ডুয়েটের মামুন যেভাবে হলেন মেটার ইঞ্জিনিয়ার
আবদুল্লাহ আল মামুনের স্বপ্ন ছিল বুয়েটে (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) পড়ে ইঞ্জিনিয়ার (প্রকৌশলী) হওয়ার। কিন্তু শারীরিক নানা সমস্যার কারণে সেই স্বপ্ন অধরা থেকে যায়। তবে মামুন হাল ছাড়েননি। তার পথচলায় নানা বাধা এলেও তিনি সামনে এগিয়ে চলেছেন। পড়েছেন ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ডুয়েট)।
সম্প্রতি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দিয়েছেন ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা ইনকরপোরেশনে। তার মেটায় চাকরি, নতুনদের পরামর্শ ও ভবিষ্যৎ ভাবনা সম্পর্কে জানিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
জাগো নিউজ: প্রথমে শৈশবের গল্প ও বেড়ে ওঠা সম্পর্কে বলুন—
আবদুল্লাহ আল মামুন: আমার শৈশবের অর্ধেকটা কেটে যায় অ্যাজমা আর বাতজ্বরের সঙ্গে যুদ্ধ করে। বাবার চাকরির সুবাদে আমার শৈশব কাটে রাঙ্গামাটি জেলার বরকল উপজেলায়। সেখানেই আমার প্রথম স্কুলজীবন শুরু। পরে আব্বু বদলি হয়ে উত্তরবঙ্গে চলে আসেন। তখন থেকে আমাদের ঠিকানা বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলায়। শৈশবে আমি অনেকটা ডানপিটে স্বভাবের ছিলাম। বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা, বর্ষায় মাছ ধরা, স্কুল ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখা—কোনোটাই বাদ যায়নি। আর পড়াশোনায় মধ্যম মানের ছাত্র ছিলাম।
জাগো নিউজ: কখন থেকে সফটওয়্যার ও প্রোগ্রামিংয়ের প্রতি মনোযোগ দিলেন?
আবদুল্লাহ আল মামুন: বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই আমি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মনোযোগ দিই। তখন থেকে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট বা ওই সময়ের যে টেকনোলজি ছিল, সেগুলো নিয়ে কাজ শুরু করি। পাশাপাশি বিভিন্ন ক্লাস প্রজেক্টে কাজ করি। কিন্তু টেক জায়ান্ট কোম্পানিগুলোতে চাকরি পাওয়ার জন্য প্রোগ্রামিং কম্পিটিশন কখনোই করা হয়ে ওঠেনি। আমি যখন পিএইচডির শেষবর্ষে চাকরির জন্য চেষ্টা করি; তখন থেকে প্রবলেম সলভিং বা প্রোগ্রামিং শুরু করি।
জাগো নিউজ: মেটায় চাকরি পাওয়ার জন্য নিজেকে কীভাবে প্রস্তুত করেছেন?
আবদুল্লাহ আল মামুন: শুরু থেকেই টেক জায়ান্ট গুগল, মেটা, মাইক্রোসফটের মতো কোম্পানিতে চাকরি করার ইচ্ছা ছিল। এসব কোম্পানিতে চাকরি পাওয়ার ধাপ প্রায় একই। প্রথমে খোঁজ-খবর নিতে থাকি ইন্টারভিউয়ের জন্য কী কী ধাপ আছে। প্রতিটা ধাপের প্রিপারেশন কেমন নিতে হয়। কী কী রিসোর্স রয়েছে অনলাইনে। গুছিয়ে নিয়ে নিজের মতো প্রস্তুতি শুরু করি। এরমধ্যে কোডিং রাউন্ডে প্রোগ্রামিং স্কিল বেশি জরুরি। বিভিন্ন ওয়েবসাইটের প্রবলেম সলভ করতাম। শুরুর দিকে প্রবলেম সলভ করতে না পাড়ায় হতাশায় ভুগেছি। তারপর নিয়মিত অনুশীলন করার ফলে ধীরে ধীরে স্কিল বাড়তে থাকে।
জাগো নিউজ: মেটায় কী ধরনের চাকরির সুযোগ আছে?
আবদুল্লাহ আল মামুন: মেটায় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ছাড়াও সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ও অন্যান্য ইঞ্জিনিয়ারিং পদে চাকরির সুযোগ আছে। তাছাড়া যে কোনো সাবজেক্ট থেকেই এখানে চাকরির সুযোগ আছে। মেটা অনেক বড় কোম্পানি। এখানে অনেক লোকবলের প্রয়োজন। যে কারণে কাজের অনেক ক্ষেত্র আছে এখানে। মেটার জব পোর্টাল থেকে নিজস্ব দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী আবেদন করতে হয়।
জাগো নিউজ: কীভাবে একজন নতুন গ্র্যাজুয়েট মেটায় চাকরির জন্য আবেদন করবেন?
আবদুল্লাহ আল মামুন: মেটায় আবেদনের আগে কিছু বিষয় জানা প্রয়োজন। এসব টেক জায়ান্ট কোম্পানিগুলোয় অনেক চাকরির সিভি জমা পড়ে। তাই একটু টেকনিক্যাল হওয়া জরুরি। প্রতিটা টেক জায়ান্ট কোম্পানির ক্যারিয়ার পোর্টালে চাকরির অপশন দেওয়া থাকে। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে ডাইরেক্ট আবেদন করা যাবে। তার আগে সিভির সঙ্গে লিংকড-ইন প্রোফাইল সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতে হবে। প্রয়োজনীয় তথ্যের সঙ্গে সব স্কিল বিস্তারিত উল্লেখ করতে হবে। এ ছাড়া মেটায় চাকরি করেন পরিচিত কোনো লোক থাকলে তাদের রেফারেন্সে আবেদন করতে পারেন। এতে ইন্টারভিউ পাওয়ার চান্সটা বেশি থাকে।
জাগো নিউজ: মেটায় ইন্টারভিউ দেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলুন—
আবদুল্লাহ আল মামুন: মেটায় কয়েক রাউন্ডে ইন্টারভিউ হয়ে থাকে। প্রথমেই রিক্রুটমেন্ট থেকে ইন্টারভিউ নেওয়া হয়। সেখানে একজন আবেদনকারীর পূর্ব অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানা হয়। পাশাপাশি দেখা হয়, তিনি মূল ভাইবা দেওয়ার জন্য যোগ্য কি না। এরপর ফোন স্কিন রাউন্ড হয়। এটা মূলত ভিডিও কলের মাধ্যমে নেওয়া হয়। এখানে কোডিং ও প্রোগ্রামিং স্কিল দেখা হয়। এই রাউন্ডে পাস করার পর আসবে অন-সাইট রাইন্ড বা ফাইনাল রাইন্ড। ফাইনাল রাউন্ডে কয়েক পর্ব থাকে। এতে থাকে সিস্টেম ডিজাইন রাউন্ড। এ পর্বে কোনো একটি সিস্টেম কীভাবে ডিজাইন হয়, সে সম্পর্কে ধারণা দিতে হয়। এ ছাড়া বিহ্যাভিওরাল ইন্টারভিউ হয়। এখানে আবেদনকারীর আগের কী কী অভিজ্ঞতা আছে, কী কী চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করবে, জবে থাকাবস্থায় সমস্যাগুলো কীভাবে সমাধান করেছেন, কারো সঙ্গে মতবিরোধ হলে কীভাবে সমাধান করেছেন, এসব দক্ষতা দেখা হয়।
জাগো নিউজ: সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে কত সময় লাগতে পারে?
আবদুল্লাহ আল মামুন: আবেদন করা থেকে শুরু করে রেজাল্ট আসা পর্যন্ত একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম হয়। তবে গড় হিসাব করলে দেখা যায়, এক থেকে দেড় মাস পর্যন্ত সময় লাগে।
জাগো নিউজ: আন্তর্জাতিক এসব প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশিদের সুযোগ কেমন?
আবদুল্লাহ আল মামুন: বিশ্বসেরা টেক জায়ান্ট কোম্পানিগুলোয় চাকরির ক্ষেত্রে সব দেশের জন্য সমান সুযোগ আছে। যে কোনো দেশ থেকে বা যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে আবেদন করা যাবে। যে কেউ আবেদন করলে তার প্রোফাইলের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ওপর তাকে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাকা হবে। মেটা সব দেশকে সমানভাবে মূল্যায়ন করে। সে ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশিদেরও সমান সুযোগ আছে এখানে।
জাগো নিউজ: যারা মেটায় চাকরি করতে আগ্রহী, তাদের জন্য আপনার কী পরামর্শ?
আবদুল্লাহ আল মামুন: দেশের তরুণদের জন্য মেটার পাশাপাশি অন্যান্য টেক জায়ান্ট কোম্পানিগুলোয় চাকরির সুযোগ আছে। অনেকে সঠিক ইনফরমেশন ও সাহসের অভাবের কারণে এসব কোম্পানিতে আবেদন করেন না। হয়তো অনেকেই স্বপ্ন দেখতে ভয় পান। তাই বড় বড় কোম্পানিতে চাকরির স্বপ্ন দেখতে হবে এবং পাশাপাশি চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে প্রচুর লোকবল এসব কোম্পানিতে জব করছেন। আমি মনে করি, আমাদের দেশের তরুণদের মধ্যেও সেই যোগ্যতা আছে।
জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
আবদুল্লাহ আল মামুন: আপাতত মেটাতেই আমার ভিত্তি মজবুত করা এবং যোগ্যতা, কর্মনিষ্ঠা ও কঠোর পরিশ্রমের দ্বারা আরও কয়েকধাপ এগিয়ে যেতে চাই। এ অবস্থানে থেকেই দেশের সামগ্রিক অবকাঠামো উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, তরুণদের সঠিক দিকনির্দেশনা এবং দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার চেষ্টা চালিয়ে যাবো। দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। পাশাপাশি দেশের আইসিটি খাতে নিজের মেধা ও দক্ষতা শেয়ার করতে চাই।
কেএসকে/এসইউ/এমএস