স্মৃতিতে ভারত-পাকিস্তান ফাইনাল
আর্জেন্টিনা-নাইজেরিয়ার প্রীতি ম্যাচ আর মেসির আগমনের ঘটনাটিকে ব্র্যাকেটবন্দি করলে এখন বাংলাদেশের খেলাধুলা অনেকটাই ক্রিকেট কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। যেহেতু ক্রিকেট ছাড়া আর কোন খেলায় বাংলাদেশ সে অর্থে বিশ্ব পর্যায়ে নেই, তাই আর কোন খেলার বিশ্ব আসর হবার সুযোগ-সম্ভাবনাও কম।
তারপরও একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশে নিয়মিতই আন্তর্জাতিক আসর বসতো। বিশেষ করে ৭০, ৮০ ও ৯০ দশকে ঢাকায় আগাখান গোল্ডকাপ আর প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ আর এশীয় যুব ফুটবলের চূড়ান্ত আসর বসেছে রাজধানী ঢাকায়। বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের সব সময়ের অন্যতম সেরা ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলি আর বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফার সাবেক প্রেসিডেন্ট সেফ ব্ল্যাটারের মত বিশ্ব বরেণ্য ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের দেখাও মিলেছে রাজধানীতে।
এছাড়া আশির দশকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে প্রথম পেশাদার কুস্তি প্রতিযোগিতার আকর্ষণীয় আসরও বসেছিল। পাকিস্তানের বিশ্ববিখ্যাত কুস্তিগীর ভুল পাহলোয়ানের ছেলে সুদর্শন নাসের ভুলুর কুস্তি আর ফ্লাইং কিক আশির দশকের শেষ দিকে দারুণ সাড়া জাগিয়েছিল। এছাড়া ১৯৮৫ সালে ঢাকায় দক্ষিণ এশীয় ক্রীড়াঙ্গনের সর্ববৃহৎ আসর ‘সাফ গেমসও’ অনুষ্ঠিত হয়।
কিন্তু সব আন্তর্জাতিক ও মহাদেশীয় ক্রীড়া আসরের আকর্ষণ ঢাকা পড়ে গিয়েছিল ১৯৮৫ সালে। ওই বছর জানুয়ারীতে রাজধানীতে বসলো এশিয়া কাপ হকির দ্বিতীয় আসর। স্বাধীন বাংলাদেশের খেলাপ্রেমীরা সেই প্রথম বিশ্ব হকির দুই প্রধান শক্তি ভারত ও পাকিস্তানের বিশ্বসেরা হকি তারকাদেও দেখার সুযোগ পায়।
ভারত ও পাকিস্তান হকির তখনো স্বর্ণ সময়। বাংলাদেশে প্রথম এশিয়া কাপের আসর বসার আগের দুই অলিম্পিক গেমস ১৯৮০ (মস্কো) আর ১৯৮৪ (লস অ্যাঞ্জেলস) হকির স্বর্ণ বিজয়ী দল ছিল ভারত (১৯৮০) আর পাকিস্তান (১৯৮৪)।
কাশিম জিয়া, হানিফ খান, কলিমউল্লাহ, সামিউল্লাহ, হাসান সর্দার, পারগাত সিং, সোমায়া, মোহাম্মদ সহিদ, মোহাম্মদ নাইমেরমত বিশ্বমানের খেলোয়াড়ের চোখ ধাঁধানো স্টিকওয়ার্ক আর অনুপম নৈপুণ্য নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেন ঢাকাবাসী তথা বাংলাদেশের ক্রীড়াপ্রেমীরা।
আজ থেকে ৩২ বছর আগে, বাংলাদেশে সিনথেটিক টার্ফ বা অ্যাস্ট্রো টার্ফ কোথায় মিলবে? তাই ঘাসের মাঠেই হয়েছিল খেলা। মূল ভেন্যু আজকের বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। এখন এটা ফুটবল আর অ্যাথলেটিক্সের ভেন্যু। তখন সেটা দেশের ক্রীড়া কেন্দ্র ও ক্রীড়াতীর্থ। নাম ছিল ঢাকা স্টেডিয়াম (আজকের বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম)।
আজ যেখানে মওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়াম। তখন সেটা ছিল আউটার স্টেডিয়াম। আর বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের ভিআইপি দিয়ে বের হলে দক্ষিণ দিকে যে পল্টন মাঠ সেখানে দুদিকে ছোট্ট চার-পাঁচ সারির গ্যালারির হকি স্টেডিয়াম ছিল।
তবে ৮৫‘র এশিয়া কাপ হকির ফাইনাল, সেমিফাইনাল ও গুরত্বপূর্ণ ম্যাচগুলো বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের ভিতরেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে স্বাগতিক বাংলাদেশের প্রথম গ্রুপ ম্যাচ ছিল ইরানের সাথে। বাংলাদেশ জিতেছিল ৩-১ গোলে। দেশের হয়ে তিনটি গোলই করেছিলেন রক্ষণভাগের অতন্দ্র প্রহরী জুম্মন লুসাই।
বলার অপেক্ষা রাখে না, সবগুলো গোলই এসেছিল পেনাল্টি কর্নার থেকে। এরপর জাপান ও চীনের সাথে যথাক্রমে ১-১ আর ২-২ গোলে ড্র করা বাংলাদেশ গ্রæপের শেষ ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল তখনকার হকি বিশ্বের অন্যতম সেরা শক্তি পাকিস্তানের বিপক্ষে। পাকিস্তানের রক্ষণদূর্গ তখন রীতিমত চীনের প্রাচীর।
ফুলব্যাক কাশিম জিয়া একাই একশো। মাঝ মাঠে হানিফ খানের পরিশ্রমি, কুশলী আর সৃষ্টিশীলতার সামনে দাঁড়ানো খুব কঠিন ছিল। রাইট উইংয়ে কলিমউল্লা আর লেফট উইংয়ে সামিউল্লাহ আর সেন্টার ফরোয়ার্ড হাসান সর্দার। সে সময়ের হকি জগতের অন্যতম সেরা ফরোয়ার্ড হাসান সর্দার ছয় ফুটের ওপর লম্বা; কিন্তু ওই দীর্ঘ দেহ নিয়েও অবলীলায় প্রতিপক্ষর দুই তিনজনকে কাটিয়ে ফেলতেন। বল যেন তার স্টিকের সাথে কথা বলতো।
বাংলাদেশে খেলতে আসার মাত্র এক বছর আগে বিশ্ব অলিম্পিকে স্বর্ণ বিজয়ী পাকিস্তানের সেই দুর্ধর্ষ দলের বিরুদ্ধে কি করবে বাংলাদেশ? ১৯৭৮ সালের ব্যাংকক এশিয়াডের মত করুণ পরিণতি (পাকিস্তানের কাছে ১৭-০ গোলে হেরেছিল বাংলাদেশ) ঘটবে না তো?
এমন চিন্তায় বিভোর ছিলেন ভক্ত ও সমর্থকরা। কিন্তু ওসমান, জুম্মন লুসাই, জসিমউদ্দীন কাঞ্চন, আব্দুল্লাহ পিরু, আব্দুল মালেক চুন্নু, আলমগীর চুন্নু, ওয়ালিউল ইসলাম নাসিম, মেজর (অবঃ) শাহাবউদ্দীন চাকলাদার, সালাউদ্দীন টিসারা বুক চিতিয়ে লড়ে সব শঙ্কাকে অমুলক প্রমাণ করলেন।
পাকিস্তানের মত বিশ্বসেরা দলের বিপক্ষে যত ভাল খেলা যায় আর যেমন লড়াকু হকি উপহার দেয়া যায়- তাই দিল বাংলাদেশ। প্রায় সমানতালে লড়াই যাকে বলে। খেলা শেষ হবার কয়েক মিনিট আগে হাসান সর্দারের একক নৈপুন্যের গোলে হারলো বাংলাদেশ।
ওই গোল হজমের অল্প কিছু সময় আগে উল্টো এগিয়ে যাবার সুযোগ এসেছিল লাল সবুজের সামনে; কিন্তু ফরোয়ার্ড সালাউদ্দীন টিসা পাকিস্তানের গোলকিপারকে একা পেয়েও গোল করতে পারেননি। ওই গোল হয়ে গেলে হয়ত ইতিহাস ভিন্নরকম হতে পারতো।
এখানেই শেষ নয়। ৩২ বছর আগে ঢাকায় বসা এশিয়া কাপের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এবং সবচেয়ে বড় স্মৃতি হলো ফাইনাল। ৭০ এবং ৮০’র দশকে ক্রিকেটের মত যে দুই দলের খেলা মানেই সর্বোচ্চ আকর্ষণ। ধুন্ধুমার লড়াই। ভীষন উত্তেজনা ও মার মার কাট কাট অবস্থা- সেই ভারত ও পাকিস্তানই মুখোমুখি হয়েছিল ফাইনালে।
আজকের বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের সবুজ ঘাসের মাঠে হয়েছিল ফাইনাল। তখন এই স্টেডিয়ামের দর্শক ধারণ ক্ষমতা ছিল ৪৫ হাজার; কিন্তু খেলা দেখতে এসে উপস্থিত হয়ে পড়েন ৫০ থেকে ৫২ হাজার দর্শক।
কি আর করা? শেষ পর্যন্ত পুরো গ্যালারি ভরে যাবার পর পাঁচ থেকে সাত হাজার দর্শক মাঠের চারিদিকে বসে খেলা দেখেন। কোন আন্তর্জাতিক আসরের ফাইনালে মাঠে বসে এত দর্শক খেলা দেখার ঘটনা এখনো বিরল।
মহাদেশীয় হকির ফাইনাল- তাও দুই বিশ্বসেরা দলের মধ্যে। নিরাপত্তার অজুহাতে এখন আর কোন দলই হয়ত খেলতে রাজি হতো না; কিন্তু সেদিন ভারত ও পাকিস্তানের খেলোয়াড়রা পরম আনন্দে খেলেছিলেন। লড়াই হয়েছিল সমানে সমানে। একদিকে পাক রক্ষণভাগে কাশিম জিয়া। অন্যদিকে ভারতের সেন্টার ব্যাক পারগাত সিং। মাঝ মাঠে একদিকে মোহাম্মদ সহিদ আর অন্যদিকে হানিফ খান।
রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ে শেষ হাসি হাসে পাকিস্তান। আকাশী ও নীল জার্সির ভারতের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত ৩-২ গোলের ব্যবধানে পাকিস্তান ট্রফি জিতলেও ফাইনালটি নানা কারণে বিতর্কিত হয়েছিল। পাকিস্তানের জয়সূচক গোল নিয়ে কী তুগলকি কাণ্ডটাই না ঘটেছিল সেদিন।
রাইট উইং কলিমউল্লাহ ভারতের গোলমুখে জটলার মধ্য থেকে গোল করে সবুজ জার্সির পাকিস্তানকে জেতালেও ওই গোল নিয়ে তুমুল গণ্ডগোল হয়েছিল। ভারতীয়দের দাবি, কলিমউল্লাহ যখন স্টিক দিয়ে বলে আঘাত করে বলকে গোলে পাঠান তখন তার স্টিক বিপজ্জনক উচ্চতায় উঠে গিয়েছিল। সময়ের আবর্তে অনেক আইন কানুন বদলেছে। তবে হাকির আইনে এখনো কোনভাবেই স্টিক মাথার ওপরে ওঠানো নিষেধ। ভারতীয়দের দাবি, কলিমউল্লাহ স্টিক বিপজ্জনকভাবে মাথার ওপরে তুলে বলে আঘাত করে গোলে ঠেলে দেন।
আম্পায়ার গোলের বাঁশি বাজানো মাত্র ভারতের অধিনায়ক সোমায়া সহ দু’তিনজন খেলোয়াড় ছুটে গিয়ে প্রতিবাদ জানান। কেউ কেউ তাকে ধাক্কাও দেন। পরে আম্পায়ার্স রিপোর্টের ওপর নির্ভর করে সোমায়সহ ভারতের দু’তিন খেলোয়াড় কয়েক বছরের জন্য সাসপেন্ডও হন।
এআরবি/আইএইচএস/আইআই