বর্ষণমুখর দিনে চীনামাটির দেশে
হঠাৎ করেই বিরিশিরি একটা সফর হয়ে যাবে, সেটা কখনো কল্পনা করিনি! কিছুদিনের জন্য ক্লাস, পরীক্ষা বন্ধ। এরকম ছুটি পেয়ে ভ্রমণপিপাসু কেউ কি বাসায় বসে থাকতে পারে? বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে ইতিপূর্বে কখনো যাওয়া হয়নি। এমনকি ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েও কখনো যাওয়া হয়নি। তাই ভাবলাম, এবারের ছুটিতে এই সুযোগটা আর হাতছাড়া করা যাবে না।
সকাল থেকেই ঝড়-বৃষ্টি। তা উপেক্ষা করেই সকাল ৮টার দিকে রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে রওনা হলাম বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে। যথাসময়ে পৌঁছেও গেলাম। তখনো চীনামাটির পাহাড় দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনা হয়নি। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে দিনের বাকিটা সময় বন্ধু শাহীন, বাশির আর আমি বাইসাইকেল নিয়ে ক্যাম্পাসের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ালাম। বন্ধু শাহীন হঠাৎ প্রস্তাব করল, ‘এই সুযোগে আমরা নেত্রকোনার বিরিশিরিতে একটা সফর দিয়ে আসি।’ আমি তো এককথায় রাজি। বাশিরও রাজি হলো। আরেক বন্ধু রাজও যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করল। আর ঠেকায় কে আমাদের সফর?
পরদিন ক্যাম্পাসের কাছের স্টেশন থেকে সকাল সাড়ে ৬টায় আমরা চারজন ট্রেনে যাত্রা শুরু করলাম। সর্বশেষ স্টেশন জারিয়ায় নামতে বাধ্য হলাম। কারণ ট্রেন ওই পর্যন্তই যায়। রাস্তাঘাট খুব একটা ভালো না হওয়ায় ট্রেনে যাওয়াই সুবিধাজনক। জারিয়া স্টেশনে নেমে আমরা দুটি মোটরসাইকেল ভাড়া করলাম। প্রত্যেকটিতে দুইজন করে উঠলাম। অটো বা নৌকায়ও যাওয়া যায়। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে অবিরাম। মোটরসাইকেল ছুটে চলল দুর্গাপুর। ওখানে কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে নাস্তা করে আবার আমরা বেরিয়ে পড়লাম। সামনে সোমেশ্বরী নদী। নদীর দুইপাশে বিস্তীর্ণ বালুময় প্রান্তর, যার সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। নিজ চোখে না দেখলে বলে বোঝানো যাবে না।
ইঞ্জিনচালিত নৌকায় নদী পার হয়ে আবার মোটরসাইকেলে শুরু হলো আমাদের যাত্রা। সোজা চলে গেলাম চীনামাটির পাহাড়ে। গোলাপি রঙের পাথুরে চীনামাটির পাহাড়ের নয়নাভিরাম দৃশ্য যে কাউকে বিমোহিত করার জন্য যথেষ্ট। পাশেই আছে সাদা পানির লেক, নীল-সবুজ পানির লেক। বৃষ্টির কারণে রং কিছুটা বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। তবুও সৌন্দর্যের কমতি নেই। পাহাড়ে ওঠার লোভ কেউ সামলে রাখতে পারলাম না। টিপটিপ বৃষ্টিপাতের তোয়াক্কা না করে উঠে পড়লাম চূড়ায়। সেলফি, ফটো তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল সবাই। পর্যটক বলতে সেই সময় শুধুমাত্র আমরাই। বিরূপ আবহাওয়ার কারণে পর্যটকদের আনাগোনা কম। দু’চারজন যারা এসেছেন, তারাও বৃষ্টির কারণে আর অগ্রসর হচ্ছেন না। বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় বসে আছেন ছোট্ট কুটির বা স্থানীয় দোকানঘরে।
তারপর আমরা চললাম খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের রাণীখং চার্চের দিকে। এ অঞ্চলে বেশকিছু উপজাতিরও বসবাস আছে। চার্চ পরিদর্শন শেষে সবাই চলে গেলাম বিজয়পুর বর্ডার ক্যাম্পের উচুঁ টিলায়। অবশ্যই ক্যাম্প থেকে অনুমতি নিয়ে যেতে হবে। ওপর থেকে পাশেই নদী দেখা যাচ্ছে। নদীর পরপরই বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত। কাঁটাতারের বেড়া স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তারপর গেলাম কমলা বাগানে। ছোট একটা পাহাড় আছে, তবে কোনো গাছে কমলার দেখা পাওয়া গেল না। বাগান থেকে ফিরে আবার মোটরসাইকেলে ফিরতি পথ ধরতে হলো।
পথে হাজং মাতা শহীদ রাসিমণী স্মৃতিসৌধ ঘুরে দেখতেও ভুললাম না। গন্তব্যস্থল আবার সোমেশ্বরী নদী পার হয়ে সোজা দুর্গাপুর। ওখান থেকে একঝলক সুসং ডিগ্রী কলেজটা দেখে জারিয়া স্টেশনে ফিরতে হলো। ট্রেন আসতে আরও অনেক সময় লাগবে। এই ফাঁকে আমরা নিজেদেরকে একটু গুছিয়ে নিয়ে লাঞ্চ করে নিলাম। যদিও অনেক দেরী হয়ে গেছে। বাকি সময়টা নদীর পাড়, স্টেশন ও আশেপাশের এলাকা ঘুরে দেখলাম। তারপর ট্রেন এলে ফিরতি পথ ধরতে হলো। যাত্রী সংখ্যা বেশি হওয়ায় ট্রেনে সিট পেতেও বেশ বেগ পেতে হয়।
ক্যাম্পাসে ফিরতে আমাদের বেশ রাত হয়ে গেল। এভাবেই অল্প সময়ের মধ্যে বিরিশিরি ট্যুরটা সম্পন্ন হলো। ভয় ছিল এই বুঝি মোটরসাইকেলের চাকা পিছলে পড়ে যাই! তবে সে রকম কোনো সমস্যা হয়নি। বর্ষণমুখর এমন প্রতিকূল আবহাওয়ায় পুরোটা দিন বৃষ্টিতে ভিজে পাহাড়ি এলাকা চষে বেড়িয়ে আমাদের চমৎকার একটি ট্যুর সম্পন্ন হলো। স্মৃতির পাতায় বিরিশিরি সফরের এই দিনটি জীবনের অন্যতম স্মরণীয় একটি দিন হয়ে থাকবে।
এসইউ/পিআর