ভিডিও EN
  1. Home/
  2. তথ্যপ্রযুক্তি

উইকিলিকস এবং একজন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ

জান্নাতুল ফেরদৌস অনন্যা | প্রকাশিত: ০৪:৫৭ পিএম, ০৩ জানুয়ারি ২০২৩

‘কেউ বলে তুমি সজন, কেউ বলে তুমি শয়তান’ ভ্যানহ্যালসিং মুভির এই সংলাপটা বাস্তবিক অর্থেই যার জন্য প্রযোজ্য তিনি উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান পল অ্যাসাঞ্জ। যিনি ছিলেন একজন অস্ট্রেলিয়ান কম্পিউটার প্রোগ্রামার এবং মানবাধিকার কর্মী।

‘ওয়ার্ল্ড সাইবার ওরিয়র’ নামে খ্যাত জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ছোটোবেলা থেকেই অদম্য মেধাবী এবং অনুসন্ধিৎসু মনের অধিকারী ছিলেন। এর জন্য অবশ্য মাত্র ২০ বছর বয়সে অর্থাৎ ১৯৯১ সালে কম্পিউটার হ্যাকিং সংক্রান্ত কারণে সাজাপ্রাপ্তও হয়েছিলেন তিনি। তবে সে যাত্রায় তার বয়স কম থাকায় সাজার পরিমাণ কমে যায় এবং সামান্য কিছু জরিমানা গুনতে হয় তাকে।

এর ঠিক ১৫ বছর পর, ৪ অক্টোবর, সাল ২০০৬। জুলিয়ন অ্যাসাঞ্জ প্রতিষ্ঠা করেন একটা মিডিয়া অর্গানাইজেশন এবং ওয়েবসাইট উইকিলিকস। কিন্তু জানেন কি, জুলিয়ান অ্যাসেঞ্জ কার মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়ে উইকিলিকস প্রতিষ্ঠা করেন? তিনি আর কেউ নন, ড্যানিয়েল এলসবার্গ।

১৯৭১ সালে ড্যালিয়েল এলসবার্গের ভিয়েতনাম যুদ্ধের ওপর প্রকাশিত ডকুমেন্ট ‘পেন্টাগন পেপার্স’ ই অনুপ্রেরণা যোগায় জুলিয়ান অ্যাসেঞ্জকে উইকিলিকসের মতো একটা প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে। তাই উইকিলিকস সম্পর্কে জানার আগে চলুন এক পলক জেনে নেওয়া যাক ড্যানিয়েল এলসবার্গ এবং পেন্টাগন পেপার্সের বিষয়ে।

১৯৩১ সালের ৭ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করা ড্যানিয়েল এলসবার্গ কর্মজীবনের প্রথমদিকে র্যান্ড করপোরেশন এবং পরে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন সামরিক বিশ্লেষক হিসেবে। এসব দায়িত্ব পালনের সময় তিনি খুব কাছ থেকে ভিয়েতনাম যুদ্ধ পর্যবেক্ষণের সুযোগ পান। তখন তিনি উপলব্ধি করতে পারেন আমেরিকার সরকার কিভাবে সত্য গোপন রেখে জনগণের কাছে মিথ্যা তথ্য প্রচার করেছে বছরের পর বছর।

ড্যানিয়েল এলসবার্গ অনুধাবন করেন এসব তথ্য সাধারণ মার্কিন নাগরিকদের জানানো উচিৎ। আর এই টপ সিক্রেট, ক্লাসিফাইড নথিগুলো বিভিন্ন গণমাধ্যমের সহায়তায় একে একে তিনি প্রকাশ করতে থাকেন পেন্টাগন পেপার্স নামে।

১৯৭১ সালের ১৩ জুন। নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয় পেন্টাগন পেপার্স। এটা এমন এক ডকুমেন্ট যা তৎকালীন মার্কিন প্রশাসনকে কাঁপিয়ে দিয়ে জনসম্মুখে উন্মোচন করেছিল তাদের কালো মুখোশ। আবার এই পেন্টাগন পেপার্সই থামিয়ে দিয়েছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতো একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধকে।

পরে পেন্টাগন পেপার্স ওয়াশিংটন পোস্টেও পর্যায়ক্রমে ছাপা হতে থাকে। এ ডকুমেন্ট থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, মার্কিন সৈন্যরা যারা বেঘোরে মারা পড়ছিলো ভিয়েতনাম যুদ্ধে তাদের গড় বয়স ছিল মাত্র ২২ বছর। অথচ শুধু তাজা প্রাণগুলো ঝরে পড়া ছাড়া এই যুদ্ধে মার্কিন সৈন্যদের জেতার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না।

কিন্তু মার্কিন প্রশাসন ভিয়েতনাম যুদ্ধের যাবতীয় সত্য এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি সাধারণ মার্কিন নাগরিকদের থেকে গোপন রাখে। তাদের থেকে যুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যে। যাই হোক, সে সময় পেন্টাগন পেপার্সকে যেমন মার্কিন সাধারণ নাগরিকেরা শ্রদ্ধাভরে সাধুবাদ জানিয়েছিল, তেমনই মার্কিন প্রশাসন এই ডকুমেন্টসগুলো ফাঁস করার দায়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নামে মামলার আশ্রয় নেয়। তবে তারা নিজেরাই সেই মামলায় পরাজিত হয় আর জয় হয় গণমাধ্যমের স্বাধীনতার।

চলুন ফিরে যাওয়া যাক শুরুর সংলাপটাতে। কেনই বা কিছু মানুষের কাছে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ সজন আবার কিছু মানুষের কাছে শয়তান বা বিপদজনক ব্যক্তি? বিষয়টা খোলাসা করতে নজর দিতে হবে উইকিলিকসের গত বছরগুলোতে ঘটে যাওয়া কর্মকাণ্ডগুলোর দিকে।

বলা হয়ে থাকে, জন্মলগ্ন থেকে উইকিলকস অসংখ্য ক্লাসিফাইড ডকুমেন্টস ফাঁস করেছে। ক্লাসিফাইড ডকুমেন্টস বলতে বোঝানো হয়েছে সেসব ডকুমেন্টসগুলোকে যেখানে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল তথ্যাদি সংরক্ষিত থাকে। সাধারণত এসব ডকুমেন্টসগুলোকে জনসাধারণের কাছ থেকে রাষ্ট্র সর্বাত্মক নিরাপত্তার সঙ্গে গোপন রাখতে চায়। উইকিলিকসের তথ্য ফাঁসের তালিকায় জাতীয় নিরাপত্তা এবং যুদ্ধ সংক্রান্ত ইস্যুগুলো তো বটেই, বাদ যায়নি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির রমরমা কেচ্ছাও।

ড্যানিয়েল এলসবার্গের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠা করেন সাধারণ মানুষের কাছে জটিল, গুরুত্বপূর্ণ ও গোপন নথি প্রকাশ করার তাগিদে। প্রতিষ্ঠাকালীন বছরই অর্থাৎ ২০০৬ সালের ডিসেম্বরেই প্রকাশিত হয় উইকিলিকসের প্রথম ডকুমেন্ট, যেখানে দেখা যায় সোমালিয়ান এক বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নেতা সেদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের গুপ্তহত্যা করতে ভাড়া করে আনা সৈন্যদের উৎসাহ দিচ্ছে।

প্রথমদিকের ঘটনাগুলোতে আলোচনায় না আসতে পারলেও উইকিলিকস আলোড়ন তোলে মার্কিন প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়ক ক্লাসিফাইড নথিগুলোকে জনসম্মুখে আনে। সে সময় উইকিলিকস এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে তিরষ্কার করে বলেছিলেন ‘অ্যাসেঞ্জ, দুনিয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনক জীবিত ব্যক্তি’।

এখন আসি উইকিলিকসের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফাঁসের ঘটনায়। ২০১০ সালে সাবেক মার্কিন সামরিক গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষক চেলসি ম্যানিংয়ের সহায়তায়, উইকিলিকস ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধের অর্ধ লাখের মতো ডকুমেন্টস প্রকাশ করে। সে বছরের ৫ এপ্রিল উইকিলিকসের প্রকাশিত ২০০৭ সালে ধারণ করা ইরাক যুদ্ধের একটা ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যায় কিভাবে মার্কিন সামরিক হেলিকপ্টার থেকে নির্বিচারে ইরাকের বাগদাদে বেসামরিক মানুষের ওপর গুলি ছোঁড়া হচ্ছে।

এমনকি সেই ভিডিওতে শোনা যায় কেউ একজন নির্দেশ দিচ্ছেন ‘সবাইকে গুলি করো’ বলে। নির্দেশনা পেয়ে তৎক্ষণাৎ গুলি ছোঁড়া হয় হেলিকপ্টার থেকে এবং এতে আহত হন বেশ ক’জন বেসামরিক মানুষ। একটি ভ্যান ঘটনাস্থলের কাছাকাছি আহতদের সেবা দানের উদ্দেশ্যে আসলে সেই ভ্যানেও গুলি করা হয়। এই হামলায় রয়টার্সের ফটোগ্রাফার নামির নুর এলদিন, তার সহযোগীসহ কমপক্ষে ৯ জন প্রাণ হারান।

তাছাড়া সেই বছরই উইকিলিকস আমেরিকার অগণিত উল্লেখযোগ্য ও গোপন ডকুমেন্টস ফাঁস করে চেলসি ম্যানিংয়ের সাহায্যে। এসব তথ্যগুলো আমেরিকার সরকার প্রধানেরা সাধারণ মানুষের থেকে গোপন করে গেছেন। যেমন আফগানিস্তান যুদ্ধে মার্কিন সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বেসামরিক আফগান মানুষ হত্যা করেছে এবং সেসব ঘটনাগুলো সবসময় জনসাধারণের দৃষ্টির অগোচরেই রাখা হয়েছে।

আবার উইকিলিকসের একটা ডকুমেন্ট থেকে জানা যায় যে ইরাক যুদ্ধের সময় ৬৬ হাজার বেসামরিক মানুষকে নির্বিচারে মেরে ফেলেছে মার্কিন সৈন্যরা। সেই ডকুমেন্টে আরও দেখানো হয় সাধারণ কয়েদিদের ওপর ইরাকি পুলিশদের নিষ্ঠুর অত্যাচারের চিত্র।

২০০৯ সালে ফাঁস হওয়া অন্য ডকুমেন্টস থেকে পাওয়া যায় নাইন ইলেভেনের সময় হামলার শিকার হওয়া ব্যক্তিদের আত্মীয়-স্বজনদের ৬ লাখের মতো বার্তা। সেখানে আরও পাওয়া যায় আমেরিকান সরকারি দপ্তরের নানা প্রতিক্রিয়া এমনকি জর্জ বুশের গমনপথ পরিবর্তন সংক্রান্ত বার্তাও।

এদিকে নভেম্বর ২০১০ থেকে সেপ্টেম্বর ২০১১ এর মধ্যে মার্কিন কূটনৈতিকদের ১৯৬৬ সাল থেকে ২০১০ এর ফেব্রুয়ারি অবধি আদান প্রদান করা আড়াই লাখের বেশি গোপন তথ্য ফাঁস করে উইকিলিকস। সেখান থেকে জানা যায়, আমেরিকা ইয়েমেনে গোপনে ড্রোন হামলা চালিয়েছে। সেখানে এ তথ্যও পাওয়া যায় যে, ইরানে হামলা চালাতে সৌদি রাজপরিবার আমেরিকাকে চাপ প্রয়োগ করেছিলো।

প্রাপ্ত নথিগুলোতে ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বে থাকা রাশিয়াকে একটা ভার্চুয়াল মাফিয়া রাষ্ট্র হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এসব নথিতে আরও অন্তর্ভুক্ত ছিল আমেরিকা জাতিসংঘের প্রতিনিধি ও কর্তাব্যক্তিদের বায়োগ্রাফিক ও বায়োমেট্রিক তথ্যাদি অর্থাৎ আঙুলের ছাপ, আইরিস স্ক্যান, ও ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করতে চেয়েছিল।

২০১৬ সালের ২২ জুলাই উইকিলিকস আমেরিকার আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে ২০ হাজারের মতো ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল পার্টির ইমেইল ফাঁস করে। পরে ৭ অক্টোবর, ডেমক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের নির্বাচনি প্রচারণা ম্যানেজার জন পডেস্টার মেইল অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে তার আদান প্রদান করা প্রায় ২০০০ ইমেইল প্রকাশ করা হয়।

যেখানে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক দল, হিলারি ক্লিনটনের প্রতিদ্বন্দ্বী বার্নিক স্যান্ডেরসের থেকে হিলারি ক্লিনটনকেই সমর্থন দিচ্ছেন। এমনকি জন পডেস্টার এক মেইল বার্তায় বার্নিক স্যান্ডেরসকে নির্বোধ বলে অভিহিত করেন। আবার সেসব ডকুমেন্ট থেকে পাওয়া তথ্যমতে, নির্বাচনের আগে টিভিতে দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে যে বিতর্ক হয়, সেখানে হিলারি ক্লিনটনকে এক সিএনএনের সাংবাদিক প্রশ্ন সম্পর্কে আগেই অবগত করেন বলে জানা যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই বিতর্কটিকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হয়। যাই হোক, এসব ঘটনা ফাঁসের জন্য হিলারি ক্লিনটন অভিযোগ করে বলেন নির্বাচনের একদম কাছাকাছি সময়ে এসে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে হেয় করছেন। তবে শুধু ডেমোক্রেটিক দলেরই নয়, উইকিলিকস সে সময় রিপাবলিকান প্রার্থী সারাহ প্যালিনের ইমেইল অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি ফাঁস করে।

২০০৮ সালে উইকিলিকস ব্রিটিশ ন্যাশনাল পার্টির ১৩০০০ এর বেশি সংখ্যক সদস্যের নাম, তাদের কন্টাক্ট ইনফরমেশন ও ঠিকানা ফাঁস করে যাদের নির্বাচনী ইস্তেহার ছিল মুসলিম দেশগুলো থেকে ইমিগ্রেশন নিষিদ্ধ করা। আবার সনি পিকচার্সের ১ লাখ ৭০ হাজারের বেশি মেইলস এবং ২০ হাজারের বেশি ডকুমেন্টস প্রকাশ করে উইকিলিকস ২০১৫ সালে।

যেখানে দেখা যায় ‘আমেরিকান হ্যাসল’ সিনেমায় এমি অ্যাডামস ও জেনিফার লোপেজকে তাদের পুরুষ সহকর্মীর চেয়ে কম পারিশ্রমিক দেয়া হয়। এমনকি সনি পিকচার্সের এক সিনেমা করতে অস্বীকৃতি জানানোয় পরিচালকরা লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওকে অপমান করছেন এ রকম তথ্যও পাওয়া যায় সেসব নথিতে।

যাই হোক, বিশ্বমোড়লদের কাছে খলনায়ক হলেও জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মানবাধিকার রক্ষা বিষয়ক সংস্থা ও এ সংশ্লিষ্ট নানা সংঘের কাছে আদর্শতুল্য। বিশ্ব রাজনীতিতে যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ ও দুর্লভ বিষয়গুলো সামনে এনে শক্তিধর দেশগুলোর সাম্রাজ্যবাদী ও দ্বিচারীরূপ বিশ্বদরবারে উপস্থাপনের জন্য সর্বদা তিনি নির্ভীক ও প্রশংসার দাবিদার।

এমআরএম/এএসএম