মান্না দে’র বিখ্যাত কফি হাউজে ক্ষণিকের আড্ডা
‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই.. আজ আর নেই...
কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেলগুলো সেই, আজ আর নেই...’
আমার বাবার খুব প্রিয় গান এটা। ছোট থেকেই শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। এক সময় জেনেছি, এটি ভারতীয় কিংবদন্তি গায়ক মান্না দে’র গান। বন্ধু নিখিলেশ সন্যাল, সুজাতা, মইদুল, গোয়ানিস ডি সুজা, অমল, রমা রায়কে নিয়ে গাওয়া সেই গানের কিংবদন্তিরা আজ আর নেই। মান্না দে’ও চলে গেছেন পৃথিবীর মায়া ছেড়ে, ২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবরে; কিন্তু এখনো ইতিহাসের সাক্ষী হয়েই দাঁড়িয়ে আছে তার বিখ্যাত সেই কফি হাউজ।
কলকাতা আসার আগে অনেকেই বলেছিলেন, ‘যদি সুযোগ হয় একবার ঘুরে এসো মান্না দে’র কফি হাউজে। নিকটতম বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রছাত্রীদের ছাড়াও লেখক, সাহিত্যিক, গায়ক, রাজনীতিবিদ, পেশাদার, ব্যবসায়ী ও বিদেশি পর্যটকরাও আড্ডা জমান সেখানে। গেলে অন্যরকম অনুভূতি পাবে।’
হোটেলে ওঠার পর সহকর্মী জান-ই-আলম ভাইকে বলার পর জানালেন রোববারই যাবেন সেই কফি হাউজে। শুনে তো আমার নিজের ভেতরই কেমন যেন একটা চনমনে অনুভূতি খেলে গেলো। স্বপ্নের গায়কের ঐতিহাসিক কফি হাউজ! সেই কফি হাউজে আমরাও একটা আড্ডা জমাবো, ভাবতেই কেমন যেন অন্যরকম ভালো লাগা তৈরি হতে থাকলো।
যে কথা সে কাজ। হোটেল থেকে তেমন বেশি দূর নয়। অটো বা ট্যাক্সিতে ১৫-২০ মিনিটের রাস্তা। ইচ্ছে ছিল কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ট্রামে চড়ে যাবো মান্না দের স্মৃতিবিজড়িত কফি হাউজে; কিন্তু সব আশা তো আর একসঙ্গে পূরণ হবার নয়! সুতরাং, দেখলাম লাইন মেরামতের কাজ চলায় কলকাতার বেশ কিছু জায়গায় এদিন ট্রাম চলাচল বন্ধ। অগত্যা, ট্যাক্সিতে চড়েই গেলাম কফি হাউজের দিকে।
উত্তর কলকাতার কলেজ স্ট্রিট চত্বর থেকে একটু সামনেই। তবে যেহেতু আমরা ক’জন অচেনা। সুতরাং, কলেজ স্ট্রিট চত্বরে ট্যাক্সি থেকে নেমে খুঁজতে শুরু করলাম কফি হাউজ। সামনেই এক কলেজছাত্রীকে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম এর অবস্থান। এক গাল হেসে হাত উঁচিয়ে দেখালেন ওই তো কফি হাউজ। এত কাছে দাঁড়িয়ে, একেবারে কফি হাউজের নিচে! তবু জিজ্ঞাসা করায় মনে মনে একটু লজ্জিতই হলাম।
দোতলায় উঠতে প্রথমেই চোখে পড়লো সামনে টানানো ‘কফি হাউজ’ সাইনবোর্ডটা। আর আট-দশটা বাঙালি ধাঁচের হোটেল রেস্টুরেন্টের মতোই কলকাতা কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউজটি। প্রায় দুপুরের দিকে প্রবেশ করলাম। ঢুকেই যেন প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো। পুরাতন এক হল রুম। পঞ্চাশ-ষাটটার মতো টেবিল সারি সারি সাজানো। দেয়ালে সারি সারি সাজানো ভারতবর্ষের বিখ্যাত সব শিল্পীর চিত্রকর্ম।
দুপুরের দিকে ঢোকায় ভেবেছিলাম হয়তো খালিই পাবো এটাকে; কিন্তু এই ভর দুপুরেও অনেক ভিড় দেখেই বুঝলাম, এর নাম কেন এতো বেশি শুনেছি। কোণার দিকে একটি টেবিল ছাড়া বাকি সবই পূর্ণ। বিশেষ করে চোখে পড়লো প্রবীণদের আনাগোনা। আমাদের দেশে এ ধরনের দোকানে সাধারণত কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড়ই থাকে বেশি। সেখানে নবীন-প্রবীণদের মিশ্রণে জমজমাট আড্ডা দেখে বেশ ভালোই লাগলো।
কোণার দিকের সেই টেবিলের চারদিকে সাজানো চারটি চেয়ারে বসলাম আমরা চারজন। আবারও মনে পড়লো, ‘কতজন এলোগেলো, কতজনই আসবে, কফি হাউজটা আজও থেকে যায়।’ আমরাও তো সেই ‘এলোগেলো’দের দলে। আসলাম, দেখলাম এরপর চলে যাবো। হয়তো আর কখনও আসা হবে না এই কফি হাউজে।
একটু পরই সাদা পোশাকের শেরওয়ানি ও মাথায় পাগড়ি পরা ষাটোর্ধ একজন বেয়ারা আসলেন। তার কাছ থেকেই জানতে পারলাম, একটু পরেই বন্ধ হয়ে যাবে কফি হাউজটি। সাপ্তাহিক ছুটির দিন রোববারে খোলা থাকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত। এছাড়া বাকি দিনগুলোতে সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকে। চার পেয়ালা কফির অর্ডার দিলাম। কিছুক্ষণ পরেই চলে আসলো। পেয়ালায় চুমুক দিতেই হারিয়ে গেলাম ধূমায়িত কফির আড্ডায়। নিজেকে মনে হলো মান্না দে। সামনে বসা পলাশ ভাই, রিপন ভাই আর জান-ই আলম ভাইকে মনে হচ্ছিলো যেন মান্না দে’র আড্ডার সঙ্গী নিখিলেশ সন্যাল, সুজাতা, মইদুল, গোয়ানিস ডি সুজা, অমল, রমা রায়।
মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষ বসু, কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যজিৎ রায়, সমরেশ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, বাঙালি অভিনেতা রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতো কত বিখ্যাত ব্যক্তিরা আড্ডা দিয়েছেন এই কফি হাউজে! সেই বিখ্যাতদের কাতারে ক্ষণিকের জন্য নিজেকে ভেবে কিঞ্চিত পুলকিতও বোধ করলাম। আমিও আজ সেই কফি হাউজে! চোখের সামনেই যেন এক এক করে ভেসে উঠছিল বিখ্যাত মুখগুলো। হাউজটির চারদিকে সাজানো রয়েছে সেই বিখ্যাত মানুষগুলোর চিত্র। চারদিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিলো আমার সামনেই যেন তারা বসে আছেন।
বাঙালির প্রাণের এ আড্ডাস্থলটির নাম এক সময় কফি হাউজ ছিল না। অ্যালবার্ট হল ছিল এর পূর্বনাম। ১৮৭৮ সালের এপ্রিলে তৎকালীন ব্রিটিশ রানী ভিক্টোরিয়ার স্বামী অ্যালবার্টের নামকরণে এটির নাম করণ করা হয়। এরপর কেটে গেছে প্রায় ১৪০ বছর। উপমহাদেশে বৃটিশবিরোধী নানা আন্দোলন-সংগ্রামের অনেক ইতিহাসে জড়িয়ে আছে কফি হাউজটির নাম।
মান্না দে’র কল্যাণে নামটা পাল্টে গেলেও মলিনতা আসেনি। আগের সেই চাকচিক্য নেই। আড্ডার চরিত্রগুলোও আর নেই; কিন্তু বাঙালির আড্ডার প্রাণচাঞ্চল্যের রূপ আজও ধরে রেখেছে বিখ্যাত এ কফি হাউজ। বৈচিত্র্যে ভরা এ কফি হাউজ ঐতিহ্যগতভাবেও সমৃদ্ধ। ব্রিটিশ-ভারত বর্ষে এ অঞ্চলের রাজনীতি, শিক্ষা, সাহিত্য ও সাংবাদিকতার আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল ছিল এ কফি হাউজ। নকশাল আন্দোলন থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের সূত্রপাতও হয়েছিল এ কফি হাউজ থেকেই।
আরটি/আইএইচএস/বিএ