উরুগুয়ের মুখোমুখি হতে চাইবে না কেউ : ফোরলান
এই প্রথম বিশ্বকাপে উরুগুয়ের হয়ে গলা ফাটাবেন একেবারে দর্শক সারিতে থেকে। লা ক্যালেস্তেদের হয়ে যেদিন আর খেলবেন না ঘোষণা দিয়েছিলেন, বুটজোড়া শো’কেসে তুলে রেখেছিলেন, সেদিন থেকে এমন একটি মুহূর্তের অপেক্ষাতেই থাকতে হয়েছে দিয়েগো ফোরলানকে। ২০১০ বিশ্বকাপের সেরা, গোল্ডেন বল জয়ী খেলোয়াড় এখন উরুগুয়ে জাতীয় দলে অতীত।
ক্যারিয়ার শেষ হতে হতে ফোরলানের ঠিকানা এখন হংকং লিগে। সেখানে ব্যাস্ত সময়ের মধ্যেই রাশিয়া বিশ্বকাপ নিয়ে কথা বলেছেন ফোরলান। বলেছেন বিশ্বকাপে উরুগুয়ের সম্ভাবনা নিয়ে। কেমন করবেন লুইস সুয়ারেজ এবং নতুন ভুমিকায় (সমর্থক হিসেবে) ফোরলান নিজেকে কোথায় রাখতে চান, সব কিছু নিয়েই কথা বলেছেন ফিফা ডটকমের সঙ্গে। তবে রাশিয়া বিশ্বকাপে নিজ দেশ নয়, দিয়েগো ফোরলানের ফেবারিট কিন্তু জার্মানি এবং ব্রাজিল। তার মতে, এই দুটি দলেরই সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা রাশিয়া থেকে বিশ্বকাপ জয় করে নেয়ার।
বিশ্বকাপ নিয়ে ফোরলানের সেই সাক্ষাৎকারই তুলে ধরা হলো জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য...
প্রশ্ন : কয়েক বছর ধরে উরুগুয়ে জাতীয় দলে নিজের জায়গা তৈরি করার জন্য লড়াই করতে হচ্ছে না আর, বিশ্বকাপের ঠিক আগ মুহূর্তে এসে কি অনুভুতি হচ্ছে আপনার?
ফোরলান : এটা ভিন্ন একটা অনুভুতি। তবে, এটা তো এমন কিছু নয় যে, কখনোই ঘটতো না! তবে বিষয়টা আমার জন্য ছিল খুবই কঠিন। ২০১৪ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যাওয়ার পর পরবর্তী রাশিয়া বিশ্বকাপে নিজের জায়গাটা তৈরি করা ছিল আমার জন্য খুবই কঠিন। সুতরাং, এর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি। যখন টুর্নামেন্ট শুরু হবে এবং খেলাগুলো দেখবো, তখন অবশ্যই মনে হবে যেন আমি নিজেই খেলছি। তবে আমি তো ক্যারিয়ারে তিনটি বিশ্বকাপ খেলেছি এবং ২০১০ বিশ্বকাপটা ছিল আমাদের জন্য অনেক বড় একটি টুর্নামেন্ট (সেবার উরুগুয়ে সেমিফাইনাল খেলেছিল, ফোরলান হয়েছিলেন টুর্নামেন্ট সেরা)। এ ধরনের খেলার সুযোগ আর আমার কখনো হবে না। ওটা ছিল সত্যিই চমৎকার এক অভিজ্ঞতা।
প্রশ্ন : বিশ্বকাপের সবগুলো আসর, যেগুলোতে আপনি খেলেছেন, সেগুলোর মধ্য থেকে যদি স্মরণীয় একটি মুহূর্ত বাছাই করতে বলা হয়, তাহলে আপনি কোনটাকে বাছাই করবেন?
ফোরলান : দলীয় পর্যায়ের কথা বললে, অবশ্যই আমি সবার ওপরে স্থান দেবো ২০১০ দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ঘানার বিপক্ষে জয়টিকে। ওটা এমন এক ম্যাচ ছিল, যেটাতে হেরেই যাচ্ছিলাম আমরা। সবশেষে বিস্ময়করভাবে আমরা টাইব্রেকারে ম্যাচটা জিততে পেরেছি। আর ব্যাক্তিগত স্মরণীয় মুহূর্তের কথা জানতে চাইলে বলবো, ওই টুর্নামেন্ট শেষে যখন আমার নামটি ঘোষিত হলো টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে এবং যখন গোল্ডেন বলটা হাতে তুলে নিয়েছিলাম, তখন। এছাড়া আমি ছিলাম সর্বোচ্চ গোলদাতাদের একজন।
প্রশ্ন : জাতীয় দলের হয়ে এমন কিছু করতে পারেননি, যেটার জন্য এখনও আফসোস হয়?
ফোরলান : সত্যি বলতে, এখন আর তেমন কোনো আফসোস নেই। আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে সম্পূর্ণ ব্যাক্তিগত সিদ্ধান্তে আমি অবসর নিয়েছি। আর আমি ক্যারিয়ারে যা করেছি, তা নিয়েই সন্তুষ্ট। নিজের দেশের হয়ে প্রায় ১০ বছর খেলেছি। এর মধ্যে অনেক উত্থান-পতনও ছিল। ওসব ছিল খুবই চমৎকার অভিজ্ঞতা। সবচেয়ে বড় কথা শেষটা ছিল ভালো। যদি তেমন না’ই হতো, তাহলে নিশ্চিত আমি এখানে বসে বলতাম, কত সুন্দরভাবে অবসর নেয়া যায়!
প্রশ্ন : ফোরলান এখন উরুগুয়ের কেমন সমর্থক? আবেগি না স্বাভাবিক?
ফোরলান : আমি যখন খেলা দেখি, তখন অনেক শান্ত থাকি। আমাদের জাতীয় দল এবং খেলোয়াড়দের ওপর আমার পূর্ণ আস্থা এবং বিশ্বাস রয়েছে। এই যেন বাছাই পর্বেও। তবে, খারাপ লেগেছিল, যখন বাছাই পর্বের মাঝপথে এসে সহজ সহজ কিছু পয়েন্ট হারিয়ে ফেলেছিল এবং এক সময় মনে হচ্ছিল বিশ্বকাপই মিস করতে পারি আমরা। কিন্তু আমি দেখলাম, তারা আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে নিয়েছে। আমরা খুব সহজেই বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছি। এটা অবশ্যই একটা অর্জন। এখন আমাদের সামনে বিশ্বকাপ এবং আমি কিছুটা রিল্যাক্সড। কারণ, আমি জানি আমাদের কোচিং স্টাফরা কেমন, আমি জানি আমাদের খেলোয়াড়রা কেমন এবং আমি এটাও জানি আমাদের খেলোয়াড়রা তাদের জার্সিকে সম্মান করে নিজেদের কতটা উজাড় করে দিতে পারে। এটার অর্থ এই নয়, আমরাই বিশ্বকাপ জিতে যাবো। তবে, আমি খুব আশাবাদী।
প্রশ্ন: বিশ্বকাপে উরুগুয়ে স্কোয়াডে থাকা খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন লুইস সুয়ারেজ। উরুগুয়ে দলের জন্য সে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
ফোরলান : লুইস সুয়ারেজ, দিয়েগো গোডিন এবং এডিনসন কাভানি- এরা উরগুয়ে জাতীয় দলের হয়ে দীর্ঘদিন একসঙ্গে খেলে যাচ্ছে। তারা অবশ্যই দলের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। সুয়ারেজ শারিরীকভাবেই খুব শক্তিশালী এবং নিজেকে নিজেই সে সামলাতে পারে। সে একজন গ্রেট গোল স্কোরার। তবে, তাকে একই সঙ্গে আগামী দিনগুলোতে গোল সেট করে দেয়ার দিকেও নজর দিতে হবে। বার্সেলোনায় গিয়ে নিজের অনেক উন্নতি ঘটিয়েছে সুয়ারেজ। তার ভিশনই থাকে, সব সময় উন্নতি করা। একই সঙ্গে নানা দিক থেকে খেলার সামর্থ্য রাখে সে। মোট কথা, জাতীয় দল এবং বার্সেলোনার হয়ে সমানভাবে পারদর্শী পারফরমার।
প্রশ্ন : ২০১০ সালে উরুগুয়ে কিংবদন্তি এনজো ফ্রান্সেসকোলি বলেছিলেন, তার চেয়েও দিয়েগো ফোরলান উরুগুয়ের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ একজন ফুটবলার। সাত বছর পর (আসলে হবে আট বছর) ফোরলান কি সুয়ারেজ সম্পর্কে একই কথা বলবেন?
ফোরলান : এটা কঠিন। উরুগুয়ে ফুটবলে নানা যুগে নানান গ্রেট খেলোয়াড়দের আবির্ভাব ঘটেছে। আমি বিশ্বাস করি, এই বিষয়টা প্রজম্ম থেকে প্রজম্মান্তরে একই থাকে। এবং এটা অনেকটাই নির্ভর করে মাঠের পারফরম্যান্স এবং ফলাফলের ওপর। আমি সব সময়ই বলে আসছি যে, নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট ব্যাক্তির ওপর বিষয়টা নির্ভরশীল; কিন্তু আপনি যদি ফুটবলের ইতিহাসের দিকে তাকান, তাহলে দেখবেন সেখানে সামষ্টিকভাবে বেশ কিছু গ্রেট ফুটবলারের আগমণ ঘটেছে। সেখানে অনেক ফুটবলার রয়েছেন, যারা অনেক কিছু জিততে পেরেছেন। আবার অনেকে ছিলেন, যারা কিছুই জিততে পারেননি।
প্রশ্ন : রাশিয়ায় উরুগুয়ের লক্ষ্যটা কী হতে পারে?
ফোরলান : অবশ্যই প্রভাব বিস্তার করে খেলতে হবে। এখানে কোনো সন্দেহ কিংবা প্রশ্নের অবতারণা থাকতে পারে না। প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, গ্রুপ পর্ব উৎরাতে। এটাই হবে প্রথম কঠিন কাজ। অনেক সময় প্রথম ম্যাচ হার দিয়ে শুরু হতে পারে। ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে যেমনটা হয়েছিল আমাদের। এরপর টুর্নামেন্টে টিকে থাকতে হলে অবশ্যই আপনাকে জিততে হবে। এখানে হয়তো কোনো সহজ প্রতিপক্ষ নেই। তবে উরুগুয়ে দলটিতে বেশ কিছু বিশ্বমানের ফুটবলার রয়েছে। সঙ্গে রয়েছে তারুণ্যের উপস্থিতি।
আমরা একটি ছোট দেশ। এই দৃষ্টিতে যদি নিজের দিকে তাকান, তাহলে কিছু অসুবিধা সামনে এসে দাঁড়াবে। তবুও আমি জানি, বিশ্বের অধিকাংশ ফুটবলার কিংবা দেশই চায় যে, তাদের যেন উরুগুয়ের মুখোমুখি হতে না হয়। এই দৃষ্টিতে দেখলে উরুগুয়ে হচ্ছে প্রতিটি দলের জন্যই একটি দুশ্চিন্তার নাম এবং তাদের অনেকেই চায় না উরুগুয়ের মুখোমুখি হতে। এটাই আমার কাছে সবচেয়ে ভালোলাগার।
প্রশ্ন : ইতালি, নেদারল্যান্ডস এবং চিলির মত দেশ নেই এবারের বিশ্বকাপে। এদের মধ্যে এমন কোনো দেশ আছে, যাদের এবারের বিশ্বকাপে না দেখাটা হবে আপনার জন্য অবাক করা ব্যাপার?
ফোরলান : না, আমি অবাক নই। আমরা দুটি বিশ্বকাপ এবং অনেকগুলো কোপা আমেরিকাও জিতেছি। তবুও তো আমরা বেশ কয়েকবার বিশ্বকাপ খেলতে পারিনি। আধুনিক ফুটবলে যে কেউ যে কাউকে হারাতে পারে। ২০০৬ বিশ্বকাপ জিতেছিল ইতালি এবং তাদেরকে ২০১০ ও ২০১৪ বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয়েছে। তারা প্রথম রাউন্ডের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছিল। আপনি তো ইতিহাস, নাম কিংবা জার্সির ওপর ভিত্তি করে কোনো কিছু জিততে পারেন না। এটা সম্পূর্ণই নির্ভর করে তখন এবং এখন আপনি কি করছেন এবং কেমন খেলতে পারছেন।
প্রশ্ন : বর্তমান সময়ের কথাই যখন বললেন, তাহলে বলুন, রাশিয়া থেকে বিশ্বকাপ জয়ের সম্ভাবনা কার বেশি?
ফোরলান : আমার বইতে এবার মাত্র দুটি নামই লেখা। ব্রাজিল এবং জার্মানি। ব্রাজিল সত্যিকারার্থেই দুর্দান্ত খেলছে। তারা দারুণ এক কোচ পেয়েছে এবং নেইমার রয়েছে দুর্দান্ত ফর্মে। সপ্তাহের পর সপ্তাহ যেভাবে সে খেলে যাচ্ছে, নিশ্চিতভাবেই ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো এবং লিওনেল মেসির সঙ্গে বিশ্বসেরার প্রশ্নে তুলনীয় সে। তিতে সত্যিই দারুণ কিছু খেলোয়াড় পেয়ে গেছে এবং দলটাকেও সত্যিই দারুণ গুছিয়ে নিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, ডিফেন্সে সলিড একটি কম্বিনেশন দাঁড় করিয়েছে। সে সত্যিকারার্থেই একজন গ্রেট কোচ এবং দারুণ এক ট্যাকটিসিয়ান। এভাবেই যদি চলতে থাকে এবং বিশ্বকাপেও বিষয়টা ধরে রাখতে পারে, তাহলে এবার ব্রাজিলের শিরোপা জয়ের দারুণ এক সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রশ্ন : সুতারং, যদি ফাইনালে ব্রাজিল এবং জার্মানি পরস্পর মুখোমুখি হয়, তাহলে নিশ্চিত আপনি পাঁচবারের বিশ্বজয়ীদের সমর্থক হয়ে যাবেন?
ফোরলান : অবশ্যই। কারণ, তারা তো দক্ষিণ আমেরিকান। শুধু তাই নয়, ব্রাজিল ফুটবলের প্রতি আমার অন্যরকম একটা দুর্বলতা সব সময়ই ছিল, আছে এবং থাকবে। আমার বাবাও তো সাও পাওলোর হয়ে বেশ কয়েক বছর খেলেছিলেন। আমি নিজেও ব্রাজিলে খেলেছি এবং সেখানে আমার অনেক বন্ধু রয়েছে। ব্রাজিলকে সমর্থন করার আরও বড় কারণ হলো, তারা আমাদের প্রতিবেশি। ২০১৪ বিশ্বকাপে ওমন বিধ্বস্ত হওয়ার পর রাশিয়ায় যদি জার্মানিকে হারিয়ে ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিততে পারে, তাহলে সেটা হবে তাদের জন্য সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত।
আইএইচএস/পিআর