ভিডিও EN
  1. Home/
  2. তথ্যপ্রযুক্তি

আইটি প্রশিক্ষণে অদক্ষ কর্মীদের রেমিট্যান্সের উৎসে রূপান্তর সম্ভব

তথ্যপ্রযুক্তি ডেস্ক | প্রকাশিত: ১২:৫৯ পিএম, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তানজিল আহমেদ
বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার পরিমাণ প্রায় ১৭ কোটি। এর মোট শিক্ষিত জনসংখ্যার সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে, সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের শিক্ষার হার প্রায় ৭৫ শতাংশের কাছাকাছি। এটি দেশের বর্তমানে সাক্ষরতার হার, যারা শুধু প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার ৯৮ শতাংশের বেশি, কিন্তু মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার হার সেই হিসেবে কিছুটা কম।

বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ শিক্ষার প্রাপ্তির হার তুলনামূলকভাবে অনেক কম, তবে এটি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের উন্নতির কারণে। বর্তমানে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের হার প্রায় ১৮- ২০ শতাংশ। বাংলাদেশ সরকার এবং বিভিন্ন সংগঠন শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য নানা পরিকল্পনা করে যাচ্ছেন।

শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার তুলনামূলকভাবে বেশি। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট বেকারত্বের হার প্রায় ৫-৬ শতাংশ। উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার প্রায় ৩০-৩৫ শতাংশ। কম শিক্ষিত বা অর্ধ শিক্ষিত জনগণ উচ্চ শিক্ষিতদের থেকে বেশি প্রতিষ্ঠিত, আর এই কারণে সমাজে বেশ কিছু সামাজিক অসংগতি ও দেখা যায়।

বাংলাদেশের শিক্ষিত জনসংখ্যার দক্ষতা কেন তৈরি হয়না?
বাংলাদেশে শিক্ষিত জনসংখ্যার দক্ষতা তৈরির অভাব একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। আমরা যদিও দেশের শিক্ষার হার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করি, কিন্তু শিক্ষিত জনগণের দক্ষতার অভাব কর্মসংস্থানে সমস্যা সৃষ্টি করছে। একদিকে যেমন শিক্ষিত যুবকরা উচ্চ শিক্ষা অর্জন করছে, অন্যদিকে দক্ষতার অভাবে তাদের বাজারে মানানসই চাকরি খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।

বর্তমান শিক্ষার সিলেবাস অনেক সময় বাস্তব জীবনের দক্ষতার সঙ্গে মিলছে না, যার ফলে শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় কর্মদক্ষতা অর্জন করতে পারছেন না। প্রযুক্তি এবং চাকরির বাজারের দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারার কারণে অনেক শিক্ষিত ব্যক্তি চাকরি বা কাজ পাচ্ছেন না। পড়ালেখার পাশাপাশি চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি প্রশিক্ষণ ও ইন্টার্নশিপের সুযোগ সীমিত হওয়ায় কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা উন্নয়নের পথে সেটি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সবাই কেন গতানুগতিক সরকারি বা বেসরকারি চাকরি করতে হবে?
আমাদের দেশে একটি সাধারণ ধারণা রয়েছে যে, পড়াশোনা সম্পন্ন করার পর সরকারি বা বেসরকারি চাকরি করতে হবে। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী, যাদের মধ্যে ব্যবসা, মানবিক বা বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করে, তাদের লক্ষ্য থাকে সরকারি চাকরি পাওয়ার। এর ফলে, চাকরির বাজারে সবাই একে অপরের প্রতিযোগী হয়ে যায়। যারা একটু মেধাবী, তারা হয়তো কাঙ্ক্ষিত চাকরি পেয়ে যায়, কিন্তু যারা কম মেধাবী বা সমমানের, তাদের জন্য আসন সংকটের কারণে চাকরি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

এতে তাদের ৬-৭ বছরের শিক্ষাজীবন বৃথা যায়। এই পরিস্থিতি তাদের মানসিকভাবে ভেঙে দেয় বলে আমার মনে হয়, এছাড়াও পারিবারিক ও সামাজিক অসন্তোষ তৈরি করে, যা একজন প্রাপ্তবয়স্ক তরুণের জন্য লজ্জাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।

কোথায় কাজ করলে লাভ বেশি, দেশে নাকি বিদেশে?
যদি একজন উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত হন, তাহলে তার মাসিক বেতন প্রায় ২৫ হাজার টাকা থেকে ৩৫ হাজার টাকা হতে পারে, যা ডলারে ২৩০ ডলার থেকে ৩৩০ ডলার বা তার আশপাশে। বেসরকারি ক্ষেত্রে, এই বেতন পরিসীমা হয়তো ৪০ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা হতে পারে, যা ডলারে ৩৮০ ডলার থেকে ৫৭০ ডলার।

তবে যদি একজন তরুণ ৬-৭ বছর সময় পড়াশোনার পাশাপাশি আইটি-এর মতো একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্র, যেমন গ্রাফিক ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং, ওয়েব ডিজাইন বা ওয়েব ডেভেলপমেন্ট শেখেন এবং কাজ শুরু করেন, তাহলে তার গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর মাসিক আয় ২ লাখ টাকা থেকে ৩ লাখ টাকা হতে পারে, যা ডলারে প্রায় ২ হাজার থেকে ৩ হাজার ডলার। এতে যেমন কর্মসংস্থান বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হয়, তেমনি দেশে করমুক্ত বিদেশি রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ে। এতে ব্যক্তি এবং দেশ উভয়ই লাভবান হয়। দেশের রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পেলে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নও ঘটে।

বিদেশে কাজ করতে কী কী স্কিল থাকা উচিৎ?
বাংলাদেশে থেকে বিদেশে কাজ করতে মাত্র ৩ টি বেসিক স্কিল থাকলেই একজন শিক্ষিত তরুণের পক্ষে বিদেশে খুব সহজে কাজ করা সম্ভব। প্রথম ডুয়েল ল্যাঙ্গুয়েজ, দ্বিতীয়ত সফটস্কিল এবং তৃতীয়ত একটা নির্দিষ্ট ক্যাটাগরিতে কাজের দক্ষতা।

ডুয়েল ল্যাঙ্গুয়েজ: ডুয়েল ল্যাঙ্গুয়েজ হলো, মাতৃভাষার পাশাপাশি একটি অতিরিক্ত ভাষায় দক্ষতা অর্জন। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ বাংলা এবং ইংরেজিতে দক্ষ হয়, তাহলে সে বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশে সহজেই কাজ করতে পারবে। যারা মাদ্রাসা শিক্ষায় অভ্যস্ত, তারা বাংলা এবং আরবি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করলে মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ দেশে কাজ করতে সক্ষম হবে।

সফটস্কিল: সফটস্কিল হচ্ছে কাজ করার জন্য কমিউনিকেশনের দক্ষতা যেমন কীভাবে ই-মেইল করতে হয়, কীভাবে বিদেশীদের সম্বোধন করতে হয়, কীভাবে সামাজিক মিডিয়া ব্যবহার করতে হয়, এই রকম আরও অনেক বিষয় আছে।

নির্দিষ্ট ক্যাটাগরিতে কাজের দক্ষতা: যেমন কেউ যদি ভালো অ্যাকাউন্টিং, অথবা ভালো গ্রাফিক ডিজাইন, ভিডিও এডিটিং, ভালো আর্কিটেকচার ডিজাইন এর কাজ জানেন, অথবা ভালো মিউজিক করতে পারে, ভালো প্রোগ্রামিং বা ডিজাইন করতে পারে, এই রকম কয়েক হাজার জব এর কেটেগরি আছে, সেটা হয়ত আমি বলে ও শেষ করতে পারবও না এই লেখায়।

এই স্কিলগুলোর মধ্যে যে কোনো একটি বা একাধিক দক্ষতা অর্জন করলে বিদেশে কাজ করার সুযোগ অনেক বেড়ে যাবে বলে আমি মনে করি।

বাংলাদেশের কোন ধরনের বিদেশি রেমিট্যান্সে সরকারের লাভ বেশি?
বর্তমানে বাংলাদেশের বিদেশি রেমিট্যান্সের বড় অংশ গার্মেন্টস সেক্টর থেকে আসে। যেখানে গার্মেন্টস সেক্টর থেকে বছরে ৪০-৪৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসে, সেখানে আইটি সেক্টর থেকে আসে মাত্র ০.৫-১.০ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া প্রবাসীদের পাঠানো বড় একটি অংশ দেশের অর্থনীতিতে যোগ হয়।

যদি আইটি সেক্টর থেকে ৭-১০ বিলিয়ন ডলার আয় করা হয়, তবে এটি গার্মেন্টস সেক্টরের সমান আয় থেকে বেশি লাভজনক হতে পারে। কারণ ৪০-৪৫ বিলিয়ন ডলার আয় করতে গার্মেন্টস সেক্টরের যে পরিমাণ কর্মী এবং কাঁচামাল প্রয়োজন, তার তুলনায় আইটি সেক্টর একই পরিমাণ আয় করতে মাত্র ১০-১৫ শতাংশ কর্মী দিয়ে সক্ষম হতে পারে। আইটি সেক্টরের জন্য শ্রমিক অসন্তোষ, এলসি (লেনদেনের কন্ট্রোল), কাঁচামাল কেনা বা কাঁচামালের উপর নির্ভর করতে হয় না। এর কাঁচামাল হচ্ছে কেবল কিছু দক্ষ ও নিবেদিত জনশক্তি এবং প্রশিক্ষণ।

বাংলাদেশে বিডা (বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি) এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে আইটি সেক্টরে প্রায় সাড়ে সাত লাখ পেশাজীবী কর্মরত আছেন, যেখানে গার্মেন্টস সেক্টরে কর্মীর সংখ্যা প্রায় চল্লিশ লাখ। উচ্চ শিক্ষিত লোকজনের তুলনায় আইটি পেশাজীবী এবং ফ্রিল্যান্সারদের সংখ্যা অনেক কম। যদি সরকার ২০ লাখ উচ্চ শিক্ষিত পেশাজীবীকে বাজারের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ের উপর ৬ থেকে ১২ মাসের প্রশিক্ষণ প্রদান করে, তবে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ৭-১০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বিদেশি রেমিট্যান্স অর্জন সম্ভব হতে পারে।

এই লক্ষ্যে, সরকারেরপক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় থেকেই শিক্ষার্থীদের একটি অতিরিক্ত ভাষা শিক্ষা কোর্স এবং আইটি ভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। এতে করে পড়ালেখার পাশাপাশি নিজের কাজের ব্যবস্থা করার যথেষ্ট সময় এবং সুযোগ পাবে। তাহলে আগামীর সম্ভাবনাময় বাংলাদেশে তরুণরা আরও উন্নত সুযোগের দিকে অগ্রসর হতে সক্ষম হবে।

লেখক: আইটি স্পেশালিষ্ট, সিইও সেবাঘর, ডিরেক্টর বিডিটাস্ক লিমিটেড

কেএসকে/জেআইএম

আরও পড়ুন