পায়ে হেঁটে কলকাতা থেকে ঢাকা : চতুর্দশ পর্ব
আজ আমার পদযাত্রার শেষদিন। আজকের পথটাও বেশ কম। তাই একটু বেলা করেই হাঁটা শুরু করেছি। গতকালও মুন্সীগঞ্জ জেলাতেই হেঁটেছি। এখনো এ জেলাতেই আছি। আজকের অনেকটা পথও হাঁটবো এ জেলাতেই। মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রাচীন বাংলার গৌরবময় স্থান বিক্রমপুরের একটি অংশ ছিলো। মুন্সীগঞ্জ সে সময়ে ছিল একটি গ্রাম, যা মোঘল শাসনামলে ইদ্রাকপুর নামে ছিলো। অনেকে মনে করেন- মোঘল শাসনামলে ইদ্রাকপুর গ্রামে মুন্সী হায়দার হোসেন নামে এক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি মোঘল শাসকদের দ্বারা ফৌজদার নিযুক্ত হয়েছিলেন। তার নামেই ইদ্রাকপুরের নাম হয় মুন্সীগঞ্জ। আবার অনেকে মনে করেন- চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময়ে রামপালের কাজী কসবা গ্রামের মুন্সী এনায়েত আলীর জমিদারভুক্ত হওয়ার পর তার মুন্সী নাম থেকে ইদ্রাকপুরের নাম মুন্সীগঞ্জ হয়। ১৯৪৫ সালে বৃটিশ ভারতের প্রশাসনিক সুবিধার্থে মুন্সীগঞ্জ থানা ও মহকুমা হিসেবে উন্নীত করা হয়। ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ মুন্সীগঞ্জ জেলায় রূপান্তরিত হয়।
১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জ শত্রুমুক্ত হয়। এ জেলা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও প্রসিদ্ধ। ২৯ মার্চ স্থানীয় ছাত্র-জনতা সরকারি অস্ত্রাগার থেকে বিপুল অস্ত্র লুট করে এবং পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মে মাসে হিংস্র পাকবাহিনী গজারিয়ায় অভিযান চালিয়ে প্রায় চার শতাধিক নিরীহ গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করে এবং কেওয়ারে হামলা করে কিছুসংখ্যক তরুণকে হত্যা করে। এরআগে মার্চ মাসে পাকবাহিনী নারায়ণগঞ্জে আক্রমণ চালালে মুন্সীগঞ্জের তরুণরা নারায়ণগঞ্জবাসীর সঙ্গে মিলিতভাবে আক্রমণ প্রতিহত করে। জুলাই মাসে ধলাগাঁও এলাকায় শত শত যুবককে রিক্রুট করে ট্রেনিং দেওয়া হয় এবং তারা বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেন। গোয়ালিমান্দ্রায় মুক্তিযোদ্ধারা ৬ রাজাকারকে হত্যা করে এবং পরে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে এক সম্মুখ লড়াইয়ে প্রায় ৩৫ পাকসেনা নিহত হয়।
এই জেলা কালে কালে জন্ম দিয়েছে অনেক কৃতি সন্তান। এখানে জন্মেছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, সাহিত্যিক সৈয়দ এমদাদ আলী, ইংলিশ চ্যানেল বিজয়ী ব্রজেন দাস, বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, অতীশ দীপঙ্করের মতো জগদ্বিখ্যাত ব্যক্তি। এমনকি বাবা আদম শহীদের মত ইসলামি ব্যক্তিত্বের পদচারণা এ জেলাকে করেছে উর্বর।
আজকের সকালটা একটু অন্যরকম মনে হচ্ছে। কেন এমন মনে হচ্ছে তা বুঝতে পারছি না। আজ শেষদিন বলেই কিনা? যা হোক, কেমন লাগছে সেটা না বুঝতে পারলেও হবে। আর বেশি দূরে না, চলে এসেছি প্রায় স্বপ্নের সীমানায়। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার পথ। তারপরেই শেষ হবে আমার দীর্ঘ পথহাঁটা। প্রায় আড়াই কিলোমিটার হাঁটার পর চলে এলাম বাঘৈর মোড়ে। এখান থেকে সোজা চলে গেছে বুড়িগঙ্গা ১ নম্বর ব্রিজ পাড় হয়ে পোস্তগোলা। আর এই মোড় থেকে বামে চলে গেছে বুড়িগঙ্গা ২ নম্বর ব্রিজ হয়ে নয়াবাজার। আমি বুড়িগঙ্গা ২ নম্বর ব্রিজ হয়ে ঢাকায় ঢুকবো। এ পথেই পা বাড়ালাম। কদমতলী বাসস্ট্যান্ডে এসে দুপুরের খাবার খেলাম। খেয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম।
ছোটবেলায় পড়েছি ‘ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত’। আমি আগে বুড়িগঙ্গা নদী দেখিনি। আজই প্রথম দেখেছি এবং এর উপরেই দাঁড়িয়ে আছে। বুড়িগঙ্গা ২ নম্বর ব্রিজ পাড় হয়ে চলে এলাম নয়াবাজার। ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় এখন হাঁটছি। আমার এই পদযাত্রা শেষ করার কথা ছিলো জাতীয় শহীদ মিনারে। পরে সিদ্ধান্ত হয় শেষ হবে শাহবাগে। তাই আমি গুলিস্তান হয়ে সচিবালয়ের সামনে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সামনে আসি।
একুশে বইমেলা চলছে। বাংলা একাডেমির সামনে দিয়ে দোয়েল চত্ত্বর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি হয়ে শাহবাগ পর্যন্ত পুরো রাস্তাটা মানুষে ভরপুর। আমি এ পথে অসংখ্যবার হেঁটেছি। তবে তখন কেউ আমার দিকে তাকিয়ে থাকেনি। কৌতূহল নিয়ে দেখেনি। কারণ আমি তখন আর সবার মতোই পথচারী ছিলাম। কিন্তু আজ আমি সাধারণ পথচারী হয়ে হাঁটছি না। তাই হয়তো মানুষগুলো আমাকে অবাক হয়ে দেখছে। ওই তো দেখা যাচ্ছে শাহবাগ। গণজাগরণ মঞ্চের হাজারো মানুষের জমায়েত।
এসইউ/আইআই