সেই বাংলাদেশ, সেই ক্রোয়েশিয়া
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে কতকিছু পরিবর্তন হয়ে যায়! ইতিবাচক পরিবর্তন, নেতিবাচক পরিবর্তন- কতকিছুই তো হয়। রাজনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রীয়- পরিবর্তনের জোয়ারে কতকিছু ঘটে যাচ্ছে। সে সঙ্গে তুমুল গতিতে এগিয়ে চলছে বিশ্ব। দিনের পর দিন মানুষ নিজ নিজ কর্ম দক্ষতায় উন্নতি করছে। সে হোক খেলাধুলা, হোক অর্থনীতি কিংবা আর্থ-সামাজিক অবস্থা।
১৯৯০-৯১ সাল। পৃথিবীর রাজনীতির মানচিত্রে বড় ধরনের ভূমিকম্প তৈরি হয়েছিল তখন। স্নায়ুযদ্ধের অবসান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বার্লিন দেয়াল ভেঙে এক হয়ে গেল দুই জার্মানি। পুঁজিতন্ত্রের অন্যতম শক্তি জার্মানরা একীভূত হলেও সমাজতন্ত্রের ধ্বজাধারী সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুগোস্লাভিয়া এবং চেকোস্লোভাকিয়া ভেঙে হলো খান খান। সোভিয়েত তো ভেঙে ১৫ টুকরো হলো। যুগোস্লাভিয়া প্রথমবার ভাঙার পরও কয়েকবার ভাঙনের শিকার হয়েছিল।
তবে, সার্বিয়ান সেনাবাহিনী এবং সার্ব জাতীয়তাবাদীদের দমন-পীড়নের মুখে সমাজতান্ত্রিক যুগোস্লাভিয়া ভেঙে তৈরি হয় নতুন রাষ্ট্র ক্রোয়েশিয়া। ১৯৯১ সালের জুনে স্বাধীনতা ঘোষণা করে ক্রোয়াটরা। অক্টোবরের ৮ তারিখ স্বাধীনতা অর্জন করে মাত্র ৪২ লাখ জনসংখ্যার দেশটি।
স্বাধীনতা অর্জনের আগে ক্রোয়েশিয়ান ফুটবলারদের খেলতে হতো যুগোস্লাভিয়ার হয়ে। স্বাধীনতার পর নিজেরাই গঠন করলো ফুটবল ফেডারেশন। ১৯৯৩ সালে ফিফা এবং উয়েফা প্রথম স্বীকৃতি দিল ক্রোয়েশিয়ান ফুটবল ফেডারেশনকে। ১৯৯৪ সালে বিশ্বকাপে খেলার জন্য চেষ্টাও করেনি তারা। ব্যস্ত ছিল নিজেদের পুনর্গঠনের কাজে। ক্রোয়াটদের ইচ্ছা, সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়েই তবে মহাদেশীয় এবং বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে অংশ নেবে।
এই লেখার শুরুতেই ‘পরিবর্তনে’র প্রসঙ্গ আনা হয়েছে এবং শিরোনামে ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে তুলে আনা হয়েছে বাংলাদেশের নামও। নিশ্চিত অবাক হওয়ার কথা, কোথায় ক্রোয়েশিয়া আর কোথায় বাংলাদেশ! অনেকেই হয়তো পাগল বলেও সাব্যস্ত করতে পারে।
তবে কেন এই প্রসঙ্গের অবতারণা, সেটা জানতে পারলে সবাইকেই অবাক হতে হবে। আফসোসেও পুড়বেন হয়তো কেউ কেউ। যৌক্তিক কারণেই এখানে ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করা হয়েছে। পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। পরিবর্তনের জোয়ারে ইতিবাচকতা ছিল ক্রোয়েশিয়ার ক্ষেত্রে। নেতিবাচকতা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে।
কীভাবে? সে বর্ণনার উদ্দেশ্যেই এই নিবন্ধের অবতারণা। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে ফিফা সদস্য দেশগুলোকে নিয়ে শুরু করে নতুন র্যাংকিং সিস্টেমের। তার আগে ছিল এলো র্যাংকিং। প্রতিটি দলের পারফরম্যান্সের ওপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট পয়েন্ট যোগ করা হয় এবং সেই পয়েন্টের ভিত্তিতেই নির্ণয় করা হয় র্যাংকিংয়ের অবস্থান।
১৯৯১ সালে ক্রোয়েশিয়া স্বাধীন হওয়ার পরই গঠন করা হয় দেশটির জাতীয় দল। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল তার অনেক আগে থেকেই আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলে। বাংলাদেশে তুমুল জনপ্রিয় ফুটবল খেলা। জাতীয় দলের খেলা তো দূরে থাক, ক্লাব ফুটবলে আবাহনী-মোহামেডান মুখোমুখি হওয়া মানেই ছিল এখনকার আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল মুখোমুখি হওয়ার চেয়েও দর্শক-সমর্থকদের মধ্যে বেশি উত্তেজনা তৈরি হওয়া।
ফিফা র্যাংকিংয়ে এক সময় বাংলাদেশের অবস্থান দেখলে এখনকার প্রজন্ম হয়তো বিশ্বাসই করতে চাইবে না। র্যাংকিংয়ে সর্বোচ্চ বাংলাদেশ পৌঁছেছিল ১১০তম স্থান পর্যন্ত। ১৯৯৬ সালের ১ এপ্রিল। ১৯৯৪ সালের মার্চে এই ক্রোয়েশিয়ার অবস্থান ছিল ১২৫তম স্থানে। ওই সময়টায় (১৯৯২-১৯৯৬ সাল পর্যন্ত) বাংলাদেশের অবস্থান ১১০ থেকে ১২০-এর মধ্যেই ঘুরাঘুরি করছিল।
বুধবার রাতে ইংল্যান্ডকে ২-১ গোলে হারিয়ে ক্রোয়েশিয়া রাশিয়া বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছে যাওয়ার পর আজ (বৃহস্পতিবার) বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি স্ক্রিনশট ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে ফিফা র্যাংকিংয়ে আজকের ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবধান ছিল মাত্র তিন ধাপের। তখন ক্রোয়েশিয়ার অবস্থান ছিল ১১৬তম স্থানে। বাংলাদেশ ছিল ১১৯তম স্থানে। শুধু তাই নয়, এবার নতুন দেশ হিসেবে বিশ্বকাপে খেলা পানামা ছিল বাংলাদেশের পেছনে। ১২৭তম স্থানে।
১৯৯৩ সালে ক্রোয়েশিয়া ১১৬তম স্থানে হলেও তাদের অবস্থান আরও পেছনে যায়। ১২৫তম স্থানেও চলে গিয়েছিল তারা। অথচ, তিন বছর পরও বাংলাদেশের অবস্থান ছিল আরও এগিয়ে। অর্থাৎ, ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে ছিল ১১০তম স্থানে।
ফিফা র্যাংকিংয়ের যে ছবিটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে এবং সেখানে যে সময়ের কথা লেখা রয়েছে, ওই সময়টায় বাংলাদেশ ঘরের মাঠে সাফ গেমসে খেলছিল (এখনকার সময়ের এসএ গেমস)। ১৯৮৫ সালে প্রথম সাফ গেমসের আয়োজক ছিল বাংলাদেশ। সেবার সাফ গেমস ফুটবলের ফাইনাল খেলেছিল স্বাগতিকরা এবং টাইব্রেকারে ভারতের কাছে হেরে যেতে হয়েছিল। টাইব্রেকারে একমাত্র কায়সার হামিদ ছাড়া বাংলাদেশের আর কেউ শট ভারতের জালে জড়াতে পারেননি।
আট বছর পর ঘরের মাঠে সাফ গেমস ফুটবলে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে মালদ্বীপের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করে বাংলাদেশ। খেলায় পেনাল্টিও পেয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু কায়সার হামিদ সেই পেনাল্টি মিস করেন। আট বছর আগে যারা সাফ গেমসের ফাইনাল খেলেছিল, ঘরের মাঠে আট বছর পর তারাই কি না আর সেমিফাইনালেও উঠতে পারেনি।
অথচ, গেমস শুরুর ১০-১২ দিন আগেও ঢাকার মাঠে এশিয়ান ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইয়ে মালদ্বীপের রেডিয়েন্ট ক্লাবকে ৮-১ গোলের বিশাল ব্যবধানে হারিয়েছিল মোহামেডান। ওই ম্যাচে ডিফেন্ডার হয়েও কায়সার হামিদ করেছিলেন ২ গোল। সেই রেডিয়েন্ট ক্লাবের ৯ জন খেলেছিল পরে মালদ্বীপ জাতীয় দলের হয়ে এবং তারাই কয়েকদিন পর রুখে দিয়েছিল বাংলাদেশকে।
বিশেষজ্ঞদের মত হচ্ছে, বাংলাদেশ ফুটবলের অধঃপতনের সূচনা মূলত তখন থেকেই শুরু। ওই সময় বাংলাদেশ দলে কারা খেলতেন, নাম শুনলে পিলে চমকানোর কথা। মহসিন, কানন ছিলেন গোলরক্ষক। এছাড়া কায়সার হামিদ, মোনেম মুন্না, জুয়েল রানা, মাসুদ রানা, সাব্বির, রুমি, আসলামরা ছিলেন ওই দলে। তাদের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স ছিল বিশ্বসেরা না হোক, অন্তত এশিয়ার অন্যতম সেরা।
সেই থেকে বাংলাদেশের ফুটবলের যে পরিবর্তন, তা নেতিবাচক। ক্রমেই পেছনে হেঁটেছে বাংলাদেশের ফুটবল। ধীরে ধীরে যেন অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছে এ দেশের ফুটবল। এখন এই দেশটি অবস্থান করছে ফিফার ১৯৪তম র্যাংকিংয়ে। সর্বনিম্ন ১৯৯৮তম স্থানেও পৌঁছেছিল বাংলাদেশের লাল-সবুজ জার্সিধারীরা।
বিপরীতে ক্রোয়েশিয়ার পরিবর্তনটা খেয়াল করুন! কতটা ইতিবাচক সেটা বলেও হয়তো বোঝানো যাবে না। ফুটবল আকাশে ক্রোয়েশিয়ার উদয় যেন ধূমকেতুর ন্যায়। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে প্রথমবার এসেই সেমিফাইনাল খেলেছিল পূর্ব ইউরোপের দেশটি। ডেভর সুকার জিতেছিলেন সর্বোচ্চ গোলদাতা গোল্ডেন বুটের পুরস্কার।
ক্রোয়েশিয়ার হঠাৎ এই উত্থানে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন অনেক ফুটবলবোদ্ধা। ১৯৯১ সালে পূর্ব ইউরোপে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে নতুন স্বাধীনতা পাওয়া ক্রোয়েশিয়াকে ১৯৯৮ বিশ্বকাপের আগেও বাংলাদেশের মানুষ চিনতো না বললেই চলে। কিন্তু এই এক বিশ্বকাপ দিয়েই বিশ্ববাসীর মতো বাংলাদেশের মানুষও জেনেছে ক্রোয়েশিয়া নামে একটি দেশ আছে।
১৯৯৬ সালে ইউরো চ্যাম্পিওয়নশিপে প্রথম কোনো টুর্নামেন্টে অংশ নেয় দেশটি। বিশ্বকাপে অভিষেক ১৯৯৮ সালে ফ্রান্সে এবং অভিষেকেই বাজিমাত। সেমিফাইনালে খেলার পর তারা বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে হয়েছে তৃতীয়। স্বাধীন ক্রোয়েশিয়া দল গঠন করার পর এত দ্রুত দলটির উত্থান ঘটেছে যে, ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত তাদেরকে বলা হতো ‘বেস্ট মোভার অব দ্য ইয়ার।’
কলম্বিয়ার পর দ্বিতীয় দল হিসেবে ফিফার দেয়া এই খেতাব জিতেছে শুধু ক্রোয়েশিয়াই। এর কারণ, ফিফা র্যাংকিংয়ে ক্রোয়েশিয়া ছিল ১২৫তম স্থানে। চার বছরের ব্যবধানে এই দলটিই র্যাংকিংয়ে দখল করে নিয়েছিল তৃতীয় স্থান। ১২৫তম স্থান থেকে চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তৃতীয় স্থানে উঠে আসা সত্যিই বিস্ময়কর ঘটনা।
১৯৯৮ সালে সেমিফাইনাল খেললেও ক্রোয়েশিয়াকে কিন্তু পরের আসরগুলোতে খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায়নি। ২০০২ এবং ২০০৬ বিশ্বকাপে তারা বিদায় নিয়েছিল গ্রুপপর্ব থেকেই। ২০১০ সালে র্যাংকিংয়ে শীর্ষ দশে থাকলেও বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। ২০১৪ বিশ্বকাপে খেললেও ক্রোয়াটদের বিদায় নিতে হয়েছিল গ্রুপ পর্ব থেকে।
এবার তারা ছাড়িয়ে গেছে ১৯৯৮ সালের সাফল্যকেও। এই প্রথমবারের মতো লুকা মদ্রিচ, ইভান রাকিটিচরা ক্রোয়েশিয়াকে তুলে এনেছেন বিশ্বকাপের ফাইনালে। ১৫ জুলাই ফ্রান্সকে হারাতে পারলে প্রথমবারের মতো নয় শুধু, বিশ্বকাপে নতুন চ্যাম্পিয়ন হবে ক্রোয়েশিয়া। স্বাধীনতার ২৭ বছরের ব্যবধানে বিশ্বকাপের শিরোপা ঘরে তুলবে তারা।
অথচ, কখনও কখনও র্যাংকিংয়ে এই ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা বাংলাদেশে এখন ফুটবল গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত। আলোর রেখা দেখা পাওয়ার কোনোই সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে না। ক্রমান্বয়ে আর গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের ফুটবল। ভুটানের মতো দেশের কাছেও হারতে হয় এখন বাংলাদেশকে। এশিয়ান পর্যায় তো দূরে থাক, সাফ ফুটবল এখন দুঃস্বপ্নের মতো বাংলাদেশের কাছে।
একজন ফুটবলার নেই, যার খেলা দেখতে ফুটবল পাগল মানুষ ছুটে যাবে খেলার মাঠে। গলা ফাটাবে গ্যালারিতে। এ কারণেই তো নিজ দেশ বাদ দিয়ে একের পর এক বিশ্বকাপ আসে আর বাংলাদেশের মানুষ বিদেশি পতাকা উড়িয়ে মাতে বিশ্বকাপ উন্মাদনায়। নিজ দেশের পতাকা ওড়ানোর মতো খেলাই যে আর কখনও খেলার সম্ভাবনা নেই বাংলাদেশের! বাংলাদেশের ফুটবল সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যদি এই বিষয়টা উপলব্দি করতেন!
বিএ