৮৫’র এশিয়া কাপ হকি দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট
৩২ বছর আগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় এশিয়া কাপ হকি টুর্নামেন্ট ছিল নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৮৫ সালের আগে বাংলাদেশে অনেক টুর্নামেন্টের আয়োজন হলেও ওই এশিয়া কাপ হকি স্বাধীন বাংলাদেশে পূর্ণাঙ্গ জাতীয় দল নিয়ে কোনো প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট। এর আগে আগা খান গোল্ড কাপ ফুটবল, ২০তম এশিয়ান যুব ফুটবল, প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপ ফুটবল ইত্যাদি আয়োজিত হলেও তার কোনোটিই পূর্ণাঙ্গ জাতীয় দল নিয়ে ছিল না। এমনকি আয়োজিত হয়েছিল এশিয়ান সাঁতার প্রতিযোগিতাও। সেটিও দলগত কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না।
এশিয়া কাপ টুর্নামেন্টের মাধ্যমে দেশের হকিতে তৈরি হয়েছিল আলোড়ন। ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম) টইটম্বুর গ্যালারির সামনে ভারত-পাকিস্তান ফাইনালের স্মৃতি এখনও অনেকের মনে গেঁথে আছে। হকি স্টিকেও যে জাদু আছে, সেটা তখন অনেক বেশি অনুধাবন করতে পেরেছিলাম ওই এশিয়া কাপের মধ্যে দিয়ে। পান করেছিলাম হকির অমীয় সুধা।
ওই বছর ২০ থেকে ২৮ জানুয়ারি ঢাকায় ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় এশিয়া কাপ হকি। ১০ জাতির ওই টুর্নামেন্টে খেলেছিল ওই সময়ের বিশ্বকাপ, অলিম্পিক ও এশিয়ান গেমস চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তান, বিশ্ব হকির অন্যতম পরাশক্তি সাবেক অলিম্পিক ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, চীন, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইরান ও স্বাগতিক বাংলাদেশ। টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের কথা থাকলেও শেষ মুহুর্তে নাম প্রত্যাহার করে নেয় ম্যাকাও ও ওমান।
তখন পর্যন্ত হকিতে জয়জয়কার ছিল পাকিস্তান এবং ভারতের। উপমহাদেশের এই দুই দেশের উপস্থিতিতে গড়িয়ে পড়ে উত্তেজনার লাভা। আর বাংলাদেশে এই দুই দেশের খেলার কথা জানার পর টগবগিয়ে ফুটতে থাকেন ক্রীড়ানুরাগীরা। শৈল্পিক হকির এই দুই প্রতিনিধি ফাইনালে খেলবে, এমন স্বপ্নে বিভোর হন হকির সমঝদাররা। এ কারণে এই টুর্নামেন্ট নিয়ে দারুণভাবে সাড়া পড়ে যায়। তখন আন্তর্জাতিক হকি টুর্নামেন্ট আয়োজনের মতো কোনো ভেন্যু বাংলাদেশে ছিল না। আর হকির দুনিয়া অ্যাস্ট্রো টার্ফের জগতে প্রবেশ করলেও বাংলাদেশের কাছে তখন সেটা সুদূরের স্বপ্ন। ঢাকা স্টেডিয়ামের ঘাষের মাঠই ছিল সব খেলার বিচরণ ক্ষেত্র।
নবীন ক্রীড়ালেখক হিসেবে ওই টুর্নামেন্টটি আমাকেও ব্যাপক আলোড়িত করে। প্রেসবক্সে বসে এমন একটি টুর্নামেন্ট কভার করার আনন্দে দারুণভাবে রোমাঞ্চিত হই। তখনও ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে হাতেখড়ি হয়নি। ফ্রি ল্যান্সার হিসেবে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করি। সে সময় ক্রীড়া সাংবাদিক ও ক্রীড়া লেখকের সংখ্যাও ছিল অপ্রতুল। তাছাড়া স্টেডিয়াম এলাকায় যাদের বিচরণ ছিল, তাদের পরস্পরের সঙ্গে পরস্পরের কম-বেশি চেনা-জানা ছিল। এ কারণে প্রেস কার্ড পেতেও কাঠখড় পোড়াতে হয়নি।
ওই এশিয়া কাপের আগে হকিতে বাংলাদেশের রেকর্ড ভালো না থাকা সত্ত্বেও লাল-সবুজ দল নিয়ে বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। কোচ প্রতাপ শঙ্কর হাজরা আর এহতেশাম সুলতানের অধীনে দলটি অনেক দিন নিবিড় প্রশিক্ষণ নেয়। যদিও দলের বেশ কয়েকজন নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড় আহত ছিলেন। সিনিয়র একাধিক খেলোয়াড় খেলতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন।
জাতীয় দলে শাহবুদ্দিন চাকলাদারকে দলভুক্ত করা নিয়ে প্রতিবাদ জানান দুই কোচ; কিন্তু তাদের প্রতিবাদকে গুরুত্ব না দিয়ে সিলেকশন কমিটি তাকে দলভুক্ত করে। এ কারণে তারা কোচিং করানো বন্ধও করে দেন। এ ঘটনায় প্রতাপ শঙ্কর হাজরাকে ১০ বছর এবং এহতেশাম সুলতানকে ৫ বছর সাসপেন্ড করা হয়। শেষ মুহুর্তে তাদের পরিবর্তে কোচের দায়িত্ব পালন করেন সহকারী ম্যানেজার মো. মহসীন।
নবীন ও প্রতিভাবানদের নিয়ে গড়া দলটির অধিনায়ক করা হয় ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন চাকলাদারকে। দলের অন্য খেলোয়াড়রা হলেন সালাহউদ্দিন চৌধুরী টিসা (সহ-অধিনায়ক), নায়েক ওসমান, ইসলাম নাসিম, জুম্মন লুসাই, খাজা আরজু রিজওয়ান, জসিমউদ্দীন আহমেদ কাঞ্চন, জামিল পারভেজ লুলু, মো. আলমগীর চুন্নু, আবদুল মালেক চুন্নু, খাজা মো. ড্যানিয়েল, মো. বরকতউল্লাহ চপল, নায়ক জাহাঙ্গীর আলম, কামরুল ইসলাম কিসমত, আবদুল্লাহ পিরু ও মো. সহিদুল্লাহ। ম্যানেজার ছিলেন সাব্বির ইউসুফ।
দ্বিতীয় এশিয়া কাপ হকিকে কেন্দ্র করে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে ঢাকা। উদ্বোধনী ম্যাচে বাংলাদেশ ৩-১ গোলে ইরানকে হারিয়ে দেয়। আর এ জয়ের মূল নায়ক ছিলেন জুম্মন লুসাই। ফুলব্যাকের এই খেলোয়াড় হ্যাটট্টিক করেন। কোনো বিদেশি দলের পক্ষে এটি ছিল বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড়ের প্রথম হ্যাটট্টিক। পেনাল্টি কর্নার থেকে দুটি এবং পেনাল্টি স্ট্রোক থেকে একটি গোল করেছিলেন জুম্মন লুসাই। তবে গোল সংখ্যা বাড়ানোর সুযোগ পেয়েও কাজে লাগানো যায়নি। নতুবা অনেক বড় ব্যবধানে জিততে পারত বাংলাদেশ।
শক্তিশালী জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশ সমানতালে লড়াই করে। এক গোলে পিছিয়ে পড়েও অদম্য মনোবল আর লড়াকু মনোভাব দিয়ে সমতা নিয়ে আসে। খেলার শেষ মুহূর্তে পেনাল্টি স্ট্রোক থেকে গোল করেন জাপানের তাকামোরি। পেনাল্টি স্ট্রোকের প্রতিবাদে উত্তেজিত দর্শকরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে খেলা ১৬ মিনিট বন্ধ থাকে। বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের অনুরোধে দর্শকরা শান্ত হয়। এক মিনিটের ব্যবধানে দর্শনীয় গোলে সমতা আনেন সালাহউদ্দিন টিসা। ইরানের বিপক্ষে জয়ের পর জাপানের সঙ্গে ড্র করায় হকি অনুরাগীরা উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন।
চীনের সঙ্গে ২-২ গোলে ড্র করাটাও ছিল বাংলাদেশের বড় সাফল্য। ২-০ গোলে পিছিয়ে পড়েও সমতা আনাটা ছিল অসাধারণ। দুই গোল হজমের পর জ্বলে ওঠে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় গোল খাওয়ার ৪ মিনিটের মধ্যে নাসিম গোল করে ব্যবধান কমান। দ্বিতীয়ার্ধের ২৮ মিনিটে পেনাল্টি স্ট্রোকে সমতা আনেন মালেক চুন্নু।
ইরানকে হারানোর পর জাপান এবং চীনের সঙ্গে ড্র করার পর উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে পুরো দেশ। বাংলাদেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে থাকেন দেশের মানুষ। পাকিস্তানের সঙ্গে খেলাকে কেন্দ্র করে স্টেডিয়ামে দর্শকের বাধভাঙা জোয়ার নামে। কানায় কানায় ভর্তি হয়ে যায় স্টেডিয়াম। দুর্ধর্ষ পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা যে ক্রীড়াশৈলী উপহার দেন, তাতে উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন ক্রীড়ানুরাগীরা।
শুরু থেকে দেখা যায় সাহসী এক বাংলাদেশকে। এই বাংলাদেশকে আগে কখনও দেখা যায়নি। চাপের মুখে ভেঙে না পড়ে পাল্টা আক্রমণ গড়ে তোলে। লড়াই করে সমানতালে। সালাহউদ্দিন টিসা সহজ দুটি গোল হাতছাড়া করার পর স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শকের দীর্ঘশ্বাস ছিল মর্মবিদারী। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১-০ গোলে হেরে যায় বাংলাদেশ। খেলা শেষ হওয়ার ৬ মিনিট আগে গোল করেন পাকিস্তানের হাসান সরদার।
স্থান নির্ধারণী ম্যাচে মালয়েশিয়ার কাছে ৩-০ গোলে হেরে ষষ্ঠ হয় বাংলাদেশ। আগের ম্যাচে দুর্দান্ত খেলার পর এ ম্যাচে খুঁজে পাওয়া যায়নি লড়াকু বাংলাদেশকে। পাকিস্তানের বিপক্ষে নিজেদের নিংড়ে দেয়ার পর খেলোয়াড়রা যেন ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েন।
প্রথম সেমিফাইনালে ভারত ৯-১ গোলে জাপানকে এবং দ্বিতীয় সেমিফাইনালে পাকিস্তান ৭-০ গোলে দক্ষিণ কোরিয়াকে হারায়। দর্শকদের স্বপ্নকে সত্য করে দিয়ে ফাইনালে যথারীতি মুখোমুখি হয় দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান এবং ভারত। সেদিন পুরো স্টেডিয়াম ছিল কানায় কানায় পরিপূর্ণ। টিকিট কেটেও বিপুলসংখ্যক দর্শক মাঠে ঢুকতে পারেননি। ফাইনাল ম্যাচটিও হয় দেখার মতো। ঘাষের মাঠে হকিস্টিকের আঁচড়ে ফুটে ওঠে চোখজুড়ানো সব চিত্রকলা। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও মনোমুগ্ধকর ফাইনালে পাকিস্তান ৩-২ গোলে হারায় ভারতকে।
হকির দুই পরাশক্তির ফাইনাল লড়াই দর্শকদের বিমোহিত করে। ঢাকার মাঠে এমন একটি ম্যাচ দেখা ছিল স্বপ্নের মতো। পাকিস্তানের হকির ইতিহাসে অন্যতম সেরা তিন ফরোয়ার্ড ও অলিম্পিক স্বর্ণজয়ী খেলোয়াড় হাসান সরদার, হানিফ খান ও কলিমুল্লাহ’র ক্রীড়াশৈলী দর্শকদের হৃদয়ে দাগ কাটতে সক্ষম হয়। তবে জনপ্রিয় খেলোয়াড় ছিলেন হাসান সরদার। এই সেন্টার ফরোয়ার্ডের অনুপম ডজ, চলন্ত বলে ত্বরিতগতিতে গোল করার কৌশল দর্শকদের মুগ্ধ করে।
টুর্নামেন্টে ১০টি গোল করেন হাসান। দলের অন্যতম সিনিয়র খেলোয়াড় কলিমুল্লাহও সবার নজর কাড়তে সক্ষম হন। আক্রমণভাগের এই খেলোয়াড় দলের বিপদের সময় নিজেকে উজাড় করে দেন। পাকিস্তান শিরোপা জয় করে হানিফ খানের নেতৃত্বে। খেলোয়াড়ি জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়েও গোল করার ক্ষেত্রে তিনি দক্ষতার পরিচয় দেন।
দেখতে ছোটখাটো হলেও দুরন্ত ছিলেন ভারতের মো. নঈম। প্রতিটি ম্যাচেই গোল করেন। সুযোগসন্ধানী এই খেলোয়াড় এ টুর্নামেন্টে প্রথম জাতীয় দলের হয়ে খেলেন। টুর্নামেন্টে সর্বাধিক ১২টি গোল তার। অলিম্পিকে স্বর্ণজয়ী ভারতের মো. শহীদ ফরোয়ার্ড হিসেবে নিজেকে দারুণভাবে মেলে ধরেন। তিনি ছিলেন ড্রিবলিংয়ে মাস্টার। তবে গোল করার চেয়ে গোল করাতে পছন্দ করতেন তিনি। তবে সে সময় ভারতের সেরা খেলোয়াড় জাতীয় দলের অধিনায়ক জাফর ইকবাল এ টুর্নামেন্টে অংশ নেননি।
এই টুর্নামেন্ট বাংলাদেশের ঘুমিয়ে থাকা হকিকে যেন জাগিয়ে দিয়ে যায়। সারাদেশে সৃষ্টি হয় জাগরণের। হকিস্টিক পেলে তো কথাই ছিল না। না পেলে গাছের ডাল, লাঠি কিংবা এ জাতীয় যা পাওয়া গেছে, তা নিয়ে শহর তো বটেই, গ্রামে-গঞ্জেও হকি খেলার ক্রেজ লক্ষ্য করা যায়। তখন মনে হয়েছিল, হকিকে আর ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। কিন্তু সেই উচ্ছ্বাস, সেই উম্মাদনা স্তিমিত হয়ে যেতে বেশি দিন লাগেনি।
লেখক : সম্পাদক, পাক্ষিক ক্রীড়াজগত
আরআই/আইএইচএস/আইআই