২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং বাংলাদেশ
এবারের এশিয়া কাপের আগ পর্যন্ত টি-টোয়েন্টিতে ক্রিকেটে বাংলাদেশের তেমন বড় কোনো সাফল্য ছিল না। বাংলাদেশ এমনিতে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলেছেই কম। আর এর মধ্যে ম্যাচ জয়ের সংখ্যাও বেশি নয়। বিশ্ব র্যাংকিংয়ে তাই বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে। যার দরুণ বাংলাদেশকে কোয়ালিফাইং পর্ব খেলেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মুল পর্ব খেলতে হয়েছে।
তাই এবারের এশিয়া কাপের আগে বেশ লম্বা সময় নিয়ে বিশ্বকাপের জন্য প্রস্তুতি নেয় জাতীয় দল। উদ্দেশ্য টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটেও ওয়ানডেরমত ভাল করা। ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টির আগে দেশের মাটিতে হয়ে যাওয়া এশিয়া কাপে বাংলাদেশ দল বেশ ভাল খেলে পাকিস্তান ও শ্রীলংকাকে হারায়; কিন্তু দেশের মাটিতে দুই-তিনটা জয়ে খুব বড় কিছু একটা কিছু হয়ে যায় না। প্রকৃতপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে আমাদের ছেলেদের নিজেদেরই প্রমাণ করার প্রয়োজন রয়েছে। প্রয়োজন রয়েছে ভাল খেলার এবং বড় দলগুলোকে হারানোর। তাতে যেমন অন্যদের কাছ থেকে সমীহ আদায় করা যাবে ঠিক তেমনি নিজেরদের আত্মবিশ্বাসও জন্মাবে।
আমাদের দলটি কোয়ালিফায়িং রাউন্ডে ভাল খেলে উঠে আসে মুল পর্বে। কোয়ালিফাইং রাউন্ডে তামিমের সেঞ্চুরি দলের অনন্য অর্জন হলেও, ধাক্কা খায় যখন তাসকিন আর আরাফাত সানিকে সন্দেহজনক বোলিং অ্যাকশেনের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। আর মুস্তাফিজতো ইনজুরির কারণে আগে থেকেই দলের বাইরে। ফলে বাংলাদেশ তাদের পুর্ণ শক্তি নিয়ে নামতে পারেনি মূল পর্বের প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। ওই ম্যাচে মোটেও ভাল করতে পারেনি ওরা। একতরফা ম্যাচে ৫৫ রানে হেরেছে পাকিস্তানের কাছে। ২০ ওভারের ম্যাচে ৫৫ রানের হার কিন্তু বিশাল ব্যাপার। মূলতঃ বোলিংয়ে ওরা বেশি রান দিয়ে ফেলেছিল ওইদিন। সে সাথে ব্যাটিংটাও যতটুকু ভাল হওয়া দরকার ছিল হয়নি তার কিছুই হয়নি।
ধারাবাহিকতা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচেও ধরে রেখেছে। তাসকিনের ব্যাপারে অতি আবেগি হওয়ার কারণে ওই ম্যাচে বাংলাদেশ দলের ফিল্ডিং ছিল খুবই নিম্নমানের। মিস করেছিল বেশ কয়েকটা ক্যাচ ও রান আউটের সুযোগ। ফলে সহজ জয়ের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে শেষ মুহূর্তের ভুল কোনভাবেই মার্জনীয় নয়।
শেষ ওভারে জয়ের জন্য প্রয়োজন ১১ রানকে মুশফিক অনেকটাই সহজ করে দিয়েছিলেন। পরপর দুটি বাউন্ডারি মেরে। কিন্তু দুই অভিজ্ঞ মুশফিক এবং মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের ভুলে বাংলাদেশের নিশ্চিত জয় হাতছাড়া হলো।
শেষ বলে দূর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এই বলটি হওয়ার আগে ধোনিরা যখন পুরো দলকে নিয়ে পরিকল্পনা করছিল তখন আমাদের দুই ব্যাটসম্যান দুই প্রান্তে দাঁড়িয়েছিলেন। তাদের নিজেদের মধ্যে কোনো কথাবার্তা বা আলোচনা বা পরিকল্পনা কিছুই হইনি। আসলে শুভগত এবং মুস্তাফিজ হয়ত বুঝে উঠতে পারেননি, ওই সময় ওদের কি করা দরকার ছিল। দুঃখের বিষয় এই যে আমাদের মুস্তাফিজ যিনি নন স্ট্রাইকিং পান্তে ছিলেন এবং রানআউট হলেন, উনি দেখছিলেন যে ধোনি রান আউট করার জন্য দৌড়াচ্ছে এবং উনি রান আউট হয়ে যাচ্ছেন; কিন্তু তিনি ইচ্ছা করলে ডাইভ দিতে পারতেন। ডাইভ দিলে হয়ত রানটা হয়েও যেতে পারত। তবে ওই দিনের আম্পায়ারিং নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। সেই বিতর্কে না হয় নাই গেলাম।
তবে আরেকটা ব্যাপার নিয়ে আমি আলাপ করতে চাই। সেটা হল, আমাদের দলের পেশাদারী আচরণ ও মনোভাব। কোয়ালিফাইং রাউন্ডের শুরুটা ভাল ছিল। নেদারল্যান্ডসের সাথে প্রথম ম্যাচটা একটু কষ্ট করে জেতা হয়ে ভালই হয়েছে। তাতে ক্রিকেটাররা পরের ম্যাচগুলোতে আর মনো্যোগী হয়েছে। ভেসে যায়নি সফলতার জোয়ারে। এরই মধ্যে তাসকিন আর সানির বোলিং অ্যাকশেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ। তাসকিন বেশ ভাল ফর্মে ছিলেন এবং দলের বোলিং-এ ছিলেন অন্যতম সেরা অস্ত্র। আমাদের দলের বোলিং প্ল্যানটাও হয়ত ওকে ঘিরেই ছিল। তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ খুবই দুর্বল। এসব নিয়ে আমাদের অধিনায়ক মাশরাফির যথেষ্ট প্রতিবাদী এবং অনেক আবেগপ্রবণ ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে উনি অনেকটা কেঁদেই ফেলেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার সাথে খেলায় সারাক্ষণ মুখভার করা ছিল অধিনায়ক মাশরাফির, যা নাকি দলের সার্বিক মানসিক অবস্থার জন্য ভাল নয় মোটেও।
আমার মনে হয় এই জায়গাটায় অধিনায়ক মাশরাফির আরও পেশাদারী হওয়া প্রয়োজন ছিল। তাসকিনের ব্যাপারে তিনি খুবই মর্মাহত এবং আইসিসির পক্ষ থেকে ন্যায় বিচার করা হয়নি সবই বুঝলাম; কিন্তু সেটা নিয়ে আমাদের অধিনায়কের পক্ষ থেকে একটু বেশী হয়ে গেছে বলে মনে হয়। এর ফলাফল দেখুন, পরপর তিনটি ম্যাচে খারাপ পারফরর্ম্যান্স এবং হার।
অস্ট্রেলিয়ার সাথে খুবই বাজে ফিল্ডিং। এরপরও হার মাত্র ৩ উইকেটে। ভারতের সাথে মুশফিক এবং রিয়াদের ওই দুটি শট ও শেষ বলে ওরকম রান আউট সত্যি মেনে নিতে কষ্ট হয়। কারণ মুশফিক এবং রিয়াদ দলের সেরা দুজন ব্যাটসম্যান এবং সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও দায়িত্বশীল। এটা এর আগে অনেকবারই তা তারা প্রমাণ করেছে। সেই সাথে রিয়াদতো এই টূর্নামেন্টে দারুন ফর্মে থাকা ব্যাটসম্যান। এমনটা হওয়ার কারণ বোধ হয় খেলার চাইতে তাসকিনের বিতর্কে বেশী মনোযোগী হয়ে খেলার মধ্যে মনোযোগ না রাখা। বেশী আবেগী হওয়া। নিউজিল্যান্ডের সাথে ওভাবে ব্যাটিং করে ৭০ রানে অল আউট হওয়াটা মোটেও ভাল লক্ষণ নয়।
হ্যাঁ, আমাদের বিরুদ্ধে অন্যায় হলে আমরা প্রতিবাদী হব, আবেগী হব। সবই ঠিক; কিন্তু যার যে দায়িত্ব সেটা করতে ভুলে গেলে তো চলবে না। ক্রিকেটারদের দায়িত্ব মাঠে পারফর্ম করা। মাশরাফির দল যদি অস্ট্রেলিয়াকে এবং ভারতকে হারাতে পারত এর চাইতে ভাল প্রতিবাদ আর কি বা হতো বলুন? ভারততো সেমিফাইনালে উঠলো বাংলাদেশেরই বদান্যতায়। নয়তো ওই ম্যাচ হারলেতো ভারতকে আর সেমিফাইনালের কথা চিন্তা করা লাগত না।
মাশরাফির এমন বেশী আবেগী হয়ে যাওয়াটা দলের ম্যানেজমেন্টের একরকম ব্যর্থতা, আমি বলবো। দায়িত্ব বর্তায় দলের কোচ, ম্যানেজার, নির্বাচক, অপারেশন্সের দায়িত্বে থাকা বোর্ডের পরিচালকের ওপর। তাদের কাজ অধিনায়ক ও দলকে সঠিক দিক নির্দেশনা দেওয়া সঠিক বিষয়ে মনোযোগী করা। বল যায় তারা সেটা ঠিকভাবে পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। আশা করব বিসিবি মাশরাফিকে বোঝাতে সক্ষম হবে যে, আরো পেশদারী মনোভাব নিয়ে, আবেগকে বেশী প্রশ্রয় না দিয়ে দল পরিচালনার ব্যাপারটি এবং মাঠের বাইরের ব্যাপারগুলো দেখবে বোর্ডের আর মাঠের ভিতরে খেলার দায়িত্ব ক্রিকেটারদের।
লেখক: সাবেক ক্রিকেটার ও ক্রিকেট কোচ
আইএইচএস/এবিএস