পায়ে হেঁটে কলকাতা থেকে ঢাকা : ত্রয়োদশ পর্ব
আজ ঊনিশে ফেব্রুয়ারি। প্রায় চব্বিশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে। সকালের খাবার অপু ভাইয়ের বাসাতেই হলো। সকাল আটটার দিকে হাঁটা শুরু করলাম। কিছুদূর এগিয়ে দিয়ে অপু ভাই মাওয়া ফিরে গেলেন। এখন আমি একা হাঁটছি। প্রথম যাত্রাবিরতি করলাম শ্রীনগর এসে। প্রায় নয় কিলোমিটার পথ পেছনে ফেলে এসেছি।
১৯৮৩ সালে ১২ আগস্ট ১৪টি ইউনিয়ন নিয়ে শ্রীনগর উপজেলা গঠিত। যা বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ জেলার অন্তর্গত। শ্রীনগররের প্রাচীন নাম রায়েসবর। নবাব মীর কাসিম কর্তৃক নিযুক্ত বাংলা বিহার উড়িষ্যার গভর্নর লালা কীর্তিনারায়ণ বসু রায়েসবরের শ্রীবৃদ্ধি করে এর নামকরণ করেন শ্রীনগর। তিনি শ্রীনগর তথা বিক্রমপুরে একটি মনোরম প্রাসাদ নির্মাণ করেন, যা বর্তমানে শ্রীনগর পাইলট স্কুল ভবন হিসেবে পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেপ্টেম্বর মাসে শ্রীনগরের শিবরামপুর খালে পাকবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ লড়াই হয়। সেই লড়াইয়ে পাকবাহিনীর ৩টি গানবোট ডুবে যায় এবং বেশসংখ্যক পাকসেনা নিহত হয়। এ উপজেলা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও সম্মৃদ্ধ।
শ্রীনগর রাঢ়ীখালে স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর বাড়ি। এখানে একটি জাদুঘরও রয়েছে। যেখানে বসুর বেশকিছু নথিপত্র সংরক্ষণ করা আছে। কমপ্লেক্সের পাশেই ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুল ও ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত কলেজ। প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা হয়েছে তার নামেই ‘স্যার জগদীশচন্দ্র বসু ইনস্টিটিউশন ও কলেজ’। এ উর্বর মাটিতে জন্ম হয়েছে আরো অনেক খ্যাতিমানের। তাদের মধ্যে অন্যতম বিশিষ্ট ভাষাবিদ, লেখক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ, সাবেক রাষ্ট্রপতি ও রাজনীতিবিদ অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী।
হাসারা বাজার হয়ে প্রায় নয় কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নিমতলা বাজারে এসে পৌঁছলাম। এখানেই দুপুরের খাবারের বিরতি। ঢাকা থেকে এসে পদাতিকের এক সদস্য নিমতলা থেকে আমার সঙ্গে যুক্ত হলো। সে বিকেল পর্যন্ত আমার সঙ্গে হাঁটবে। তারপর সে ঢাকায় ফিরে যাবে। ধলেশ্বরী-২ ব্রিজ পাড় হয়ে এসে এখন দাঁড়িয়ে আছি ধলেশ্বরী-১ ব্রিজের উপরে। ধলেশ্বরী বর্তমানে যমুনার শাখা, কিন্তু প্রাচীন কালে এটি সম্ভবত পদ্মা নদীর মূলধারা ছিল। ১৬০০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে পদ্মার গতিপথ পাল্টে যায়। ধারণা করা হয়, কোনো এক সময়ে পদ্মার মূলধারাটি রামপুর-বোয়ালিয়া এলাকা ও চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, পরে ধলেশ্বরী ও বুড়িগঙ্গা নদীর মাধ্যমে মেঘনায় গিয়ে পড়তো। ১৮শ’ শতকে পদ্মার নিম্ন প্রবাহটি ছিল আরো দক্ষিণে। ১৯ শতকের মাঝামাঝি মূল প্রবাহটি ধলেশ্বরী থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়, যা বর্তমানে পদ্মার মূল গতিপথ।
ভাওয়ার ভিটি বাসস্ট্যান্ড এসে শফিক ভাইকে ফোন করি। তিনি অপু ভাইয়ের বন্ধু। আজ তিনিই আমার থাকার ব্যবস্থা করেছেন। তিনি কালাকান্দি যেতে বললেন। আমার জন্য সেখানে অপেক্ষা করছেন। প্রায় দুই কিলোমিটার পথ পাড় হয়ে কালাকান্দি এসে পৌঁছাই। এখানে শফিক ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো। তিনিও পত্রিকার স্থানীয় প্রতিবেদক। কালাকান্দি থেকে বেশ ভেতরে একটি প্রত্যন্ত গ্রামে তার বাড়ি। চারপাশে কৃষিজমি, মাঝখানে তার বাড়ি। দেখে মনে হচ্ছে- ছোট্ট একটি দ্বীপে আছি। এখানে শফিক ও তার স্ত্রী থাকেন। তাদের সঙ্গে আত্মীয় হয়ে উঠতে সময় লাগেনি। তারা খুবই মিশুক। তাদের আতিথেয়তা কখনো ভোলার মতো নয়।
এসইউ/পিআর