চিনামাটির দেশে একদিন
উত্তরে ভারতের মেঘালয়ের গারো পাহাড়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলা কংস নদ আর সোমেশ্বরী নদীর কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা অপরূপ শান্ত ছোট জনপদ দূর্গাপুর, বিজয়পুর এবং বিরিশিরি। এখানে রয়েছে দিগন্তজোড়া সবুজ গারো পাহাড়, লাল, বেগুনি রঙের চিনামাটির পাহাড়, অদ্ভুত সুন্দর নীল পানির লেক যা নিমিষেই চোখ জুড়িয়ে দেয়। বিরিশিরির পাশ দিয়ে দিগন্ত হারানো স্বচ্ছ পানির সোমেশ্বরী নদী যেন হার মানায় সব সৌন্দর্যকে। বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর (গারো, হাজং, কোচ, ডালু, বানাই প্রভৃতি) জীবনযাত্রার নানা নিদর্শনে ভরপুর এ অঞ্চল।
বন্ধু বাবুর মাথায় বিরিশিরি যাওয়ার প্লানটা এলো। তাই বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের একদল ভ্রমণপিপাসু বেরিয়ে পড়লাম বিরিশিরির উদ্দেশ্যে। দিনটি ছিল মঙ্গলবার। ছয়টায় ট্রেন তাই খুব ভোরে রওনা দিলাম ক্যাম্পাস থেকে ময়মনসিংহ স্টেশনের উদ্দেশ্যে। রায়হান, মিলন, তাহমিদ, সন্ধ্যা, আবিদ, মীম, ফাইয়াজ, তন্বী, মৌ, রিফা, ইসতিয়াক, নিপা, কেয়া, জুহি, রিতা, সায়েম, খালিদ, কেয়া, নাইম, রফিক, বাবু, নিঝুম, জহুরা, নুসাইফা, জ্যোতিসহ মোট ২৮ জন। স্টেশনে পৌঁছে উঠলাম নেত্রকোনার জারিয়াগামী ট্রেনে।
আধাঘণ্টা দেরী হলেও যখন ট্রেন ছাড়ল; তখন কেউ গান, নাচ আবার কেউ সেলফি তোলায় ব্যস্ত। হৈ-হুল্লোড়ে মেতে উঠল ট্রেনের বগি। ঈশ্বরগঞ্জ, জালশুকা, মোহনগঞ্জ, পূর্বধলাসহ ৭টি স্টেশন পার হয়ে সকাল ৯টার দিকে পৌঁছালাম জারিয়া স্টেশনে।
স্টেশন বাজারে নাস্তা সেরে বিজয়পুরের উদ্দেশ্যে উঠে পড়লাম মাহেন্দ্র গাড়িতে। আঁকাবাঁকা ভঙ্গুর রাস্তায় অনেক ঝাকুনি খেয়ে বিজয়পুরের পথে প্রথমে থামলাম বিরিশিরি আদিবাসী কালচারাল একাডেমিতে। শান্ত-স্নিগ্ধ, সবুজে ঢাকা চারপাশ। এ অঞ্চলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনযাত্রার নানা নিদর্শন, সাংস্কৃতিক পরিচয় সংরক্ষিত আছে। আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রস্থল বলা যেতে পারে একাডেমিটিকে।
সেখান থেকে পৌঁছলাম বিরিশিরি সোমেশ্বরী নদীর ঘাটে। নৌকার জন্য অপেক্ষা। এরমধ্যেই সবাই একে অন্যকে পানি ছোড়াছুড়ি। অবশেষে নৌকা এলে সবাই উঠে পড়লাম নৌকায়। নৌকায় ওঠার পর সে এক অন্য দৃশ্য। পাহাড়ের কোলে হারিয়ে যাওয়া চিরযৌবনা সোমেশ্বরীর সঙ্গে নিজেরও যেন হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল।
নদী পার হয়ে আমরা ইজিবাইকে করে সোজা চলে গেলাম বিজয়পুর বিজিবি ক্যাম্পে। বিজিবি ক্যাম্পের পাশের ছোট গাড়ো পাহাড়টিতে ওঠার জন্য কারো যেন আর তর সইছে না। কমলার পাহাড় নামের এ পাহাড়ে উঠে দেখলাম প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। প্রকৃতি তার ঝুলি উজাড় করে দিয়েছে গারো পাহাড় সাজাতে। চারপাশে যেন সবুজের সাম্রাজ্য। পাহাড়ের অসমতল উঁচু-নিচু টিলার মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে ঝরনা। দুই পাহাড়ের মাঝে সমতল ভূমি। তার মাঝে সবুজ ফসলের ক্ষেত। কোথাও সবুজ টিলার ওপর ছোট কুঁড়েঘর। আর সবুজ গাছের ফাঁকে নীল আকাশ। পাহাড়, নদী, শাল-গজারি আর অপূর্ব সুন্দর প্রকৃতি মিলিয়ে এ যেন অপার ভূস্বর্গ।
পাহাড় দেখতে দেখতে কখন দুপুর গড়িয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। দুর্গাপুর চৌরাস্তায় সবাই দুপুরের খাবার সেরে রওনা দিলাম বিরিশিরির মূল আকর্ষণ চিনামাটির পাহাড় ও সবুজ পানির লেকের দিকে। অবশেষে পৌঁছলাম সেই কাঙ্ক্ষিত চিনামাটির পাহাড়ের দেশে, যার বুক চিড়ে চলে গেছে অবাক সুন্দর নীলচে-সবুজ পানির হ্রদ। শরতে নীলাকাশ আর সাদা মাটির পটভূমি লেকগুলো জলের রংকে যেন আরও গাঢ় করে তুলেছে।
সবুজে ঘেরা পাহাড় আর সবুজ পানির লেক ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু যেতে হবেই। রাত নয়টার আগেই আবার ক্যাম্পাসে ফিরতে হবে। তাই রওনা দিলাম স্টেশনের উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যা সাতটার ট্রেন ছাড়লো নয়টায়। অবশেষে এগারোটায় ফিরলাম ক্যাম্পাসে।
মো. শাহীন সরদার/এসইউ/জেআইএম