ভিডিও EN
  1. Home/
  2. খেলাধুলা

মাশরাফির জীবনবোধ, দেশপ্রেম

প্রকাশিত: ০৩:২৬ পিএম, ৩০ জানুয়ারি ২০১৬

মাশরাফি বিন মর্তুজা। বাংলাদেশ ক্রিকেটের রঙিন জার্সির অধিনায়ক। প্রায় দেড় দশক ধরে বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রতিনিধিত্ব করে আসছেন। ২০০৯ সালে নেতৃত্বের গুরুদায়িত্ব কাঁধে বর্তালেও ইনজুরি তাকে মাঠ থেকে ছিটকে দিয়েছে বারবার। ঘরের মাঠে ২০১১ বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন থাকলেও, দল থেকে ছুড়ে ফেলা হয় তাকে। সেদিন মাশরাফির চোখের পানি কাঁদিয়েছিল এ দেশের প্রায় সকল ক্রিকেটপ্রেমীকেই।

তবুও মাশরাফি হারেন না। হারতে জানেন না। বার বার ফিরে আসেন। এমন অদম্য এক ক্রিকেটারের হাতেই ২০১৪ সালের এক সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশের ক্রিকেটের রঙিন জার্সির দুটি ফরম্যাটের দায়িত্ব তুলে দেয়া হয়। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরের ঘটনা এটি। এরপর কেবলই বাংলাদেশ ক্রিকেটে স্বপ্নময় এক অভিযাত্রা। স্বপ্নের চেয়েও দামি কয়েকটি সিরিজ কাটানো। তার নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব এবং ব্যক্তিত্বে ক্রিকেট ইতিহাসের স্বর্ণ শিখরেই যেন এখন  বাংলাদেশ।

masমাশরাফির জীবন কাহিনীই যেন একটা শ্বাসরূদ্ধকর উপন্যাস। সেই উপন্যাসই একটি গ্রন্থে, একজায়গায় নিয়ে আসার প্রচেষ্টায় লেখা হয়েছে তার জীবনীগ্রন্থ, `মাশরাফি`। ক্রীড়া সাংবাদিক দেবব্রত মুখোপাধ্যয় রচিত মাশরাফির এই জীবনীগ্রন্থটি ইতিমধ্যেই বেশ সাড়া ফেলেছে। সেই বইতেই নানা জায়গায় উঠে এসেছে মাশরাফির জীবনবোধের অনেক রাশভারি কথা-বার্তা।

`মাশরাফি` বইয়ের একটি অধ্যায়, বলছেন মাশরাফি। এই অধ্যায়েরই লেখকের সঙ্গে মাশরাফির জীবনবোধ এবং দেশপ্রেম নিয়ে কিছু কথোপকথন তুলে ধরা হলো জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য...

খেলোয়াড় জীবন আসলে কেমন?
মাশরাফি বলেন, আমাদের এই উপমহাদেশে খেলোয়াড়ের পারফরম্যান্সই তার জীবনের মাপকাঠি। এটা একটু অদ্ভূত। ভারত, পাকিস্তান আর বাংলাদেশে বোধ হয় এটা হয়। শ্রীলঙ্কাতে তেমন হয় না। এখানে একটা খেলোয়াড় মানে, চব্বিশ ঘণ্টাই ওই পারফরম্যান্সের কারণে বিচার হচ্ছে তার। খেলোয়াড়ের ব্যক্তিগত, পারিবারিক জীবনটাও খেলা দিয়ে মাপা হয়। এটা আসলে খেলা-ধুলার মূল সুরের সঙ্গে ঠিক যায় না। আপনি যদি অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের দিকে তাকান, ওরা খেলোয়াড়ের পারফরম্যান্স দিয়ে তাকে মাঠে বিচার করে। সেই অনুযায়ী তাকে দলে রাখা হবে বা বাদ দেওয়া হবে। আমাদের কী হয়? একটা ছেলে রান না পেলে তার পরিবার জ্বালা টের পায়। তার পুরো জীবনটা প্রভাবিত হয়।

কেন হয়?
এর একটা বড় কারণ, ক্রিকেট অনুসরণ না করা। আমাদের এখানে জয়ের আনন্দে বা জয় দেখতে চেয়ে প্রতিদিন নতুন নতুন সমর্থক যোগ হচ্ছেন। আমি সমালোচনা করছি না। তবে এই ক্রিকেটের আগে-পরের চরিত্র, ক্রিকেটে কী ঘটে, কী ঘটে না; এসব একেবারেই না জেনে ক্রিকেটের অনুসরণকারী হয়ে যাওয়ার একবা বিপদ আছে। মনে হয় ব্যর্থতাটা বুঝি খেলার অংশ না। এর ফলে ব্যর্থতা মানেই সেটাকে ব্যক্তিগত অন্যায় ভেবে বসা হয়। এটার খুব বিপদ আছে।

এটাতো আপনারা ভালো খেলছেন, পাচ্ছেন; তাই জয়ের নেশাটা বাড়তে থাকে।
এটাই আমি ভয়ের জায়গা মনে করি। জয় তো চাইবেই। কোনো খেলোয়াড় মাঠে হারার পরিকল্পনা করে নামে না। কিন্তু জয়টা যেন খেলার চেয়ে জরুরী হয়ে যাচ্ছে। এই লোভটা খারাপ। আমরা লোভি হয়ে যাচ্ছি। এই যে কথায় কথায় `বাংলাওয়াশ` বলা হয়, এর মধ্যে এক ধরনের অন্যের প্রতি ঘৃণা আর নিজেদের লোভের প্রকাশ আছে। এই শব্দটাই ভালো না। আপনি কেন `ওয়াশ` করার লক্ষ্য নিয়ে খেলবেন? আপনি বেস্ট ক্রিকেট এনজয় করার লক্ষ্য নিয়ে খেলবেন। খেলার চেয়ে এই লোভ বড় হয়ে গেলে অনেক বিপদ আছে।

আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করেন, ক্রিকেট এখন দেশপ্রেম প্রকাশের একটা জায়গা হয়ে গেছে।
আমি তো নিয়মিত বলছি কথাটা। দেশের তুলনায় ক্রিকেটটা অতি ক্ষুদ্র একটা ব্যাপার। একটা দেশের অনেক ছোট ছোট মাধ্যমের একটা হতে পারে খেলাধুলা; তার একটা অংশ ক্রিকেট। ক্রিকেট কখনও দেশপ্রেমের প্রতীক হতে পারে না। সোজা কথায়-খেলাধুলা হলো বিনোদন।

Mashraf
অথচ বিনোদনটা এখন দেশের প্রধান ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।
এটা তো বিস্ময়কর ব্যাপার। খেলা কখনও একটা দেশের প্রধান আলোচনায় পরিণত হতে পারে না। দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে যা সমাধান বাকি। সেখানে ক্রিকেট নিয়ে পুরো জাতি, রাষ্ট্র এভাবে এনগেজ হয়ে পড়তে পারে না। আজকে আমাদের সবচেয়ে বড় তারকা বানানো হচ্ছে, বীর বলা হচ্ছে, মিথ তৈরি হচ্ছে। এগুলো সব হলো বাস্তবতা থেকে পালানোর ব্যাপার।

তাহলে তারকা কে? বীর কে? আমাদের দেশে তো তারকাও নেই বীরও নেই।
অবশ্যই আছে। আমাকে প্রশ্ন করুন, তারকা হলেন একজন ডাক্তার। আমি ক্রিকেটার, একটা জীবন কি বাঁচাতে পারি? কক্ষনো না। একজন ডাক্তার পারেন। কই, দেশের সবচেয়ে ভালো ডাক্তারের নামে কেউ তো একটা হাততালি দেয় না! তাদের নিয়ে মিথ তৈরি করুন, তারা আরও পাঁচজনের জীবন বাঁচাবেন। তারাই তারকা। তারকা হলেন লেবাররা, দেশ গড়ে ফেলছে। ক্রিকেট দিয়ে আমরা কি বানাতে পারছি? একটা ইটও কি ক্রিকেট দিয়ে তৈরী করা যায়? একটা ধান জন্মায় ক্রিকেট মাঠে? জন্মায় না। যারা এই ইট দিয়ে দালান বানায়, যারা কারখানায় আমাদের জন্য এটা-ওটা বানায় বা ক্ষেতে ধান জন্মায়, তারকা হলেন তারা।

Launchingবীর? আপনি বীর নিয়ে অন্য একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন?
হ্যাঁ, সব সময় বলি। বীর হলেন মুক্তিযোদ্ধারা। আরে ভাই, তারা জীবন দিয়েছেন। জীবন যাবে জেনেই ফ্রন্টে গেছেন দেশের জন্য। আমরা কি করি? খুব বাজেভাবে বলি- টাকা নেই, পারফর্ম করি। এটা অভিনেতা, গায়কের মতো আমরাও পারফর্মিং আর্ট করি। এর চেয়ে এক ইঞ্চি বেশিও কিছু না। মুক্তিযোদ্ধারা গুলির সামনে এইজন্য দাঁড়ায় নাই যে জিতলে টাকা পাবে। কাদের সঙ্গে কাদের তুলনা রে! ক্রিকেটে বীর কেউ থেকে থাকলে রকিবুল হাসান, শহীদ জুয়েলরা।

ক্রিকেটার হিসেবে বললেন?
নাহ। রকিবুল ভাই ব্যাটে জয় বাংলা লিখে খেলতে নেমেছিলেন, অনেক বড় কাজ। তার চেয়েও বড় কাজ, বাবার বন্দুক নিয়ে ফ্রন্টে চলে গিয়েছিলেন। শহীদ জুয়েল ক্রিকেট রেখে ক্র্যাক প্লাটুনে যোগ দিয়েছিলেন। এটাই হলো বীরত্ব। ফাস্ট বোলিং সামলানার মধ্যে রোমান্টিসিজম আছে, ডিউটি আছে; বীরত্ব নেই।

ক্রিকেটে দেশপ্রেম খোঁজে কেন?
কেন খোঁজে? আমি বলি, এই যারা ক্রিকেটে দেশপ্রেম দেশপ্রেম বলে চিৎকার করে, এরা সবাই যদি একদিন রাস্তায় কলার খোসা ফেলা বন্ধ করত, একটা দিন রাস্তায় থুতু না ফেলত বা একটা দিন ট্রাফিক আইন মানত, দেশ বদলে যেত। এই প্রবল এনার্জি ক্রিকেটের পেছনে ব্যয না করে নিজের কাজটা যদি সততার সঙ্গে একটা দিনও সবাই মানে, সেটাই হয় দেশপ্রেম দেখানো। আমি তো এই মানুষদের দেশপ্রেমের সংজ্ঞাটাই বুঝি না!

যেমন?
আরে সুমন ভাইরা (হাবিবুল বাশার) আইসিএল খেলতে গেল, তারা নাকি দেশদ্রোহী! বোঝেন অবস্থাটা। একটা বোর্ডের সঙ্গে গণ্ডগোল করে একটা সংস্থা আইনের অধীনেই একটা লিগ চালু করেছে। যাদের বিপক্ষে সে দেশেও কোন অসৎ কাণ্ডের অভিযোগ নেই। সেখানে খেলতে গেলে আপনি প্রতিষ্ঠানবিরোধী বলতে পারেন, কিসের দেশদ্রোহী! দেশপ্রেম, দেশদ্রোহ কোনটাই এত সোজা না।

আশরাফুল কী দেশদ্রোহী?
এটা তো আমি জাজ করার কেউ না। ঠিক দেশের সঙ্গে প্রতারণা না হলেও মানুষের সঙ্গে প্রতারণা তো। তবে এগুলো অনেক বেশি ভেবে নেওয়ার ব্যাপার। আসলে দেশদ্রোহ কোনটা? আপনি রাষ্ট্রের একটা গোপন তথ্য পাচার করে দিলেন, রাষ্ট্রের অর্থ নিয়ে ছিনিমিনি খেললেন, রাষ্ট্রকে সংকটে ফেলে দিলেন; এসব হলো দেশদ্রোহ। দেশদ্রোহ শব্দটা অনেক বড়।

জাতীয়তাবাদকে খুব সস্তা করে ফেলেছি আমরা?
একদম। কিছু হলেই বলে, এই এগারো জন ১৬ কোটি মানুষের প্রতিনিধি। আন্দাজে! তিন কোটি লোকও হয়তো খেলা দেখে না। দেখলেও তাদের জীবন-মরণ খেলায় না। মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন রাজনীতিবিদেরা, তাদের স্বপ্ন ভবিষ্যত অন্য জায়গায়। এই এগারোজন পারফরমারের ওপর এই দেশের মানুষের ক্ষুধা, বেঁচে থাকা নির্ভর করে না। দেশের মানুষকে তাকিয়ে থকতে হবে একজন শিক্ষাবীদের দিকে, একজন বিজ্ঞানীর দিকে।

আরেকটু পরিষ্কার করেন।
ধরুন এমন একটা আবিষ্কার হবে, যেটা সারাজীবন থেকে যাবে। খেলায় পারফরম্যান্স আজ আছে, ভালো লাগছে। কাল যেই খারাপ হবে, ফুরিয়ে যাবে। আজ একজন বিজ্ঞানী বা গবেষক এমন কিছু একটা আবিষ্কার করবেন; যেটা বাংলাদেশের নাম ইতিহাসে লিখে দেবে। যুগের পর যুগ ছাত্ররা সেটা নিয়ে পড়বে। রাষ্ট্রকে এসব কাজে উৎসাহ দিতে হবে।

ক্রিকেটকে তাহলে কী খুব গৌন মনে করছেন?
জাতীয়তাবাদ, রাষ্ট্র, দেশ- এগুলোর তুলনায় তুচ্ছ একটা ব্যাপার নয়? হ্যাঁ, এটা আমাদের পরিচিতির একটা সিম্বল হতে পারে। তারপরও কথা আছে। শুধু ক্রিকেট কেন? শুধু ক্রিকেট দিয়েই কী আমাদের খেলাধুলার মান যাচাই করা যাবে? আজকে আমরা যদি খেলাধুলার সব সেক্টরেই কিছু এগুতে পারতাম, আমাদের ফুটবল অন্তত এশিয়ান লেভে  পৌঁছে যেত, একটা অলিম্পিক গোল্ড মেডেলিস্ট থাকত। বৈশ্বিক খেলাধুলার বিচারে এগুলোর চেয়ে ক্রিকেট তো অনেক পেছনের একটা ব্যাপার। তবু একটা জায়গায় আমরা গেছি বলে মনে হতো।

আইএইচএস/আরআইপি

আরও পড়ুন