‘পেলে-ম্যারাডোনা যা পারেনি, আমি তা পেরেছি’
কলম্বিয়ার সাবেক গোলরক্ষক রেনে হিগুইতা ফুটবল ইতিহাসের পাতায় এখনও অমলিন হয়ে আছেন। গোলকিপিংয়ে তার অনন্য স্টাইল, সাহসী পদক্ষেপ ও নতুন ঘরানার খেলার ধরন তৈরির জন্য এখনও ফুটবলপ্রেমীদের মনে গেঁথে আছে তার নাম।
তার খেলার ধরনের মতোই ব্যক্তিজীবনেও দারুণ খোলামেলা ও ঠোঁটকাটা স্বভাবের এই তারকা ফুটবলার ফিফা ডট কমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন তার গোলকিপিং এর দর্শন , ফুটবল সম্পর্কে তার খেলার ধরণ ও এবারের বিশ্বকাপের কলম্বিয়ার সম্ভাব্যতা সম্পর্কে। হিগুইতার এই সাক্ষাৎকার তুলে ধরা হলো জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য...।
ফিফা ডট কম : আপনি প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে গোলকিপিং করছেন; কিন্তু বিশ্বকাপ খেলেছেন একবার। ইতালি ১৯৯০ বিশ্বকাপ আপনার ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল?
রেনে হিগুইতা : অসাধারন অনুভূতি। আমরা এমন এক সময় বিশ্বকাপ খেলেছিলাম, যেটা কলম্বিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সে সময়টি কলম্বিয়ান ফুটবলের জন্য বেশ খারাপ একটা সময় চলছিল। ২৮ বছর পর আমরা বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়েছিলাম খেলোয়াড় হিসেবে বলুন কিংবা দেশ হিসেবে বলুন- এটা কলম্বিয়ার ফুটবলকে নতুন করে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। বিশ্বকাপ সবসময়ই দারুণ কিছু। ক্লাব ফুটবল কিংবা আন্তর্জাতিকের সাধারণ একটি ম্যাচ কখনই বিশ্বকাপের সঙ্গে তুলনা হতে পারে না।
ফিফা : বিশ্বকাপে দ্বিতিয় রাউন্ডে ক্যামেরুনের বিরুদ্ধে সেই হারের জন্য আপনাকে দায়ী করা হয় । রজার মিলার দ্বিতীয় গোলটির কথা কি মনে আছে এখনও?
হিগুইতা : ক্যারিয়ার শেষে আমার জীবনে খারাপ দিকের চেয়ে ভালো দিকটাই বেশি ঘটেছে। ক্যামেরুনের বিরুদ্ধে ওই ম্যাচটিও উত্তরণেরই একটি ধাপ। যেটা ফুটবলকে নতুন একটি চেহারাও দিয়েছে। লোকে দেখেছে, রেনে হিগুইতা এভাবেই খেলে এবং সে খেলার নতুন একটি ধরণ তৈরি করেছে। গোলরকক্ষরাও পা দিয়ে খেলতে পারে, বল ব্যাক পাস করে বিপক্ষকে ধরাশায়ী করতে পারে এটা দেখেছে রেনের মাধ্যমে। আমি ফুটবলের ক্ষেত্রে যে ধরণ তৈরি করেছি, তা এমনকি পেলে, ম্যারাডোনা বা মেসিও পারেনি। একটা সময় এটা হিগুইতার ধরণ নামে স্বীকৃতিও পেয়েছে। ভুল হয়েছিল বটে; কিন্তু গোলরক্ষকদের খেলার মধ্যে সাহসী হতে শেখানোর বিষয়টা তো করেছি ।
ফিফা: এটা সাহসী সিদ্ধান্ত কিন্তু বেশ বিপজ্জনকও...!
হিগুইতা : ৯০-এর বিশ্বকাপে ক্যামেরুনের বিরুদ্ধে সে ম্যাচে আমরা অতিরিক্ত সময়ে (১০৬মিনিট) ১-০ গোলে পিছিয়ে ছিলাম। সুতরাং আমাদের রিস্ক নিতেই হতো। অনভিজ্ঞ দল হিসেবে আমরা ২-০, ৩-০ বা ৪-০ তেও হারতে পারতাম। তাতে কিন্তু কোনো সমস্যা হতো না। সমস্যা হল, সেদিন যখন ২-০ তে পিছিয়ে থাকার পর ২-১ করে ফেললো। তখন সবাই বলা শুরু করলো, হিগুইতা যদি এমন না করত তাহলে হয়তো আমরা ‘ড্র’ করতাম। আমাকে অতিরিক্ত দায়ী করাটা উচিত নয়। ফুটবলে অতীত বলে কিছু নেই। যা আছে সবই বর্তমান। আর বর্তমানটা হল, ৯০ মিনিট দীর্ঘ।
ফিফা : আপনার কি মনে হয়, লোকে রজার মিলার গোলটিকে উপেক্ষা করছে?
হিগুইতা : অবশ্যই। আপনি এটাকে দুভাবেই দেখতে পারেন। আমার মনে পড়ে, রজার আমার দিকে দৌড়াচ্ছিল যখন লুইস কার্লোস আমাকে ব্যাক পাস করে। এটা অনেকটা ফাউলের মতো ছিল; কিন্তু রজার বলটিকে নিয়ে গেলো এবং গোল করলো। এটা সম্পূর্ণ রজার মিলার ক্রেডিট। আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক যে, এটা ক্যামেরুনের দ্বিতীয় গোল ছিল।
আর কলম্বিয়ার হয়ে সেদিনের শেষ মুহূর্তের গোলটি আমার ভুলটিকে অনেক বেশি দৃষ্টিগোচর করেছে। আমি খুব বেশি ভুল করিনি। সে সময় ম্যাচে ওটাই আমার পজিশন ছিল, আর আমাদের সেভাবেই খেলার প্রয়োজন ছিল। আমি বর্তমান বার্সেলোনার হয়ে খেলাটাকে বেশি পচ্ছন্দ করতাম। যথাসম্ভব দূরে বল হিট করো, এক-দুই পাসে খেলো, স্পেস তৈরি করো। বর্তমানে এই ধরনের খেলা দিনকে দিন ক্রমবিকাশ হচ্ছে।
ফিফা : ‘হিগুইতা স্টাইল’ খেলার ধরণ কিভাবে এলো?
হিগুইতা : এটা প্রকৃতিগত। অনেকের ধারনা এটা হুগো গাত্তির (বোকা জুনিয়র্স, আর্জেন্টিনা) খেলাকে মডেলিং করা হয়েছে। আমার মনে আছে, যখন ছোটবেলা স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যেতাম, তখন সেরা গোলরক্ষকদের দেখতাম। যখন ফরওয়ার্ডরা আক্রমণে আসতো, তখন তারা বলকে আউট সাইডে পাঠিয়ে দিত। ভাবতাম উনারা কি পা দিয়ে বল খেলতে পারে না? বল যদি বাইরে না পাঠিয়ে খেলাটা তৈরি করে দিত তবে তো স্কোরের সুযোগ বেড়ে যায়। তাহলে উনারা কেন বল বাইরে পাঠিয়ে বিপক্ষকে পুনরায় আক্রমণের সুযোগ দেয়?
ফিফা : তাহলে খেলার এই ধরনের পেছনে বলের প্রতি আপনার তীব্র আকর্ষণ থেকেই কি এসেছে?
হিগুইতা : বল আমার কাছে ক্রিস্টমার্সের উপহারের মতো একটি খেলনা। এটা কখনই ছেড়ে দেয়া যাবে না। আপনি ছাড়বেন তো এটা পুনরায় পাওয়ার জন্য লড়াই করতে হবে। আমি কখনই বলের জন্য লড়তে চাই না। আমি চাই বল আমার ও আমার দলের কাছেই থাকুক সবসময়। আমি এভাবেই খেলাটাকে বুঝতে চাইতাম এবং এভাবে খেলা পরিবর্তনও হয়েছে।
ফিফা : বর্তমান সময়ের কোন গোলরক্ষককে পচ্ছন্দ করেন?
হিগুইতা : ম্যানুয়েল নুয়্যার। সে মাঠে নামে, খেলে এবং দলকে সাহায্য করে। অসাধারণ একজন খেলোয়াড়। বর্তমান সময়ে গোলরক্ষকদের পায়ের নৈপুন্যের ব্যাপারেও বেশ কার্যকরী হওয়াটা জরুরী। আমার মনে হয় দলকে এভাবে দারুণ সার্ভিস দেয়া সম্ভব, হয়তো কিছু ভুল হতে পারে। তবে হাস্যকর কোনো ভুল বা দলকে বুঝেশুনে কখনো বিপদে ফেলিনি। আমি তাই করেছি যা ছিল সেই সময়ের জন্য সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি।
ফিফা : ব্রাজিলের পর রাশিয়া বিশ্বকাপেও কলম্বিয়া যাচ্ছে। সেখানে তারা কতদূর যেতে পারে?
হিগুইতা : তাদের জন্য শুভকামনা। তারা বিশ্বকাপ খেলছে এবং চমকে দেবার মতো পারফর্ম করবে। হামেশ রদ্রিগেজ এবং ফ্যালকাও-এর মতো খেলোয়াড়রা আছে যারা চারিদিকে খেলতে পারে। খেলোয়াড় এবং কোচিং স্টাফদের উপর আমার পুরো মাত্রার বিশ্বাস আছে।
ফিফা : হোসে প্যাকারম্যানের দলে কি হামেশ রদ্রিগেজই প্রকৃতিগত নেতা?
হিগুইতা : হামেশ স্বভাবগতই নেতা আর এ কারণেই সে আমাদের জাতীয় দলকে সারাবিশ্বের কাছে উপস্থাপন করছে। আর আমাদের উচিত তাকে সম্মান করা। সে এগুলো অর্জন করেছে তার দক্ষতা, নম্রতা ও কঠোর পরিশ্রম দিয়ে । সে একজন পরিপূর্ণ খেলোয়াড়; যে গোল করতে জানে, দক্ষতা রয়েছে এবং একজন টিম প্লেয়ার। সে জানে কিভাবে সুন্দর একটি ক্রস করতে হয়, কিভাবে ফিরে আসতে হয় এবং লক্ষ্যে পৌঁছাতে হয়। পৃথিবীর যে কোনো দলে খেলার যোগ্যতাই তার রয়েছে ।
ফিফা : আপনার সময়ের কার সঙ্গে তাকে তুলনা করবেন তাকে?
হিগুইতা : এল পিবে (কার্লোস ভালদেরামা)। লোকে চাইত তাকে দ্রুতগতির হিসেবে । কিন্তু তিনি ছিলেন মানসিকতার দিক থেকে দ্রুতগতির। যিনি তার সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন এবং যার ছিল অভিজ্ঞতা। তিনি তখনই ফ্রান্সে খেলতেন যখন আমরা সবেমাত্র দেশ ছাড়ছি । তার কারণেই কলম্বিয়ানদের জন্য ফুটবলের মার্কেট খুলে গিয়েছিল। আর তার প্রতিফলন তো দেখতেই পারছি অসংখ্য কলম্বিয়ান বাইরের দেশে ফুটবল খেলছে ।
ফিফা : ডেভিড ওসপানিয়ার জন্য কি ধরনের পরামর্শ দেবেন?
হিগুইতা : হামেশ ও ফ্যালকাওয়ের মতোই দলের পারফর্মের মেরুদণ্ড নির্ভর করবে ওসপানিয়ার উপরও। সে পায়ে ভালো দক্ষ কিন্তু তারপরেও বিপদজ্জনক কিছু না করাই ভালো হবে। যদি ডি বক্স থেকে বের হবার দরকার পড়ে এবং বল নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং খেলা চালিয়ে যেতে পারে তবে সেটা খুবই ভালো।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিপক্ষকে স্কোর করা থেকে বিরত রাখা। পোস্টে দাঁড়িয়ে থাকা আপনাকে বিপদমুক্ত নাও করতে পারে। বিপদমুক্ত থাকতে হলে আপনাকে রিস্ক নিতে হবে। আর এটা তার দায়িত্ব যার পায়ে বল থাকবে। নিজেদের নিরাপদ রাখার অনেক পদ্ধতি থাকতে পারে তবে নিজেরও একটা পদ্ধতি থাকা প্রয়োজন।
আইএইচএস/পিআর