মায়ের জন্য ছবি বাঁধাই করে রেখে গিয়েছিলেন শহীদ জুয়েল
ইস্ট পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অন্যতম সেরা ওপেনার আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল। মাঠ দাপিয়ে বেড়াতেন এই ক্রিকেটার। ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু মূলতঃ আজাদ বয়েজের হয়ে। এরপর খেলেন ঢাকা মোহামেডানেও। ১৯৬৬ সালের মে মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে আইয়ুব ট্রফিতে পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্ট বনাম ঢাকার তিন দিনের ম্যাচে খেলেছেন ঢাকার হয়ে। এরপর একই বছর ইস্ট পাকিস্তানের হয়ে হায়দরাবাদের নিয়াজ স্টেডিয়ামে কায়দ-ই-আজম ট্রফিতে কোয়েটার বিপক্ষে চার দিনের ম্যাচে।
১৯৬৯ সালের আগস্টে করাচি হোয়াইট-এর বিপক্ষে কায়দ-ই-আজম ট্রফিতে জুয়েল খেলেন করাচির ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে। পরের ম্যাচে খেলেন কায়রপুরের বিপক্ষে। ওই টুর্নামেন্টে হায়দরাবাদ হোয়াইট-এর বিপক্ষেও খেলেছিলেন ইস্ট পাকিস্তানের হয়ে। এরপর ১৯৭১ সালের ১৫ জানুয়ারি খেলেছেন ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম), ইস্ট পাকিস্তান হোয়াইটের হয়ে। ওই টুর্নামেন্টে আরেক ম্যাচে খেলেছিলেন পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের বিপক্ষে। ওই টুর্নামেন্টে মোট ৭ ম্যাচ খেলে ২১.৫৮ গড়ে করেছিলেন ২৫৯ রান। যা পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি ক্রিকেটারদের মধ্যে দারুণ উল্লেখযোগ্য পারফরম্যান্স।
তরুণ প্রতিভাধর সেই ক্রিকেটারের এরপর আর ক্রিকেটের ক্যারিয়ার লম্বা হয়নি। ক্রিকেটের ব্যাট ছেড়ে ধরতে হয়েছিল বন্দুক। দেশের মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে। কারণ এরইমধ্যে যে শুরু হয়ে যায় বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ! তখন তো সারা দেশেই যে যেভাবে পেরেছিল যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
দেশ রক্ষার দায়িত্বে ঝাঁপিয়ে পড়েন তখনকার অনেক ক্রীড়াবীদও। যাদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন সেরা ওপেনার জুয়েলও। আজাদ বয়েজের প্রতিষ্ঠাতা ক্রিকেটার বন্ধু ছিল শহীদ মুস্তাক। ২৫ মার্চের কালোরাতে মুস্তাকও হানাদারদের বুলেটে ক্ষত-বিক্ষত হন। বন্ধুর এমন পরিণতি এবং তার রক্তেমাখা মুখ ভুলতে পারছিলেন না জুয়েল।
কিন্তু মা’কে বড়বেশি ভালোবাসতেন জুয়েল। অন্যদিকে দেশের জন্যও কিছু করার জন্য প্রতিনিয়ত নিজের মধ্যে যুদ্ধ চলতে থাকে তার। এমন পরিস্থিতি টের পেয়ে মা তার ওপর নজর রাখছিলেন প্রতিনিয়ত। কিন্তু দেশের টানে আর ঘরে থাকতে পারলেন না। পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেলেন। চলে গেলেন রনাঙ্গনে।
যুদ্ধে যাওয়ার আগে নিজের একটি ছবি বড় করে বাঁধাই করে রেখে গিয়েছিলেন মায়ের জন্য। কেন ছবিটা মাকে বাধাই করে দিয়ে গিয়েছিলেন? শহীদ জুয়েলের আপন বড় বোন সুরাইয়া। জাগো নিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপে সুরাইয়া জানান, ‘জুয়েল ছবিটি বাধাই করে রেখে গিয়েছিল, যদি সে ফিরে না আসে, তাহলে মা যেন এই ছবিটাই দেখেন।’ জুয়েল সত্যি সত্যি আর ফিরতে পারেননি কোনোদিন।
ক্রিকেট পাগল এই তরুণের যুদ্ধে যাবার আগে মায়ের জন্য বাঁধাই করে রেখে যাওয়া ছবি সম্পর্কে বলতে গিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় তার বোন সুরাইয়া বলেন, ‘ও ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট খুব ভালোবাসতো। ক্রিকেট খেলাটাই তার জীবনের সব ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, সে যুদ্ধে যোগদান করে। ট্রেনিং নিতে ভারতে চলে যায়। যাওয়ার আগে বড় একটা ছবি বাঁধাই করে মাকে বলে যায়, আমি যখন থাকবো না, তখন এইটা দেখবা। আমাকে দেখবা।’
যুদ্ধ শুরুর পরপরই (মে মাসে) ভারতের ত্রিপুরা পালিয়ে গিয়ে যুদ্ধের ট্রেনিং নেন এই ক্রিকেটার। সেখানেই গঠন করেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গেরিলা বাহিনী ক্র্যাক প্লাটুন। এ প্রসঙ্গে শহীদ জুয়েলের বোন বলেন, ‘তারপর ভারতে গিয়ে গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে, ঢাকায় এসে অপরেশন পরিচালনা করেছে। এরমধ্যে আছে ফার্মগেটের অপারেশন, আশুগঞ্জের অপারেশন তারপর সিদ্ধিরগঞ্জের অপারেশন। আরও ছোটখাটো অনেক অপারেশনে অংশ নেয় সে।’
বেশ কয়েক জায়গায় সফল অপারেশন পরিচালনার পর আশুগঞ্জে অপারেশন পরিচালনার সময় তার আঙ্গুল আহত হয়। গোপনে ঘরোয়াভাবে আঙ্গুলের চিকিৎসা করিয়ে আবারও ঝাঁপিয়ে পড়েন রণাঙ্গনে। এবার নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন। সেখানে মারাত্মকভাবে আহত হন তিনি। ওটাই ছিল জুয়েলের শেষ অপরেশন। এ প্রসঙ্গে শহীদের বোন বলেন, ‘সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে অপারেশনের সময় ওর (জুয়েল) হাতে একটা গ্রেনেড বিস্ফোরণ হয়। এরপর ওখান থেকে ওরে নিয়া আইসা আলমের (আলতাফ মাহমুদ) বাসায় চিকিৎসা করা হয়।’
আহত অবস্থাতেই ২৯ আগস্ট মায়ের সাথে দেখা করতে বের হন মগবাজারে আলতাফ মাহমুদের বাসা থেকে। এরপর আর ফিরতে পারেননি যুদ্ধে। ধরা পরেছিলেন পাক হানাদারের হাতে। ধারণা করা হয় ৩১ আগস্ট শহীদ করা হয় জুয়েলকে। সে প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সুরাইয়া বলেন, ‘তারপর ২৯ আগস্ট মগবাজার থেকে মায়ের সাথে দেখা করার জন্য বের হয় সে। মায়ের সাথে দেখা করার আগে আজাদের বাসায় যায়। আজাদের মা রাত হয়ে গেলে আর বের হতে দেয় না। সেদিন রাতেই সম্ভবত রাজাকাররা মিলিটারি ডেকে ওদের ধরাইয়া দেয়।’
আজাদের বাসা থেকে ধরা পড়ার পর জুয়েলদের রাতে রাখা হতো রমনা থানায়, আর দিনে টর্চার চালানো হতে এমপি হোস্টেলে নিয়ে; কিন্তু আটকের দুই দিন পর থেকেই আর জুয়েলের সাথে কারো দেখা হয়নি বলেও জানান শহীদ জুয়েলের বোন। এ কথা বলতে গিয়ে তার গলে ধরে আসে। ধরা গলায় বলতে থাকেন, ‘রাতে ওদের রমনা থানায় রাখতো আর দিনে এমপি হোস্টেলে নিয়ে টর্চার করতো। দুইদিন বাবা গিয়ে ওর সাথে দেখা করেছিল। ২রা সেপ্টেম্বর আমরা সবাই গিয়েছিলাম কিন্তু আর দেখা পাইনি। তারপর আর কখনওই ওর সাথে দেখা হয়নি আজ পর্যন্ত। মনে হয় সেদিনই রাতে ওকে মেরে ফেলেছিল।’
শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের একটা গ্যালারির নামকরণ করা হয়েছে শহীদ জুয়েল স্ট্যান্ড। তবে এখানে তার সম্পর্কে আর কিছু জানার সুযোগ নেই। এমনকি আরেক ক্রিকেট সংগঠক শহীদের মোস্তাকের নামে গ্যালারি থাকলেও নেই তাদের সম্পর্কে জানার জন্য কোন স্মারক কিংবা কোনো তথ্য। এটা নিয়েও আফসোস রয়েছে শহীদ জুয়েলের পরিবারের। এমনকি দুই শহীদ ক্রিকেটার ও সংগঠকের আসল নাম দুটিও কী আরও একটু বড় করে না লেখা না নিয়েও আফসোস রয়েছে তাদের মধ্যে।
এমএএন/আইএইচএস/আরআইপি