ভিডিও EN
  1. Home/
  2. তথ্যপ্রযুক্তি

৪ কোটি টাকার স্কলারশিপ

যুক্তরাষ্ট্রে পড়ার জন্য মনোয়ারের নির্ঘুম কেটেছে মাসের পর মাস

আনিসুল ইসলাম নাঈম | প্রকাশিত: ০৪:৩৬ পিএম, ১০ মে ২০২৪

মোহতাসিম মনোয়ার পড়াশোনা করছেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণিতে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রাঙ্কলিন অ্যান্ড মার্শাল কলেজে স্নাতক প্রোগ্রামে স্কলারশিপ পেয়েছেন। পড়বেন কম্পিউটার সায়েন্স বিষয়ে। আগামী ২৪ আগস্ট থেকে তার ক্লাস শুরু হবে।

মনোয়ার কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার উত্তর রামপুর গ্রামের সন্তান। ছেলেবেলা থেকেই বেশ চঞ্চল ও কৌতূহলী। সাত বছর বয়সে তারা কুমিল্লা শহরে পাড়ি জমান। ৪র্থ শ্রেণি পর্যন্ত ওয়াইডব্লিউসিএ স্কুলে পড়াশোনার পর ভর্তি হন কুমিল্লা জিলা স্কুলে। সেই থেকে তার জীবনের বাঁক ঘুরতে শুরু করে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক রাশেদা বেগম বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমে তাকে উৎসাহিত করতেন। বিভিন্ন ড্রয়িং কম্পিটিশনে অংশগ্রহণ করে পুরস্কার পেতেন। স্কুলের চারুকলার সাইদুজ্জামান এবং চারুকলার গুরু কাজলও তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছিলেন।

ছোট থেকে প্রোগ্রামিং
ছেলেবেলায় বাবার ল্যাপটপ মনোয়ারের কাছে জাদুর যন্ত্র মনে হতো। ল্যাপটপের মাউস নাড়ালে বা ক্লিক করে স্ক্রিনে চলমান পরিবর্তন দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতেন। একদিন ল্যাপটপে গেমস খেলতে বসেন। তখন তার বাবা মজার ছলে বলেছিলেন, ‘গেমস না খেলে গেমস বানিয়ে দেখাতে পারবে?’ কথাটি তার মনে গেঁথে যায়। ইন্টারনেটে ঘাটাঘাটি করে জানতে পারলেন গেমস বানাতে হলে প্রয়োজন প্রোগ্রামিংয়ের দক্ষতা! সেই থেকে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের আদ্যোপান্ত জানতে শুরু করেন। প্রোগ্রামিংয়ের বেসিক শেখার পর বন্ধুদের নিয়ে সমাজের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে প্রজেক্ট তৈরি করেন। সেসব প্রজেক্ট বিভিন্ন জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে- মাইক্রোসফট ফর স্টার্টআপস, বিডিঅ্যাপস ন্যাশনাল অ্যাপ হ্যাকাথন, মুজিব ১০০ আইডিয়া, হার্ভার্ড ক্রিমসন ইয়ুথ এন্টারপ্রেনারশিপ সোসাইটি ইত্যাদিতে অবদান রাখে।

পান শেখ রাসেল পদক
২০২৩ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘ক্ষুদে প্রোগ্রামার’ খাতে অবদানের জন্য মনোয়ার ‘শেখ রাসেল পদক’ পান। এটি বাংলাদেশের তরুণদের দেওয়া সর্বোচ্চ সম্মাননাগুলোর মধ্যে একটি। প্রতি বছর এই খাতে একজন তরুণকে পদক দেওয়া হয়। তিনি সমাজে অবদানের জন্য গ্লোব্যাল টিন হিরো অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছিলেন। এই অর্জনে তার বন্ধু ওয়াসি, কামরুল, অভি ও সিয়ামের অবদান ছিল অনেক।

যেভাবে শুরু
মনোয়ার স্কুলে পড়াবস্থায় জীববিজ্ঞান এবং রসায়ন বইয়ের প্রতি ছিল অনীহা। তখন অনেকেই বলতেন, প্রোগ্রামার হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে আগে বুয়েটে চান্স পেতে হবে। গণিতে ভালো থাকতে হবে। আবার এসব সাবজেক্টে নাম্বার কম এলে বুয়েটে চান্স মিলবে না। তিনি তখন ভাবতেন, প্রোগ্রামার হতে জীববিজ্ঞান বা রসায়নে দক্ষতা লাগবে কেন! এসব ভাবনার মাঝে তিনি হতাশায় পড়ে যান। এরমধ্যে তার পরিচিত কয়েকজন বড় ভাই বিদেশে পড়াশোনা নিয়ে কথা বলছিলেন। তাদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে বিদেশে পড়াশোনা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করেন। জানতে পারলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আবেদন প্রক্রিয়া বাংলাদেশের থেকে একদম আলাদা। এ ছাড়া মনোয়ার যেসব সহশিক্ষা কার্যক্রমের সাথে যুক্ত ছিলেন; যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাডমিশনে তা কাজে লাগবে।

আরও পড়ুন

বৃত্তি পাওয়ার গল্প
মনোয়ার যুক্তরাষ্ট্রের পড়াশোনার আদ্যোপান্ত জানতে জানতে ‘বাংলাদেশ বিয়ন্ড বর্ডারস’ নামক ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত হন। গ্রুপ থেকে খুটিনাটি অনেক তথ্য জানতে পারেন। আবেদনের ৬ থেকে ৭ মাস আগে থেকে প্রায় ৪০টির ওপর রচনা লেখেন। লেটার অব রিকোমেন্ডেশন সংগ্রহ করেন। যুক্তরাষ্ট্রে আবেদনের জন্য কমন অ্যাপে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সাজান এবং নিজের পোর্টফোলিও তৈরি করেন। পাশাপাশি কলেজ রিসার্চ এবং মধ্যরাতে ইন্টারভিউ দিয়ে মাসের পর মাস নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেন। শুরুতে অল্প কয়েকটা জায়গা থেকে অফার এলেও তার চাহিদার বাইরে ছিল। অফার লেটার থেকে রিজেকশন লেটারের পরিমাণই ছিল বেশি। কারণ তার স্যাট অ্যাপশনাল ছিল। আর ডুলিঙ্গ স্কোরও কম ছিল! তারপরও হাল ছাড়েননি। অবশেষে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ফ্রাঙ্কলিন অ্যান্ড মার্শাল কলেজ থেকে অফার লেটার পান। মনোয়ার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে চান্স পাওয়ার অনুভূতি জানান, ‘সেদিন ভোর ৬টায়। আমি আব্বু-আম্মুর সাথে রেজাল্টের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। ওই মুহূর্তে আমার মনে ভয় এবং উৎসাহ—দুটিই কাজ করছিল। ল্যাপটপে হাত রীতিমতো কাঁপছিল! এরপর ওয়েবসাইট রিফ্রেশ করতেই স্কিনে ভেসে উঠল ‘ওয়েলকাম টু দ্য ফ্রাঙ্কলিন অ্যান্ড মার্শাল কলেজ, মনোয়ার!’ পুরো অফার লেটার না পড়েই আম্মুকে জড়িয়ে ধরলাম। সবার মুখে হাসির কারণ হলাম।’

বাধা পেরিয়ে সাফল্য
মনোয়ারের কাজ করতে হতো রাত-বিরাতে। এজন্য তাকে প্রায়ই বাবা-মায়ের বকাবকি হজম করতে হতো। তবে একসময় তাদের বোঝাতে পারেন, রাত জাগার প্রকৃত কারণ। প্রস্তুতির প্রথমদিকে কিছু সহপাঠী ও শিক্ষকদের কাছে কটু কথা শুনেছেন। তারা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলতেন, ‘বড় স্বপ্ন দেখা তোমাকে মানায় না। একদিন আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে যাবে। কলেজের পর পরই বিদেশ যাওয়া যায় না। এইচএসসি না দিয়েই! বুয়েটে ফোকাস করো, সেটা বড়।’ তাকে প্রতিনিয়ত এ ধরনের কথার সাথে যুদ্ধ করে যেতে হয়েছে। এরপরেও মনোয়ার থমকে যাননি। নিজের ওপর বিশ্বাসই ছিল তার পথচলার চাবিকাঠি। তার এ যাত্রায় প্রত্যয়, শুভ, ফারহান, সাবাবা; বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। এ ছাড়া অনেক ভালো বন্ধুও ছিলেন মেন্টর হিসেবে।

যেভাবে আবেদন
যুক্তরাষ্ট্রে আবেদনের জন্য বেশিরভাগ মানুষ ‘কমন অ্যাপ’ নামক প্লাটফর্ম ব্যবহার করেন। এখানে পছন্দমতো বেছে ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় আবেদনের ওপর বিবেচনা করে স্কলারশিপ ও ফিন্যান্সিয়াল এইড দিয়ে থাকে। তবে কমন অ্যাপ ছাড়াও স্কোইর (Scoir) প্লাটফর্মে আবেদন করা যায়। আবার কিছু বিশ্ববিদ্যালয়য়ের নিজস্ব অ্যাপ্লিকেশন পোর্টাল থাকে। সেখানে আবেদন করা যায়। স্নাতকে আবেদনের জন্য নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট, সহশিক্ষা কার্যক্রমের বর্ণনা, অর্জন, স্যাট পরীক্ষার স্কোর, আইইএলটিএস বা ডুলিঙ্গের স্কোর, রচনা, লেটার অব রিকোমেন্ডেশন, স্কুল রিপোর্ট এবং ফিন্যান্সিয়াল কিছু কাগজপত্র প্রয়োজন।

চার কোটির বৃত্তি
ফ্রাঙ্কলিন অ্যান্ড মার্শাল কলেজ যুক্তরাষ্ট্রের ফাইন্যাস্ট লিবারেল আর্টস কলেজগুলোর মধ্যে একটি। মনোয়ার এই কলেজ থেকে মেরিট স্কলারশিপ, লিডারশিপ স্কলারশিপ ও এইড মিলিয়ে প্রায় ৪ কোটি টাকার স্কলারশিপ পেয়েছেন। পড়াশোনাকালীন স্কলারশিপে তার টিউশন ফি, থাকা-খাওয়া ইত্যাদি খরচ বহন করবে। তবে বিমান ভাড়া তাকে বহন করতে হবে। পড়ালেখার পাশাপাশি অন-ক্যাম্পাস চাকরি এবং ইন্টার্নশিপের সুযোগ রয়েছে। লিডারশিপ দক্ষতার জন্য ফিউচার ডিপ্লোম্যাট স্কলারশিপে তাকে ভবিষ্যতের জন্য যোগ্য লিডার হিসেবে তৈরি করবে।

যুক্তরাষ্ট্রে স্নাতক পড়তে
নতুনদের উদ্দেশ্যে মনোয়ারের পরামর্শ, ‘ইচ্ছা এবং অধ্যবসায় থাকলে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। আমেরিকায় পড়াশোনা করতে প্রথমেই ইউটিউব, গুগল এবং ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ থেকে স্বচ্ছ ধারণা নিতে হবে। যারা বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমের সাথে যুক্ত আছেন, তাদের জন্য এই জার্নিটা খানিকটা সহজ হয়ে যাবে। আমেরিকার ইউনিভার্সিটিগুলো পৃথিবীর মেধাবী শিক্ষার্থীকে স্কলারশিপ দিয়ে থাকে। স্যাট পরীক্ষা; একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে কেউ আবেদন করার আগে এই পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত। পাশাপাশি ইংরেজিতে কথা বলা এবং ইংলিশ ভোকাব্যুলারি শেখাটাও জরুরি।’

এসইউ/এএসএম

আরও পড়ুন