ইডেনের উইকেটই বুঝতে পারেনি টাইগাররা
আগেরদিনই বলেছিলাম, বিশ্বকাপে সবচেয়ে কঠিন ম্যাচ খেলতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আমার এ লেখা দেখে কেউ কেউ দ্বিমতও পোষণ করেছেন। হয়তো বলেছেন, ভারত-অস্ট্রেলিয়াকে রেখে কিভাবে নিউজিল্যান্ড কঠিন প্রতিপক্ষ হতে পারে। কিন্তু আমার কাছেও তো যুক্তি আছে। নিউজিল্যান্ড দলটির শেষ তিন ম্যাচের খেলা দেখেই আমার মনে হয়েছে এই দলটিই সবচেয়ে বেশি কঠিন। কারণ, দলটি খুবই ব্যালান্সড।
কেন উইলিয়ামসন কী সুন্দর অধিনায়কত্ব করছে! প্রতিটা ম্যাচেই। প্রতিটা উইকেটেই এতো সুন্দর রিড করতে পারে সে, যা দেখে আমি শুধু অবাকই হয়েছি। আসলে যারা গ্রেট, তারা এমনই হয়। উইকেট রিড করতে পারে খুব দ্রুত। পাকিস্তানের ইনজামাম-উল হককে দেখেছিলাম। যিনি সবচেয়ে ভালো উইকেট রিড করতে পারতেন, যে কোন্ উইকেটে কী হবে। ডে ফাইভে কী হবে, ডে ওয়ানে কী হবে। উইলিয়ামসনকে দেখলাম, প্রতিটি ম্যাচেই সে খুব সুন্দর উইকেট রিড করতে পারছে এবং যা করছে তাতেই সে সফল হচ্ছে।
আজকের ম্যাচের দিকে তাকালেও দেখবেন, তিনটা স্পিনার খেলালো। কী সুন্দর বোলিং রোটেশন করালো। ইলিয়টকে দিয়ে চার ওভার বল করালো। ১২ রান দিয়ে ৩ উইকেট নিয়েছে সে। যে অবস্থায় যা করা দরকার, সে তাই করছে। ব্যাটিংয়ের দিকে যদি দেখেন, তারা কিন্তু কোনো তাড়াহুড়া করেনি। বাজে বল যেটা, সেটা দেখেই মেরেছে। কোনো তাড়াহুড়া নাই। নিউজিল্যান্ডের টার্গেটই ছিল যে, তারা ১২০ প্লাস করবে। ১২০ প্লাস নয়, শেষ পর্যন্ত ১৪৫ যখন করে ফেলছে, তখনই তারা বুঝে ফেলছে যে এই ম্যাচে বাংলাদেশের কোনো সুযোগই নেই।
তবে ৭০ রানের মধ্যে অলআউট হওয়াতে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদেরও আমি দোষ দেবো না। কারণ, এই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেই তো ভারত ৭৯ রানে অলআউট হয়েছিল। যদিও ৭০ করার মতো দল নই আমরা। আরো ভালো করার ক্ষমতা ছিল। প্রথমে রান আউটটাই ধাক্কা দিয়ে ফেলেছিল।
যদিও নিউজিল্যান্ড এ কারণে খুব ভারসাম্যপূর্ণ যে, দলটিতে অনেক যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মতো অপশন রয়েছে। এখনো পর্যন্ত বিশ্বকাপের সেরা দল মনে হচ্ছে তাদের। এমনকি বিশ্বকাপ জয়েরও ক্ষমতা রাখে। তবে তাদের ভাগ্যটাও ভালো। চারটি ম্যাচেই টস জিতেছে নিউজিল্যান্ড।
আরেকটি কথা বলবো, সেটা হচ্ছে- আপনি যদি দেখেন প্রতিটা সিরিজে, দেশের বাইরে যখন আমরা খেলি, তখন শেষ ম্যাচটা খুব খারাপ হয়, সব সময়। কারণ, অনেকদিন খেলার মধ্যে থেকে মানসিকভাবে একটা চাপের মধ্যে থাকি। এ কারণে, শেষ ম্যাচটা আমাদের সব সময়ই খুব খারাপ হয়। রেকর্ড ঘাঁটলে এটাই দেখবেন। আমার ১৩ বছরের খেলার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। এরপর তো আরো তিন বছর পার করে দিয়েছি না খেলে। এতোটা সময় ধরে দেখছি, দেশের বাইরে খেলতে গেলেই আমাদের এ সমস্যা হয়ে যাচ্ছে।
এমনকি ভারতের বিপক্ষে জিতলেও এই অবস্থা হতো বলে আমি মনে করি। কারণ, আমাদের রান রেট অনেক কম ছিল। যে কারণে শেষ দুই ম্যাচ জিতলেও আমাদের সেমির সম্ভাবনা কম ছিল। তাতে ব্যাটসম্যানদের এই অবস্থার পরিবর্তন হতো বলে আমি মনে করি না। তবুও এটা বলতে পারি, ভারতের বিপক্ষে জিতলে হয়তো এই ম্যাচে আলাদা একটা স্পিরিট থাকতেও পারতো যে, না এই ম্যাচে জিততে হবে আমাদের।
তবে আমার কাছে একটা বিষয় খুব দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে, নাসিরকে বসিয়ে রাখা। একটা পরীক্ষিত খেলোয়াড় সে। গত চার-পাঁচ বাংলাদেশ দলকে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছে। এমন একজন খেলোয়াড়কে একটা ম্যাচ খেলিয়ে বসিয়ে রাখা আসলে আমার কাছে খুব ভালো ঠেকেনি।
বেশ কিছুদিন ধরেই দেখছি বাংলাদেশ দলে একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠছে। একজন খেলোয়াড়কে কিছুদিনের জন্য সুযোগ দেয়া হলো। এরপর হঠাৎ করে সে নাই হয়ে যায়। এনামুল বিজয়, লিটন কুমার কিংবা শামসুর রহমান শুভদের কিছুদিন খেলানোর পর হঠাৎ করেই যখন বসিয়ে রাখা হয়, এমনকি একটা সময় দেখা যায় উপেক্ষার স্বীকার হতে হতে সেই খেলোয়াড়টা হারিয়েই যায়। এভাবে করলে একটা দল কীভাবে দাঁড়াবে! মাহমুদুল্লাহ, মুশফিক, তামিম, সাকিব, মাশরাফি- এই ৫ জন ক্রিকেটার, টানা খেলছে অনেকদিন ধরে। ওদের সঙ্গে সঙ্গে যারা আছে তাদেরকেও সুযোগ দেয়া উচিৎ।
অথচ দেখেন এনামুল বিজয়কে আড়াই-তিন বছর খেলালাম। এরপর তাকে বাদ দিয়ে দিলাম। লিটন কুমারকে খেলালাম তিনটা সিরিজ- এরপর বাদ দিয়ে দিলাম। তাতে কী দাঁড়াচ্ছে। কিছু খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ার নষ্ট হচ্ছে। অথচ যাদের বাদ দিচ্ছি, তাদের বয়স অনেক কম। ২১ কিংবা ২২ বছর। ওদের এভাবে বাদ দেয়াটা ঠিক হচ্ছে না। যে কারণে দেখা যাচ্ছে, দলে কোনো না কোনো স্থানে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে এবং দলও ঠিকভাবে দাঁড়াচ্ছে না।
তবুও সব মিলিয়ে বলবো বিশ্বকাপটা খারাপ হয়নি আমাদের। কোয়ালিফাইং রাউন্ড ভালো খেলেছি। অস্ট্রেলিয়া-ভারতের বিপক্ষেও ভালো খেলেছি। শুধু পাকিস্তানের বিপক্ষে উইকেটটা আমরা বুঝতে পারিনি। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও বুঝতে পারিনি কতো রান যথেষ্ট। যদি তাদেরকে ১২০ এর মধ্যে বেধে রাখতে পারতাম, তাহলে সেটা হতো সবচেয়ে ভালো।
আবার আমাদের দলের ক্রিকেটার থেকে ম্যানেজমেন্ট, কেউই সম্ভবত উইকেট বুঝতে পারেনি। ১৪৫ রানে বেধে ফেলার পর দেখলাম দলের ক্রিকেটারদের মুখে হাসি। তারা হয়তো খুব খুশি হয়েছিল। কিন্তু ১৪৫ যে ২৪৫ রানের সমান, এটা তারা প্রথমে বুঝতে পারেনি। যেটা বুঝেছে নিউজিল্যান্ড।
লেখক: বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক
আইএইচএস/বিএ