎ চোখ যায় পীর স্যারের দিকে। গালে হাত দিয়ে মনোমুগ্ধ হয়ে প্রকৃতির মাঝে ডুবে আছেন তিনি। ইঞ্জিন নৌকা চলছে আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে আমাদের সেলফি আর আড্ডা। বাঁশের সাঁকো সামনে আসতেই আমাদের ইঞ্জিন নৌকাটি থেমে যায়। সবার ভেতর তখন আতঙ্ক। বশির ভাই জোরে জোরে বলতে লাগলেন, ‘ও পীর ভাই, কিতা হইলো ডাকাইতনি’। বাঁশের সাঁকোতে থাকা লোকজন বলল, ‘আপনাদের ভয়ের কোন কারণ নাই। আমরা ডাকাত না। আপনারা একটু মাথা নিচু করে বসে নৌকাটিকে নিয়ে সাঁকোর নিচ দিয়ে চলে যান।’ সেই সাঁকোটি দেখে রোটারিয়ান আনহার শিকদার হেসে বললেন, ‘আমরা এখন লন্ডনের টেমস নদীর ব্রিজের নিচে আছি।’

আমাদের চোখের সামনে দিয়ে পানকৌড়ি উড়ে যেতে দেখা যায়। গাছের আগায় তখন পানকৌড়ির ঝাঁক। অক্টোবর মাস থেকেই নাকি শুরু হয় পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনা। তখন বিলগুলো পরিণত হয় দেশীয় আর পরিযায়ী পাখিদের অভয়াশ্রমে। মাইলের পর মাইল পাখিদের ভেসে বেড়াতে দেখা যায়।

ছবির মত এসব দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছে- কোন শিল্পীর নিজ হাতে আঁকা প্রতিটি দৃশ্য। মরমী কবি হাছন রাজা ও বাউল সাধক শাহ আবদুল করিমের জেলা, স্বচ্ছ জল আর হিজল করচের হাওরের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যে আনন্দে নক্ষত্র-তাঁরার মত চিকচিক করছিল ভ্রমণকারীদের তৃষ্ণার্ত চোখ-মুখ। নৌকা যত এগিয়ে যাচ্ছে, ততই মুগ্ধ হচ্ছি আর মনে হচ্ছে- ‘এই পথ যদি শেষ না হয়, তবে কেমন হত...’

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন