কক্সবাজার-সেন্টমার্টিনে আরআরএফের চমক
‘সকাল ৮ টায় শাহজালাল বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ টার্মিনালে সবাই উপস্থিত থাকবেন। ওখানেই নাস্তার ব্যবস্থা থাকবে। সবাই যার যার মতো করে নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হবেন। কোনোভাবেই দেরি করবেন না।’ গত ২৫ জানুয়ারি দুপুরে রিলিজিয়াস রিপোর্টার্স ফোরাম (আরআরএফ) সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ ভুইয়া এভাবেই কক্সবাজার সেন্টমার্টিন পিকনিকে গমনেচ্ছু সদস্যদের উদ্দেশে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। সেদিন ছিল পিকনিক কমিটির শেষ বৈঠক। তখনও পিকনিক কমিটির আহ্বায়ক মিয়া হোসেন মিটিংয়ে আসতে পারেননি। সাধারণ সম্পাদক উবায়দুল্লাহ বাদল জানালেন, আরআরএফ সদস্যদের জন্য পিকনিকে ‘চমক’ দিতে শেষ মুহূর্তের কেনাকাটায় ব্যস্ত তিনি।
সকাল সাড়ে ৯টার ফ্লাইট ধরতে সভাপতির নির্দেশনা অনুযায়ী প্রায় সবাই সময়মতো বিমানবন্দরে উপস্থিত। সাতসকালে নাস্তা কিনে উপস্থিত কামরুজ্জামান বাবলু। বিমানবন্দর লাউঞ্জে বিভিন্ন প্যাকেটে মজাদার কেক, বনরুটি, সন্দেশ ও কমলা প্যাকেটজাত শুরু হতেই পিকনিকের আমেজ শুরু হয়ে যায়। সবাই যখন নাস্তা খেতে ব্যস্ত; তখন সভাপতি ‘চমক লাগেজ’ লাগেজ বেল্টে দেওয়ায় ব্যস্ত।
হঠাৎ খবর এলো প্রথম আলোর সেলিম জাহিদ আসছেন না। একটু পরে শুরু হলো পিকনিক কমিটির সদস্য সচিব কালের কণ্ঠের মোশতাক আহমেদকে খোঁজাখুঁজি। সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ একাধিক সদস্য মোশতাককে মোবাইলে যোগাযোগ করে পেলেন না। এদিকে ফ্লাইট ছাড়ার সময়ও এগিয়ে আসছে। কিছুক্ষণ পর আবার মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে মোশতাকের স্ত্রী জানালেন, মোশতাক ঘুমাচ্ছেন। এখনও ঘুমাচ্ছেন শুনে সবাই হতবাক। এ সময় তার স্ত্রী জানালেন, মোশতাক যেতে পারছেন না। দু’জন সদস্য যাবেন না শুনে সবার মন খারাপ হলো।
একটু পর মিয়া হোসেন জানালেন, ফ্লাইট ডিলে আছে। এ কথা শুনে শুরুতেই অনেকের মন খারাপ হলো। লাউঞ্জের মাইক থেকে ঘোষণা আসলো, কক্সবাজারের আবহাওয়া ভালো নয়। তাই কিছুক্ষণ বিলম্ব হবে। একটু পরেই দেখা গেল, বেসরকারি একটি এয়ারলাইন্স তাদের যাত্রী নিয়ে কক্সবাজারেই রওনা হয়ে যাচ্ছে। যাত্রীদের অনেকেই মন্তব্য করলেন, এজন্যই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে ‘বেঈমান এয়ারলাইন্স’ বলা হয়। যাক ৪৫ মিনিট বিলম্বে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হয়। প্লেন টেক অফ হতেই আরআরএফ সদস্যদের দু’একজন বলে উঠলেন, যাক, শেষপর্যন্ত যাত্রা হলো।
পিকনিক প্রস্তুতিকালে নেতাদের মধ্যে সামান্য ভুল বোঝাবুঝিতে অনেকেই শেষপর্যন্ত পিকনিক না-ও হতে পারে এমনটা ভেবেছিলেন। কিন্তু ভুল বোঝাবুঝির দ্রুত অবসান হয়। সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও পিকনিক কমিটির সদস্য সচিবের আন্তরিকতায় শেষপর্যন্ত তিন দিনের পিকনিকে ঢাকা থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে কক্সবাজারে রওনা হয় ২০ সদস্যের মধ্যে ১৭ সদস্যের দল। দু’জন সমস্যার কারণে ও একজন পরের দিন রওয়ানা হবে বলায় ১৭ সদস্যের পিকনিক সফর শুরু হয়।
মাত্র ৩৫-৪০ মিনিটের মধ্যে কক্সবাজার পৌঁছানোর পর বাইরে হোটেল সী-গাল কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় অপেক্ষমান গাড়িতে দ্রুত হোটেলে পৌঁছে ফ্রেস হয়ে জুমার নামাজ পড়ার জন্য প্রস্তুতি শুরু। নামাজ পড়ে দুপুরের খাবার খেয়ে দলনেতা আগামী দেড়দিন কী করা হবে সে সম্পর্কে ব্রিফ করলেন। প্রথমেই গন্তব্য হিমছড়ি ও ইনানী বিচ। তবে কোন স্পটে আগে গেলে ভালো হবে, তা নিয়ে নানা জনের নানা মত আসতে থাকে। শুধু তাই নয়, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নাকি জিপ গাড়ি ভাড়া করা হবে, তা নিয়ে একেকজনের একেক মন্তব্য। শেষপর্যন্ত জিপ গাড়িতে করে রওনা হলাম।
কে সিটে বসবে আর কে গাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে বসবে তা নিয়ে রীতিমতো ধস্তাধস্তি। জিপ গাড়ি কয়েক মিনিট পথ চলতেই মেরিন ড্রাইভের রাস্তায় পৌঁছা মাত্র যারা আসনে বসেছিল তারা কেন বসেছে তা নিয়ে আফসোস করতে থাকে। একপাশে বিশাল সমুদ্র আরেক পাশে উঁচু পাহাড় উপস্থিত সদস্যদের মাঝে আনন্দের দোলা দেয়। পাহাড় আর সমুদ্র দেখতে দেখতে পিচঢালা পথে গাড়ি দ্রুত ইনানী বিচ অভিমুখে ছুটে চলে। এরই মাঝে সুর বেসুরো গান ও নাচ চলতে থাকে। এ সময় ড্রাইভারের পাশে বসা কাওসার আজম নাচ-গানে অংশগ্রহণ করতে না পারলেও ঘাড় ফিরিয়ে বারবার দেখছিল।
ইনানী বিচে পৌঁছে দ্রুত সমুদ্রের পানিতে পা ভিজিয়ে ফটোসেশন। সবার অভিযোগ- আরআরএফ সভাপতি কেন নাচে গানে আনন্দে অংশগ্রহণ করছেন না। সদস্যদের অনুরোধে তিনিও ঠাট্টাচ্ছলে কোমর দোলালেন। দ্রুত তাগাদা দিয়ে সেখান থেকে হিমছড়ির উদ্দেশে রওনা হয়ে পৌঁছতে পৌঁছতে সূর্য প্রায় অস্তমিত। সময় স্বল্পতায় হিমছড়ির ঝরনা কিংবা উঁচু পাহাড়ের ওপর থেকে সমুদ্র দর্শন না হলেও ‘দুধের সাধ ঘোলে মেটাতে’ সাগর পাড়ে এলোমেলো হাঁটাহাঁটি শেষে আবার হোটেলের উদ্দেশ্যে যাত্রা। যাওয়ার পথে সবাই মহানন্দে গান গাইলেও ফেরার পথে শীতে সবাই চুপচাপ।
হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে খানিকটা বিশ্রাম। পরিকল্পনা অনুসারে ডিনার সেরে রাত আনুমানিক ১০টার দিকে দলবেঁধে সমুদ্রপাড়ে ঘুরতে যাওয়া। সাগরপাড়ে চেয়ারে শুয়ে নানা ধরনের দুষ্টুমি। এই যেমন একজন জানতে চাইলো- আচ্ছা, সমুদ্রপথে সোজা গেলে কোন দেশে যাওয়া যাবে? কেউ বলে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া আবার কেউ বলে ওঠে অস্ট্রেলিয়া। যে যার মতো করে যুক্তি দিতে থাকে। পাশেই কয়েক তরুণ হেড়ে গলায় গান গাইছে। তাই শুনে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সোহাগ দুষ্টুমি করে বলে ওঠে, এই তোমরা এতো ভালো গাও, তোমরা কি টিচার রেখে গান শেখো। তরুণরা না বলতেই চেয়ার থেকে পারলে লাফিয়ে উঠে সোহাগ বলে, কী, টিচার রেখে গান না শিখেই এতো সুন্দর গলা। বিশেষ করে ওই ছেলেটার গলা মারাত্মক। এবার তরুণদের একজন বলে, আঙ্কেল কোন ছেলেটা? সোহাগ অন্ধকারে ওদের কাউকে দেখতে না পেলেও বলে, ওই যে, ওই পাশের ছেলেটা। এবার ওদের একজন কাছে এগিয়ে বলে, আঙ্কেল, ভালো গান গাইতে হলে কী করতে হবে? সোহাগ গম্ভীর হয়ে কয়েক সেকেন্ড পর পর চার বার বলে, চর্চা, চর্চা, চর্চা এবং চর্চা। এই শুনে আরআরএফ সদস্যরা মুচকি হাসলেও তরুণরা তাকে গানের বিরাট সমঝদার মনে করে।
একটু পর আট-নয় বছর বয়সী একটি মেয়ে গান শোনাতে এগিয়ে আসে। প্রতি গান ১০ টাকাতেই রাজি হয়ে যায়। কিন্তু সে গান গায় আগের দিনে টেপ রেকর্ডারে ফার্স্ট ফরোয়ার্ডে গান চালালে যেমন দ্রুত শেষ হয়ে যায় সে রকম। এক মিনিটেই গান শেষ। এ নিয়ে নিউনেশনের কামরুজ্জামান বাবলু তাকে আস্তে গান গাওয়ার সবক দিলেও কে শোনে কার কথা? হাসি-ঠাট্টায় কখন যে রাত ১২টা বেজে গেছে, তা কেউ টের পায়নি। দ্রুত হোটেলে ফেরার তাগিদ দিয়ে সভাপতি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন, ভোর ছয়টায় সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে গাড়ি ছেড়ে যাবে। অতএব আপাতত রুমে ফিরে সবার ঘুমানো উচিত। সারা দিনের ক্লান্তিতে হোটেলে ফিরে ঘুম। ভোর ৫টায় রুমে রুমে কলিং বেল বাজিয়ে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় ৬টায় গাড়ি ছাড়বে।
ঠিক ৬টায় হোটেলের সামনে থেকে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে যাত্রা শুরু হয়। সদস্য সচিব মিয়া হোসেন আগের দিনই হোটেল কর্তৃপক্ষকে সকালের নাস্তা প্যাকেট করে দিতে বলে রেখেছিলেন। তাই বাসে উঠেই হালকা নাস্তা সেরে নেন সবাই। মেরিন ড্রাইভ সড়ক দিয়ে গাড়ি টেফনাফের উদ্দেশে ছুটে চলে। কাকডাকা ভোরে শান্ত সমুদ্র দেখে সবার মন জুড়িয়ে যায়।
টেকনাফে পৌঁছে ফ্রেস হয়ে কেয়ারি সিন্দাবাদ জাহাজে চড়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হয়। যাত্রা শুরুর কিছুক্ষণ পর থেকেই গাংচিল পিছু পিছু ছুটতে থাকে। জাহাজের প্রায় সব যাত্রী রুটি ও বিস্কুট ছুড়ে দিলে গাংচিলের দল ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। নীল সমুদ্রের পানি আর ওপরে সাদা গাংচিল দেখে সবার হৃদয় জুড়িয়ে যায়। এরই মধ্যে সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ ভুইয়া, সাধারণ সম্পাদক উবায়দুল্লাহ বাদল, কামরুজ্জামান বাবলু, সোহাগ, কাওসার আজম, মিয়া হোসেন, রাকিব, নাইমুদ্দিন, শামসুল আরেফিন, খালিদ সাইফুল্লাহ, শাহ আলম নুর, সলিমুল্লাহ মেজবাহ, মহসিনুল করিম লেবু, মানিক মিয়াজি, কামাল মোশারেফসহ সবাই সুরে-বেসুরে গানের আসর বসালে- তা দেখে তরুণ চিকিৎসকদের একটি দলও পাশে গান গাইতে থাকে। এভাবে হাসি-আনন্দে সেন্টমার্টিন দ্বীপে জাহাজ পৌঁছে যায়। জেটিতে জাহাজ ভেড়ার আগেই বলা হয়, এখন দুপুর ১২টা বাজে। ঠিক ৩টায় জাহাজ ছাড়বে।
পরিকল্পনা অনুসারে শুরু হয় সেন্টমার্টিন ঘুরে দেখা। প্রথমেই রিকশা ভ্যানে সোজা প্রখ্যাত লেখক হুমায়ূন আহমেদের ‘সমুদ্র বিলাস’ দর্শন। এরই ফাঁকে কয়েকজন শুঁটকি কিনতে ছোটেন। কেউ আবার দ্রুতপায়ে সমুদ্র পাড়ে হেঁটে চলেন। সেন্টমার্টিনের স্বচ্ছ নীল পানিতে কেউ কেউ নেমে গা ভেজান। সময় স্বল্পতার কারণে মনমতো সমুদ্রে ডুবাতে না পেরে অনেকেই আফসোস নিয়ে লাঞ্চ করতে ছোটেন।
এরই মধ্যে আরআরএফের কয়েকজন হোটেলে প্রবেশ করে দ্রুত খাবার দেওয়ার তাগাদা দিতে থাকেন। প্যাকেজের আওতায় থাকায় গাইড সবাইকে একসঙ্গে না এলে খাবার দিতে অস্বীকৃতি জানালে গাইডের সঙ্গে কিছুটা তর্ক-বিতর্ক চলে। এরই মাঝে সবাই উপস্থিত হলে মজা করে খাবার খেয়ে জাহাজে ভো-দৌড়। ফেরার পথেও জাহাজের সঙ্গে সঙ্গে গাংচিলের ছুটে চলার দৃশ্য দেখতে দেখতে টেকনাফে ফিরে আসা। গাড়িতে উঠে ক্লান্ত দেহে সবাই চুপচাপ বসে থাকে। যাওয়ার সময় মেরিন ড্রাইভ দিয়ে আসলেও ফেরার সময় তা আর সম্ভব হয় না। অনেকটা পথ ঘুরে রাত প্রায় সাড়ে ৯টায় হোটেলে ফেরা।
কিছুটা সময় হোটেলের বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে আবার ডিনারের জন্য হোটেলে যেতে হয়। খাওয়া শেষে যে যার মতো করে কয়েক গ্রুপে ভাগ হয়ে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজনের জন্য কেনাকাটা শুরু করেন। ডিনারের সময় বলে দেওয়া হয়, সকাল বেলা শেষবারের মতো সমুদ্র দর্শনে যাওয়া হবে। সবাই ‘হা হা’ বললেও সকালে ক্লান্ত দেহে অনেকেই ঘুম থেকে উঠতে পারেননি। তবে সোহাগ, বাবলু, রাকিব ও শাহআলমসহ কয়েকজন সাতসকালে শেষবারের মতো সমুদ্রে গা ভেজায়। ফিরে এসে নাস্তা সেরে শেষ ব্রিফিংয়ে ডাকা হয়। সবার হাতে আরআরএফ চমকের ব্যাগ তুলে দেওয়া হয়। তবে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়, এই ব্যাগের কোড নম্বর শাহজালাল বিমানবন্দরে গিয়েই বলা হবে। যেহেতু স্ত্রী-সন্তানরা আসতে পারেননি, তাই তারাই চমকের বাক্স খুলবেন। এ কথায় সবাই সানন্দে রাজি হন। শেষ ব্রিফিংয়ে আরআরএফ সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও পিকনিক কমিটির আহ্বায়ক মিয়া হোসেন সামগ্রিক প্রস্তুতির শুরু থেকে শেষপর্যন্ত তুলে ধরে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
এবার ফেরার পালা। কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে মাত্র ৪০ মিনিটেই ঢাকায় পৌঁছে যায় বিমান। পিকনিকে রওয়ানা হওয়ার আগে আরআরএফ সদস্যদের অনেকের মাঝে জড়তা থাকলেও দু’দিনের সফরে সবাই এক পরিবারের সদস্য হয়ে যান। অনেক মজার স্মৃতি নিয়ে ফিরে আসেন তারা। বাসায় ফিরে ব্যাগ খুলতেই উপহার দেখে পরিবারের সদস্যরা চমকিত হন। চমকের মধ্য দিয়েই ইতি ঘটে আরআরএফের পিকনিকের।
এসইউ/পিআর/এমএস