২০০২: এশিয়া থেকেও বিশ্বকাপ জিতলো ব্রাজিল
আমেরিকা আর ইউরোপের বাইরে যেন বিশ্বকাপ আসাটাই মহাপাপ। ঘুরেফিরে এর আগের ১৬টি বিশ্বকাপই অনুষ্ঠিত হয়েছে ইউরোপে কিংবা আমেরিকায়। অন্য কোথাও বিশ্বকাপের আসর বসুক তাতে বেকেনবাওয়ার, মিশেল প্লাতিনিরা পর্যন্ত বিরোধিতা করেছিলেন; কিন্তু বিশ্বায়নে বিশ্বাসী ফিফার নীতির কারণে শেষ পর্যন্ত প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের আসর বসল এশিয়ায়।
শুধু তাই নয়, বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যৌথ আয়োজক হলো দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপান। বরাবরের মতোই যে দেশটি নিজ মহাদেশের বাইরে থেকে বিশ্বকাপ জয়ের রেকর্ড গড়ে সেই ব্রাজিলই এশিয়া থেকে পঞ্চমবারের মতো শিরোপা জিতে নিয়ে গেল নিজ দেশে। এর আগে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং নিজের মহাদেশ লাতিন আমেরিকা থেকেও বিশ্বকাপ শিরোপা জিতেছিল ব্রাজিল।
২০০২ সালে নতুন শতাব্দীর আসরটা সত্যিকার অর্থেই এশিয়ার জন্য ছিল একটি চ্যালেঞ্জের। আয়োজনের দিক থেকে শেষ পর্যন্ত শতাব্দীর সেরা আয়োজন হিসেবেই স্বীকৃতি পেল কোরিয়া-জাপানের বিশ্বকাপ। আবেগ. শিহরণ.. আর বিস্ময়... জাগানো বিশ্বকাপ বলতে যা বোঝায় কোরিয়া-জাপান বিশ্বকাপের এর কমতি ছিল না কিছুতেই।
একদিকে ব্রাজিল-জার্মানি, অন্যদিকে আয়োজক দক্ষিণ কোরিয়া আর তুরস্ক। রিভালদো-রোনালদো জুটির মাঠ কাঁপানো পারফরম্যান্স, অলিভার কানের বিখ্যাত ভুল, সেমিফাইনাল তুরস্ক আর আয়োজক দক্ষিণ কোরিয়া এবং তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে হাকান সুকুরের ১১ সেকেন্ডের দ্রুততম গোল- কী ছিল না এই বিশ্বকাপে!
প্রথম রাউন্ডে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে ১-০ গোলে হারিয়ে আফ্রিকান নতুন সেনসেশন সেনেগালিজদের যে উল্লাস দেখেছে বিশ্ব, তাতে ২০০২ বিশ্বকাপটা চিরদিনই মনে থাকবে সবার মনে। সেনেগালিজ ফুটবলার হেনরি কামারা আর এল-হাজি দিউফ। সঙ্গে ‘পাগলা’ কোচ ব্রুনে মেতসু। তাদের উদযাপনের ভঙ্গিটাও ছিল ওই বিশ্বকাপের বড় বিজ্ঞাপন। ওই বিশ্বকাপে সব অঘটন ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছিল সেনেগালের কাছে চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের পরাজয়।
সেনেগালিজরা সুইডেনকে দ্বিতীয় রাউন্ডে ২-১ গোলে হারিয়ে চলে গিয়েছিল কোয়ার্টার ফাইনালেও। হেনরি কামারা ছিলেন জোড়া গোলের নায়ক; কিন্তু কোয়ার্টারে তাদের জয়যাত্রা থামিয়ে দেয় তুরস্ক। ডাচ্-জাদুকরী কোচ গাস হিডিঙ্কের ছোঁয়ায় যেন সেবার দক্ষিণ কোরিয়া হয়ে উঠেছিল ইউরোপের কোনো এক প্রতিষ্ঠিত শক্তি।
পোল্যান্ডকে হারিয়ে স্বাগতিকদের জয়যাত্রা শুরু হয়। ১৯৫৪ বিশ্বকাপে প্রথম অংশ নেয়ার ৪৮ বছর পর এই প্রথম বিশ্বকাপে কোনো জয় পেল দক্ষিণ কোরিয়া। পরের ম্যাচে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ১-১ গোলে ড্র আর পর্তুগালকে ১-০ গোলে হারিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে চলে যায় পার্ক জি সুংরা।
পর্তুগালকে হারানোর নায়কও এশিয়ার জিদান নামে পরিচিত পার্ক। দ্বিতীয় রাউন্ডে ২-১ গোলে ইতালিকেই হারিয়ে দেয় স্বাগতিকরা। এরপর কোয়ার্টার ফাইনালে দক্ষিণ কোরিয়া বিদায় করে দেয় স্পেনের মত শক্তিশালী দেশকেও। নির্ধারিত ৯০ মিনিটের পর অতিরিক্ত ৩০ মিনিটেরও খেলা শেষ। টাইব্রেকারে স্পেনকে ৫-৩ গোলে হারিয়ে দিয়ে সেমিফাইনালে চলে যায় দক্ষিণ কোরিয়া।
সেমিতে জার্মানির কাছে ১-০ গোলে হেরেই বিশ্বকাপে স্বপ্নের দৌড় শেষ হয়ে যায় কোরিয়ানদের। শেষ পর্যন্ত তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে তুরস্কের কাছে ৩-২ গোলে হেরে চতুর্থ স্থানেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় স্বাগতিক দক্ষিণ কোরিয়াকে।
অপর অঘটন সৃষ্টিকারী দল তুরস্ক প্রথম পর্বে ব্রাজিলের সঙ্গেই গ্রুপ ‘সি’ থেকে উঠে আসে দ্বিতীয় রাউন্ডে। দ্বিতীয় রাউন্ডে জাপানকেও ১-০ গোলে হারিয়ে কোয়ার্টারে, সেনেগালকে হারিয়ে সেমিফাইনালে পৌঁছে যায় তারা। সেমিতে আবারও দেখা হয় ব্রাজিলের সঙ্গে। রোনালদোর গোলে ১-০ ব্যবধানেই বিদায় নিতে হয় তুরস্ককে।
বিশ্বকাপে আরেক স্বাগতিক জাপানও এবার সবচেয়ে সহজ গ্রুপ থেকে রাশিয়া আর তিউনিশিয়াকে হারিয়ে দিয়ে বেলজিয়ামের সঙ্গে উঠে যায় দ্বিতীয় রাউন্ডে। দ্বিতীয় রাউন্ডে তুরস্কের কাছে তারা হেরে যায় ১-০ গোলে। জাপান-কোরিয়ার প্রথম রাউন্ড পার হওয়ার মধ্য দিয়ে কোনো বিশ্বকাপে স্বাগতিকদের প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় না নেওয়ার রেকর্ড অব্যাহত থাকলো সেবারও।
ফাইনালে জার্মান গোলরক্ষক অলিভার কানের ‘বিখ্যাত ভুলে’, রোনালদোর জোড়া গোলে শিরোপা পঞ্চমবারের মতো চলে যায় ব্রাজিলের ঘরে। ৮ গোল করে রোনালদো জেতেন গোল্ডেন বুটের পুরস্কার আর অলিভার কান বিশ্বকাপের ইতিহাসে একমাত্র গোলরক্ষক যিনি যেতেন গোল্ডেন বলের পুরস্কার। রোনালদো একমাত্র ফুটবলার, যিনি দুই বিশ্বকাপের একটিতে জেতেন গোল্ডেন বল আর অন্যটিতে জিতলেন গোল্ডেন বুটের পুরস্কার।
আইএইচএস/আরআইপি