যেভাবে বাংলাদেশ পৌঁছে যায় বিশ্বকাপে
লাভের লাভ, মাঝখান দিয়ে বিরাট খাতির হয়ে গেল ফিফা মিডিয়া কমিটির প্রধান অ্যালেইন লিবল্যাংয়ের সঙ্গে। এতটাই যে তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে অবসর জীবনে চলে গেলেও এবং সেই বিশ্বকাপের আট বছর পেরিয়ে গেলেও আজও ই-মেইল চালাচালি হয়। অম্লান সম্পর্ক। সেই সম্পর্কের সুবাদে ফিফা এবং আন্তর্জাতিক ফুটবলের গতিবিধি জানা হয় খুব সহজেই। গত বছর চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল কাভার করার বিরল সুযোগটা মেলার ক্ষেত্রেও সেই সম্পর্কটা কাজ করেছে প্রভাবকের মতো।
যাই হোক, সম্পর্কের এই গল্পটা টেনে আনার কারণ প্রথমত, এখানে বিশ্বকাপ ফুটবল আছে। তার চেয়েও বেশি করে আছে বিশ্বকাপ উপলক্ষে বাংলাদেশের মিডিয়ার কাভারেজের শক্তি। তখন কালের কণ্ঠ মাত্র প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রথম দৈনিক হিসেবে প্রতিদিন চার পাতা খেলা। সাধারণ পাঠক মহলে তুমুল সাড়া।
কিন্তু তাদের সাড়া বাংলাদেশের ফুটবল ফেডারেশন পর্যন্ত পৌঁছাবে না স্বাভাবিক। তাই অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড দেওয়ার সময় আমাদের চার পাতার বিশাল আয়োজন, বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে বিপুল প্রস্তুতি, অল্প সময়ে প্রায় অবিশ্বাস্য সার্কুলেশন- এসব কিছুই বিবেচ্য হলো না। অনেক দাবি, অনেক তদ্বির, অনেক ধরাধরির পর কিছু না হওয়াতে সিদ্ধান্ত হলো সরাসরি আয়োজকদের সঙ্গে যোগাযোগের।
ততদিনে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা দুই দলের কোচ ম্যারাডোনা এবং দুঙ্গার এজেন্টের সঙ্গে কলাম লেখার বিষয়ে চুক্তি হয়ে গেছে। ‘প্রতিদিন বিশ্বকাপ’ নামে আট পৃষ্ঠার আলাদা আয়োজন থাকবে পত্রিকার সঙ্গে। কুইজের প্রথম পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হবে বসুন্ধরায় জমি। এই বিরাট আয়োজন বিরাট শূন্যতায় পরিণত হবে যদি নিজেদের প্রতিনিধিকে দক্ষিণ আফ্রিকা পাঠানো না যায়।
কয়েক মাস আগে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করে এসেছে মাসুদ পারভেজ, তখন বিশ্বকাপের ঢোল বাজতে শুরু করেছে, পারভেজ পরিচিত হয়ে এসেছেন স্থানীয় আয়োজকদের একজনের সঙ্গে। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে যোগাযোগ হলো তার সঙ্গে। ভদ্রলোক ক্ষমা চেয়ে যা জানালেন তা এ রকম, ‘আমাদের বিষয়টা আন্তরিকভাবে দেখলেও তাদের করার কিছু নেই। এ ক্ষেত্রে একমাত্র কিছু করার ক্ষমতা আছে ফিফার।’
‘দাও তাহলে ফিফার সংশ্লিষ্ট কর্তার যোগাযোগের ঠিকানা।’ তিনি দিলেন। ফিফায় মেইল করা হলো। অবিলম্বে সেটা প্রত্যাখ্যাতও হয়ে গেল; কিন্তু তখন আমাদের অবস্থা এমন যে হাল ছাড়ার উপায়ও নেই। আবার ফিরতি মেইল করা হলো এবং তাতে আমাদের বিশ্বকাপ আয়োজনে প্রস্তুতির বিস্তারিত সংযুক্ত করে দেওয়া থাকল।
এরপর অপেক্ষা। প্রথমবার প্রত্যাখ্যানের মেইলটি সঙ্গে সঙ্গে মিলেছিল; কিন্তু এবার সাড়া নেই। আমরা ভাবলাম, আমাদের এই বাড়াবাড়ি আবদারে বিরক্ত হয়ে সম্ভবত তারা আর পাল্টা যোগাযোগের কারণ দেখছে না। ওদের তো হাজারটা কাজ। কোথাকার কোন বাংলাদেশের একটি পত্রিকার অ্যাক্রিডিটেশন নিয়ে পড়ে থাকলে তো আর চলবে না।
কিন্তু আমরা তখন ভব্যতার যে কোনো সীমা অতিক্রম করতে তৈরি। এবার নম্বর জোগাড় করে মিডিয়া সেকশনে ফোন করা হলো। ফোনে কথোপকথনটা ছিল এ রকম, ‘কী চাইছেন?’
‘অ্যাক্রিডিটেশন বিষয়ে কথা বলতে চাই?’
‘অ্যাসোসিয়েশনের নাম?’
‘বাংলাদেশ।’
‘তোমাদের অ্যাক্রিডিটেশনের আবেদনগুলো পাওয়া গেছে। যথাসময়ে কনফার্মেশন চলে যাবে।’
‘আমরা আসলে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন না, আমাদের পত্রিকাকে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অ্যাক্রিডিটেশন দেয়নি, যদিও পাওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি।’
‘আমরা অত্যন্ত দুঃখিত। এই বিষয়টা পুরোপুরি ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের দায়িত্ব। তোমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করো।’
‘লাভ তো হচ্ছে না।’
‘তবু যোগাযোগ করো।’
‘ওরা তো আমাদের কথা শুনছে না।’
‘আমাদের এখানে কিছু করার নেই।’
এরপর হাল ছেড়ে দেওয়া ছাড়া কিছু করার থাকে না। যে এজেন্টের মাধ্যমে ম্যারাডোনা-দুঙ্গার কলাম জোগাড় করা হয়েছিল শেষ চেষ্টা হিসেবে তার সঙ্গেও যোগাযোগ করা হলো। ব্যবসার একটা সম্পর্ক, কাজেই সরাসরি না করে বলল, ‘আমাদের একটু সময় দাও।’
সময় দেওয়া হলো। কিন্তু সেই সময় আর শেষ হয় না। ওদিকে বিশ্বকাপ এগিয়ে আসছে। হলো না বোধহয় আর। বিপুল আয়োজনের মধ্যে একটা শূন্যতার সুর বাজে।
এর মধ্যে একদিন সকালবেলা অফিসে এসে মেইল খুলতেই একটা অপরিচিত নামের মেইল দেখলাম। কৌতূহলবশত খুলেই দেখি মেইলকারী শুরুতেই নিজের পরিচয় দিয়ে বলছেন, ‘আমি অ্যালেইন লিবল্যাং, ফিফার মিডিয়া অপারেশন্স এর প্রধান...।’
এরপরের লাইনগুলো একই সঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে গেল বিস্ময় এবং মুগ্ধতায়। কারণ ভদ্রলোক লিখেছেন, ‘তোমাদের এই আয়োজনের প্রস্তুতি দেখে আমি অবাক হয়েছি। বাংলাদেশের মিডিয়াগুলো বিশ্বকাপ নিয়ে এত সিরিয়াস! তোমার দাবি দেখে কৌতূহলবশত আমি বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোর ওয়েবসাইটে গিয়েছিলাম। গিয়ে অবাক। সেভাবে ফুটবলবিশ্ব তোমাদের চেনে না, তোমাদের দলও সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলে না অথচ বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে তোমাদের কী উন্মদনা!’
তারপর সেই কাঙ্ক্ষিত শেষ লাইন, ‘তাই আমি বিশেষ বিবেচনায় তোমাদেরকে একটা অ্যাক্রিডিটেশন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। খুব তাড়াতাড়িই আমার সহকর্মীরা এই বিষয়ে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে।’
তারপর দক্ষিণ আফ্রিকার সেই বিশ্বকাপে গেলাম। এতদিন জানতাম, এবার চোখেই দেখলাম, বিশ্বকাপ ফুটবল কীভাবে মানুষের, মানবতার মিলনের মহামঞ্চ হয়ে ওঠে। লিবল্যাংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। আমার কৃতজ্ঞতার জবাবে ভদ্রলোক শুধু বলেন, ‘যাই বলো, তোমাদের মিডিয়ার বিশ্বকাপ আয়োজন অবিশ্বাস্য।’
সত্যিই অবিশ্বাস্য। বিশ্বকাপ কাভার করার সময় দক্ষিণ আফ্রিকায় মানুষের উত্তুঙ্গ উন্মদনা দেখেছি। দেখেছি দিন-রাত এক করে দেওয়া সমর্থকদের পাগুলে ফুটবলপ্রেম। আমাদের মানুষের সেই সুযোগ নেই, কিন্তু আমরা ভাগ্যবান সাংবাদিকদের কেউ কেউ সেই সুযোগ পেয়ে যাই। আর যারা পায় না, তারাও দেশে বসে, সেই উত্তেজনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্বকাপকে রঙের মোড়কে ভরে মানুষের কাছে তুলে ধরার যে আন্তরিকতা দেখায় তাতেই বাংলাদেশ মিডিয়ার বিশ্বকাপ আয়োজন পৌঁছে যায় বিশ্বমানে।
এবার তৎপরতা বোধহয় আরো বেশি। প্রমাণ! অন্য অনেক প্রমাণ আছে কিন্তু এটাও তো প্রমাণ যে ‘জাগোনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম’ বিশ্বকাপের প্রায় এক মাস আগে বিশেষ প্রস্তুতি শুরু করেছে। বের করে ফেলছে বিশ্বকাপ স্পেশাল, ‘বিশ্বকাপের মাতাল হাওয়া’।
তাদের এই উদ্যোগ দেখে নিশ্চিত হচ্ছি, এবার বাংলাদেশের মিডিয়ার আয়োজন আরো স্বপ্নিল হবে। দল বিশ্বকাপে না থাকতে পারে; কিন্তু মানুষের আবেগ এবং মিডিয়ার আয়োজনের এই পথবেয়ে বাংলাদেশ ঠিকই বিশ্বকাপে পৌঁছায়!
আইএইচএস/জেআইএম