শেরে বাংলার ‘রহস্যময়’ উইকেটই বাংলাদেশের প্লাস পয়েন্ট!
মেঘের মত ক্ষণে ক্ষণে এর চরিত্র পাল্টায়। শেরে বাংলার উইকেটের আচরণ, গতি-প্রকৃতি পুরোপুরি বোঝা ও অনুমান করা খুব কঠিন। কথাগুলো ক্রিকেট কিংবদন্তি শচিন টেন্ডুলকারের।
২০১২ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে এশিয়া কাপের ম্যাচে সেঞ্চুরি করার পরও অমন মন্তব্য করেছিলেন ক্রিকেট ইতিহাসের সব সময়ের সেরা ব্যাটসম্যান। ছয় বছর পর শেরে বাংলার পিচ সম্পর্কে শোনা গেল সে একই কথা।
ভাবছেন জিম্বাবুয়ান অধিনায়ক মাসাকাদজা কিংবা ভারতীয় বংশোদ্ভুত কোচ লাল চান্দ রাজপুত বুঝি শেরে বাংলার উইকেটকে ‘রহস্যময়’ বলেছেন? নাহ, এবার আর কোন ভিনদেশি নন। খোদ বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফির মুখেই অমন সংলাপ। আজ দুপুরে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে টাইগার ক্যাপ্টেন পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, আসলে শেরে বাংলার উইকেট ‘আনপ্রেডিক্টেবল।’ যার চরিত্র সত্যিই বোঝা দায়। কখন, কোন রকম আচরণ করবে- তা অনুমান করা কঠিন।
বলার অপেক্ষা রাখে না, শেরে বাংলা স্টেডিয়াম দেশের এক নম্বর ক্রিকেট ভেন্যু, হোম অফ ক্রিকেট। মানে দেশের ক্রিকেটের তীর্থ। খুব স্বাভাবিকভাবেই শেরে বাংলার উইকেট হবে বাংলাদেশের জন্য পয়োমন্ত, আদর্শ। টিম বাংলাদেশের উপযোগী। সেখানে খোদ বাংলাদেশ অধিনায়কের কাছেই যদি শেরে বাংলার উইকেট হয় দুর্বোধ্য, তার আচরণ যদি হয় রহস্যময়, এই মাঠের প্রথম ম্যাচ থেকে খেলে আসা মাশরাফিই যখন বলেন- শেরে বাংলার পিচের চরিত্র, আচরণ, গতি-প্রকৃতি বোঝা কঠিন। বিস্মিত হবার মতো খবরই, তাই না!
তবে কি শেরে বাংলার উইকেট বাংলাদেশের জন্য অপয়া? এই পিচে খেলতে কি সমস্যা হয় টিম বাংলাদেশের? উইকেটের আচরন সম্পর্কে অধিনায়ক মাশরাফির অমন মন্তব্য শুনে ভাবছেন বুঝি তাই। আসলে তা-ও নয়। মাশরাফি শেরে বাংলার উইকেটের চরিত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অমন মন্তব্য করেছেন।
তবে এও বলেছেন, শেরে বাংলার উইকেট যে আনপ্রিডিক্টেবল, সেটা তার দল মানে বাংলাদেশের জন্য সহায়ক। কারণ প্রতিপক্ষ দলগুলো এর চরিত্র ঠাউরে উঠতে পারে না। কখন কি আচরণ করবে, তা বুঝে উঠতে হিমসিম খায়। সেটা বরং টিম বাংলাদেশের জন্য প্লাস পয়েন্ট হিসেবেই কাজ করে।
তা যে করে, বাংলাদেশ যে শেরে বাংলার উইকেটেই সবচেয়ে ভালো খেলে পরিসংখ্যানই তার প্রমাণ। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ৩৩৭টি ওয়ানডে খেলেছে। যার তিন ভাগের এক ভাগ মানে ১০৮ টিতে জিতেছে। আর হার মেনেছে ২২৩ টিতে। চারটি ম্যাচের কোন ফল নিষ্পত্তি হয়নি।
যে ১০৮ ম্যাচ জিতেছে তার ৪৫ ভাগই শেরে বাংলায়। হোম অফ ক্রিকেটে ৮৮ টি একদিনের ম্যাচে অংশ নিয়ে টাইগাররা জিতেছে ৪২ টিতে। আর পরাজিত হয়েছে ৪৫ বার। একটি ম্যাচ পন্ড হয়ে গেছে। তার মানে পরিসংখ্যান জানান দিচ্ছে, বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাফল্যের সেরা ভেন্যুর নাম ‘শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়াম।’
হোম অফ ক্রিকেটের উইকেটের আচরণ রহস্যময়-এমন মন্তব্য করলেও মাশরাফির ধারণা, তার দলের সিনিয়র ক্রিকেটাররা এই পিচে খেলে খেলে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। আচরণ পাল্টালেও এই উইকেটে সম্ভাব্য করণীয় কি, তাও তাদের ভালো জানা। শেরে বাংলার পিচ সম্পর্কে তার নিজের মূল্যায়ন, ‘আমরা সবাই জানি মিরপুরের উইকেট সম্পর্কে ভবিষ্যতবাণী করা খুবই কঠিন। শেরে বাংলার উইকেট ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ শুরু করে। তাই আগে থেকে বলা খুবই কঠিন। তবে সাধারণত ২৫০-২৬০ রান হলে ম্যাচ ভালো হয়, আগে ব্যাট করা দলের জেতার সুযোগ বেশি থাকে।’
বাংলাদেশ অধিনায়ক নিজ দলের ক্রিকেটারদের কৃতিত্ব দিতে চান । কারণ হঠাৎ বদলে যাওয়া এই উইকেটেও তারা ভালো খেলেন এবং সাফল্য বয়ে আনেন। তাই তো মাশরাফির মুখে এমন সংলাপ, ‘আমাদের প্লেয়ারদের আমি ধন্যবাদ দেব। আমরাও বিশ্বাস করি মিরপুরের উইকেট আনপ্রেডিক্টেবল। হঠাৎ করেই আচরণ বদলে যায়। আপনারাও দেখেছেন হঠাৎ করে টার্ন বা বল নিচু হয়ে আসছে। তখন কিন্তু যারা ব্যাটিং করছে তাদেরও মাইন্ডসেট পরিবর্তন করতে হচ্ছে। বাইরে যারা থাকে তাদেরও মাইন্ডসেট পরিবর্তন করতে হয়। তবে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি।’
মাশরাফির অনুভব, উইকেটের এমন রহস্যময় আচরণ তার দলের জন্যই প্লাস পয়েন্ট। এ নিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনি যদি দেখেন উইকেটের এ দূর্বোধ্য আচরণ ও জটিল চরিত্র একক্ষেত্রে সুবিধাও। আচরণ যখন বদলাতে থাকে ,তখন প্রতিপক্ষের জন্য একটু কঠিন হয়। আমরা যখন ২০১৫ থেকে জেতা শুরু করেছি, তখন থেকে আমার মনে হয় এই মাঠে আমাদের রেকর্ড ভালো।’
তবে এই শেরে বাংলাতে কিন্তু কাছে গিয়ে হারের তিক্ত অতীতও আছে। মাশরাফি সেটাও জানেন, তারপরও এসব অজুহাত মাথায় আনতে চান না তিনি, ‘কিছু ম্যাচ হয়তো মানসিক দুর্বলতার কারণে আমরা হেরে গিয়েছি। এশিয়া কাপ ফাইনাল সেটাও বলতে পারেন। সেটা ছাড়া আমার মনে হয় এই উইকেটে আমাদের অ্যাডজাস্টমেন্ট একেবারে খারাপ না। চিটাগংয়ে যেটা হয় নরমালি আমরা জানি ব্যাটিং উইকেট হবে, ভালো উইকেট হয়। আপনি যেমন চান তেমন হবে। শেরে বাংলার উইকেট ঐ রকম না। তবে আমি নিশ্চিত, আমাদের ছেলেরা এতদিন খেলার পরে এমন কোন অজুহাত দেবে না। তবে একটা মাইন্ড সেট আপ থাকে, আছেও।’
তো কি সেটা? কি ঠিক করেছেন মাশরাফিরা? টাইগার ওয়ানডে অধিনায়কের জবাব, ‘ঐ যেটা আগেও বললাম , ২৫০-২৬০ রান। সেটাই লড়িয়ে পুঁজি। আগে ব্যাটিংয়ে নেমে ঐ রান করলে কাল জিম্বাবুয়ের জন্য কঠিন হবে।’
তার মানে অধিনায়ক মাশরাফি বলেই দিলেন, আচরণ যতই রহস্যময় হোক না কেন, মাঝে মধ্যে যতই গতি ও প্রকৃতি বদলাক; শেরে বাংলার পিচে আড়াইশোর বেশি রান ডিফেন্ড করা যায়। আবার ওই স্কোর তাড়া করতে হলেও বাংলাদেশের জন্য সেটা হবে কঠিন।
এআরবি/এমএমআর/আরআইপি