অযত্ন আর অবহেলায় যেন থেকেও কিছু নেই খুলনা সুইমিংপুলে
খাল-বিল, নদী-নালার দেশে ভালোমানের সাঁতারু বের করে আনার লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহর এবং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জেলায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়েছে সুইমিংপুল। যে সব সাঁতারুরা শুধুমাত্র এসএ গেমস নয়, দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে এশিয়ান গেমস, এমনকি অলিম্পিক গেমসেও।
শুধু সাঁতারু বের করে আনাই নয়, বিভিন্ন ক্রীড়া ডিসিপ্লিনে খেলোয়াড়দের শরীরচর্চার অন্যতম অনুসঙ্গ হিসেবেও খুব প্রয়োজন সাঁতার। সাধারণ মানুষের সাঁতার শেখাটাও জীবনের অন্যতম প্রয়োজনীয় বিষয়।
সবকিছুকে সামনে রেখে সারা দেশে অন্তত ২৩টি সুইমিংপুল নির্মাণ করা হয়। কিন্তু নির্মাণের পর অধিকাংশ পুলই পড়ে রয়েছে জরাজীর্ণ অবস্থায়। কোনো কোনো পুলে তো একদিনের জন্যও কেউ নামতে পারেনি। কোথাও পানি নেই, কোথাও পাম্প নষ্ট, কোথাও নোংরা পানি- নানা অব্যবস্থায় পড়ে রয়েছে কোটি কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত সুইমিংপুলগুলো।
অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত এসব সুইমিংপুল নিয়েই জাগোনিউজের ধারাবাহিক আয়োজন। দ্বিতীয় পর্বে আজ থাকছে খুলনা সুইমিংপুলের চিত্র...
* ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর খুলনা সুইমিংপুলে হয়নি কোনো সাঁতার প্রতিযোগিতা।
* পাম্প এবং সরবরাহ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে পুলের বেসিনে পানি দেয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই।
* গ্যালারি ও চেঞ্জরুমের অবস্থাও বেহাল। পুলের নিচের টাইলসগুলোও উঠে যাচ্ছে রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে।
* ‘পুলটি মেরামত করা এবং সংরক্ষণ করার জন্য আমি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে চিঠি দিয়েছি; কিন্তু কোন কাজ এখনও হয়নি।’
* খুলনা থেকে উঠে আসছে না জাতীয় পর্যায়ের কোন সাঁতারু। নতুন সাঁতারুও তৈরি হচ্ছে না।
‘নামে তাল পুকুর, ঘটি ডোবে না’ অবস্থা হয়েছে খুলনার একমাত্র সরকারি সুইমিং পুলটির। অযত্ন আর অবহেলার কারণে সবকিছু থেকেও যেনো কিছুই নেই পুলটিতে। পুলের পানি সরবরাহ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেছে অনেক আগেই। গ্যালারি ও চেঞ্জরুমের অবস্থাও বেহাল। পুলের নিচের টাইলসগুলোও উঠে যাচ্ছে রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে।
বেহাল দশার কারণে এই পুলে হয় না কোন সাঁতার প্রতিযোগিতা। ফলে অন্য সব খেলায় খুলনা জাতীয় পর্যায়ে দাপটের সাথে অংশগ্রহণ ও পুরস্কার পেলেও সাঁতারের ক্ষেত্রে রয়েছে সব জেলার পিছনে। খুলনা থেকে উঠে আসছে না জাতীয় পর্যায়ের কোন সাঁতারু।
খুলনার এই একমাত্র পুলটির অবস্থান নগরীর সোনাডাঙা থানা এলাকাধীন খুলনা বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের অভ্যন্তরে। এছাড়া খুলনা জেলা স্টেডিয়ামের সাথেই এক সময় একটি সুইমিং পুল থাকলেও তা অনেক আগেই ভরাট করে ফেলা হয়। এই পুলে আধুনিক কোন সুযোগ সুবিধা না থাকলেও মাঝেমধ্যে উপজেলা পর্যায়ের সাঁতার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে সেখানে। সেটাও এখন আর নেই।
সম্প্রতি সরেজমিনে খুলনার এই সুইমিংপুলে গিয়ে দেখা গেলো এর বেহাল দশা। সুইমিংপুল, অথচ এই পুলে কোনো পানি নেই। পাম্প নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে সেখানে পানি দেয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। পুলের বেসিনে অনেক জায়গায় টাইলস উঠে গেছে। গ্যালারি আর চেঞ্জরুম জরাজীর্ণ। সর্বত্র অযত্ন আর অবহেলার চাপ স্পষ্ট।
জানা যায়, ২০১৩ সালের আগস্টে সোনাডাঙা থানা এলাকায় যাত্রা শুরু হয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের আওতাধীন খুলনা বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের। এরপর সেখানে নির্মাণ করা হয় খুলনার একমাত্র সরকারি পূর্ণাঙ্গ সুইমিংপুল।
২০১৮ সালে পুলের নির্মাণ কাজ শেষ হলেও কখনো এখানে কোন সাঁতার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়নি। এরই মধ্যে করোনার কারণে ২০২০ সালে বন্ধ হয়ে যায় পুলটি। এরপর আর চালু করা হয়নি। ফলে পুলের পানি শোধণাগার, সরবরাহ পাম্পসহ প্রায় সবকিছুই এখন অকেজো হয়ে গেছে। খুলনা বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের নিয়ন্ত্রন রয়েছে খুলনা বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থার অধীনে। তবে পুলটি চালানোর মত তেমন কেউ এখন আর নেই।
খুলনা বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের উপ-পরিচালক, এক সময়ের জাতীয় সাঁতারু এবং প্রশিক্ষক গোলাম সরোয়ার বলেন, ‘বেসরকারী পর্যায়ে সুইমিং পুল থাকলেও মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের এই পুলটি খুলনায় একমাত্র সরকারি সুইমিং পুল। খুলনাবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালে। তৎকালীন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. আহাদ আলী সরকার পুলটির নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। তবে নির্মাণের পর তা কখনো ব্যবহার হয়নি। এটি চালু থাকলে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার আয় বৃদ্ধি পেতো।’
তবে তিনি আফসোস করে জানান, মহিলারাই এখন এখানে আসে না। নানা অজুহাত দেখান তারা। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে যত সাঁতার প্রশিক্ষক রয়েছেন, তারা সবাই আমার হাতে গড়া; কিন্তু খুলনায় আমি কোন সাঁতারু তৈরি করতে পারছি না।’
গোলাম সরোয়ার আরও বলেন, ‘খুলনার এই পুলটিতে সব ধরনের সুযোগ সুবিধাই রয়েছে; কিন্তু মহিলারা বলে, এখানে পুলের উপর ছাউনি নেই। ছাউনি না থাকলেও আর সব সুবিধা তো আছেই। ব্যবহার করলেই তো হয়। কিন্তু কোন জিনিস যদি ৫/৬ বছর অব্যহৃত পড়ে থাকে তাহলে কি ভালো থাকে?’
তিনি বলেন, ‘পুলটি মেরামত করা এবং সংরক্ষণ করার জন্য আমি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে চিঠি দিয়েছি; কিন্তু কোন কাজ এখনও হয়নি। এছাড়া পুলটির দায়িত্ব খুলনা জেলা ক্রীড়া সংস্থাকে গ্রহণ করার জন্যও বলেছি। তাহলে সংস্থার কিছু আয় হবে এখানে সাঁতারু তৈরির প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। খুলনায় তখন সাঁতারুও তৈরি হবে।’
খুলনায় সুইমিং পুলের বিষয়ে খুলনা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক এসএম মোয়াজ্জেম রশিদী দোজা বলেন, ‘মহিলা ক্রীড়া সংস্থার অধীনে ক্রীড়া কমপ্লেক্সের মধ্যে যে সুইমিং পুলটি রয়েছে তা কোন কাজে আসছে না। এটা রক্ষণাবেক্ষণ করতে যে খরচ হয় তা মহিলা ক্রীড়া সংস্থার নেই।
দোজা বলেন, ‘একটা পুল তৈরি করতে প্রায় ৩০ কেটি টাকা খরচ হয়। খুলনায় আরও একটি পুল তৈরি করার জন্য আমি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে অনুরোধ করেছিলাম; কিন্তু তারা বলেছে, সুইমিং পুলের জন্য এখন আর কোন বরাদ্দ নেই। পুল না থাকায় খুলনায় কোন সাঁতার প্রতিযোগিতা হয় না। নতুন সাঁতারুও তৈরি হচ্ছে না। ফলে জাতীয় পর্যায়ে সাঁতারের ক্ষেত্রে খুলনা বরবরই পিছিয়ে রয়েছে। একটি পুল রয়েছে খুলনার একটি ক্লাবে। যা ওই ক্লাবের সদস্য ছাড়া বাইরের কেউ ব্যবহার করতে পারে না।’
খুলনা বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক এসএম মোর্তজা রশিদী দারা বলেন, ‘খুলনা হলো খেলোয়াড় তৈরির সূতিকাগার। খুলনার খেলোয়াড়রা জাতীয় পর্যায়ে সব সময় এগিয়ে থেকেছে। এখনও আছে। খুলনা জুনিয়র পর্যায়ে প্রায় সব খেলাতেই চ্যাম্পিয়ন; কিন্তু যখনই কোন ভালো খেলোয়াড় তৈরি হয় তখনই তা চলে যায় সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌ-বাহিনী, বিজিবি বা পুলিশে। যে কারণে সিনিয়র পর্যায়ে খুলনা খুব ভালো করতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, বাস্কেট বল, হা-ডু-ডু, ব্যাডমিন্টনসহ অন্যান্য খেলায় খুলনা সবার চেয়ে এগিয়ে। এখানে যখন খেলা হয় তখন ডিফেন্সের লোকরা খেলোয়াড়দের প্রতি লক্ষ্য রাখে। তারাই খেলোয়াড়দের নিয়ে যায়; কিন্তু সাঁতারের ক্ষেত্রে এমন কোন রেকর্ড খুলনার নেই। তিনি বলেন, এর মূল কারণ হলো খুলনায় কোন সুইমিং পুল নেই। একটা ভালো মানের পুল থাকলে খুলনাও সাঁতারের ক্ষেত্রে দেশের মধ্যে সেরা হতে পারতো।
আলমগীর হান্নান/আইএইচএস/