সাকিব-রিয়াদরাও পারেন, তবে ধারাবাহিকতা প্রয়োজন
‘কি ভাই খুব তো লিখেছিলেন আমাদের একজন অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউজ দরকার। যে মাঝ পথে ব্যাট হাতে ইনিংসের হাল ধরবে শক্ত হাতে। তারপর আর থামাথামি নেই। একদম দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে সোজা বিজয়ীর বেশে সাজঘরে ফিরবে। এখন দেখলেন তো আমাদের একজন নয়, দু দু’জন তেমন ফিনিশার আছেন। যারা সাহসী নাবিক। গভীর সমুদ্রে দিকবিদিগশূন্য জাহাজকে তীরে ভেড়ানোর পর্যাপ্ত সামর্থ্য আছে যাদের। কাজেই আমাদের আর ম্যাথিউজের দরকার নেই। সাকিব আল হাসান আর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদই যথেষ্ঠ। তারাও পারে প্রতিপক্ষর আগুণ ঝরানো বোলিংয়ের মাঝেও অনঢ় থাকতে। খাদের কিনারায় দাঁড়িয়েও যারা স্বপ্ন দেখতে পারেন। বিপদে এতটুকু ভয় না পেয়ে শক্ত হাতে হাল ধরে দলকে পৌঁছে দিতে পারেন অভিষ্ঠ লক্ষ্যে। এমন দুজন সাহসী নাকিব থাকতে আমাদের কি আর কারো কথা চিন্তা করার অবকাশ আছে?’
সেহরির সময় এক বন্ধুর ফোনে অনুযোগ। ক্রিকেট পাড়ার পরিচিত ওই মুখ শুভাকাঙ্খীর সাথে কন্ঠ মিলেয়ে আরও ক’জন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও প্রায় একই সুরে কথা বললেন, ‘ভাই আপনি তো লিখেছিলেন আমাদের ম্যাচ শেষ করে আসার, মানে ফিনিশার নেই। একজন ম্যাথিউজের অভাব। দেখলেন তো একজনের বদলে দুজন আছে!’
ভাবছেন হঠাৎ এ প্রসঙ্গর অবতারণা কেন? নাহ এমনি এমনি ওই ফোন আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কথা বলা হয়নি। সুনির্দিষ্ট কারণ আছে। ওপরের প্রসঙ্গর অবতারণার কারণ এক ও অভিন্ন।
তিন দিন আগে জাগো নিউজে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলাম। যার শিরোনাম ছিল, ‘একজন ম্যাথিউজ খুব দরকার বাংলাদেশের।’ বলার অপেক্ষা রাখে না এই ম্যাথিউজ হলেন লঙ্কান অধিনায়ক অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউজ। যিনি কয়েক মাস পর ইনজুরি থেকে মাঠে ফিরে ৭২ ঘন্টা আগে ভারতের বিরুদ্ধে শ্রীলঙ্কাকে জিতিয়ে বিজয়ীর বেশে সাজঘরে ফিরেছেন।
যদিও ওই ম্যাচে লঙ্কানদের জয়ের মূল স্থপতি ও রূপকার দানুসকা গুনাথিলাকা এবং কুশল মেন্ডিস। তাদের ১৫৯ রানের জুটিতেই জয়ের কাছাকাছি চলে যায় শ্রীলঙ্কা; কিন্তু এক সময় তারা রান আউটের ফাঁদে পড়ে সাজঘরে ফিরলে গুরুত্বপূর্ণ সময় হাল ধরেন ম্যাথিউজ। শক্ত হাতে হাল ধরে দলকে সাফল্যের তীরেও পৌঁছে দেন লঙ্কান ক্যাপ্টেন।
এই যে পাঁচ-ছয় নম্বর পজিশনে গিয়ে ম্যাচ শেষ করে দল জিতিয়ে ফিরে আসা- সেটাই ছিল ওই লেখার উপজিব্য। তাই কারো কারো চাপা অনুযোগ, এখন কি আর ম্যাথিউজের খুব দরকার? আমরা তো সাকিব আর মাহমুদউল্লাহকে পেয়ে গেছি। তারাও পারেন ধ্বংস্তুপের মধ্যে দাঁড়িয়ে দলকে জেতাতে।
তা যে পারেন, সে ব্যাপার নিয়ে কখনোই কিন্তু সংশয়-সন্দেহ ছিল না আমার। তা ছিল না, বলেই ওই প্রতিবেদনের শেষ অংশ ছিল সাকিব ও মাহমুদউল্লাহময়।
ওই প্রতিবেদনের শেষ অংশটা তুলে ধরলাম- “কেউ বলবেন না যে, মেধা প্রজ্ঞা ও টেকনিকে ম্যাথিউজের চেয়ে পিছিয়ে সাকিব ও মাহমুদউল্লাহ। দুজনই যথেষ্ঠ পরিণত, অভিজ্ঞ ও যে কোন পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের সামর্থ্য রাখেন।
কিন্তু মেধা প্রজ্ঞাকে কাজে লাগিয়ে ম্যাচ শেষ করে দল জিতিয়ে বিজয়ীর বেশে মাঠ ছাড়ার ইচ্ছেটাই কম। এই ইচ্ছে শক্তি বাড়াতে হবে। ‘আমি পারি। আমার সামর্থ্য আছে দলকে জেতানোর। ম্যাচ শেষ করে মাঠ ছাড়ার। এটাই আমার কাজ। এই দৃঢ় সংকল্প আর তাগিদটা বড্ড দরকার সাকিব ও মাহমুদউল্লাহর।”
কাল রাতে সেই ম্যাচ শেষ করে ফেরার দৃঢ় সংকল্প ছিল সাকিব ও মাহমুদউল্লাহর মধ্যে। আর সে দৃঢ় সংকল্প এবং মাঝ সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়া দলকে তীরে ভেড়াতে প্রাণপন চেষ্টাও ছিল। এই প্রাণপন চেষ্টা আর দৃঢ় সংকল্প যে হারা ম্যাচ জেতাতে পারে- শুক্রবার রাতে টিভির সামনে বসে তা নিজ চোখে দেখেছেন কোটি বাঙ্গালী।
প্রতিকুল অবস্থায় বীরের মত মাথা তুলে দাঁড়াবার পর্যাপ্ত সামর্থ্য আছে সাকিব ও মাহমুদউল্লাহর। তা নিয়ে সংশয় সন্দেহ নেই কারোরই; কিন্তু সে সামর্থ্যরে প্রয়োগ ঘটে কম। কালেভদ্রে। শুক্রবার রাতে সাকিব ও মাহমুদউল্লাহ দুজনই সে সামর্থ্যরে প্রমাণ রেখেছেন।
যে করেই হোক এ বিপদ-সংকট কাটাতেই হবে। টিম সাউদি আর ট্রেন্ট বোল্ট যত বিধ্বংসি বোলিংই করুন না কেন, দল যত প্রতিকুল অবস্থায়ই পড়–ক না কেন- আমরা কিছুতেই হাল ছাড়বোনা। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করবো। এই দৃঢ় সংকল্পই শেষ পর্যন্ত এক নতুন ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে।
ইতিহাস ও পরিসংখ্যান জানাচ্ছে সাকিব এবং মাহমুদউল্লাহ এর আগেও অনেক ভাল ভাল ইনিংস খেলেছেন। তার ফিরিস্তি দিয়ে শেষ করা যাবে না। মাহমুদউল্লাহ হচ্ছেন প্রথম বাংলাদেশি যার এক বিশ্বকাপে আছে একজোড়া শতরান।
গত ২০১৫ বিশ্বকাপে এই নিউজিল্যান্ড আর ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে অনবদ্য সেঞ্চুরি করেছিলেন মাহমুদউল্লাহ। আর সাকিব তো বল ও ব্যাট হাতে বাংলাদেশের প্রাণশক্তি। প্রাণভোমরা। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে সর্বাধিক ১৫ বার ম্যাচ সেরার পুরষ্কারটা তার হাতেই উঠেছে; কিন্তু কাল ভাল খেলায় আগের সব ভালোর রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছেন দু’জন।
ইতিহাস-পরিসংখ্যান ও ম্যাচ কন্ডিশন সব সে সত্যই জানান দিচেছ। কাল সাকিব আর মাহমুদউল্লাহ পঞ্চম উইকেটে তুলে দিয়েছেন ২২৪ রান। বলার অপেক্ষা রাখে না, শুধু পঞ্চম উইকেটেই নয়, যে কোন উইকেটে এটা ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পার্টনারশিপ।
লক্ষ্য ২৬৬। আর ৩৪ রানে চারজন আউট। এরচেয়ে খারাপ অবস্থা আর ডশ হতে পারে? যে চারজন সাজঘরে, তার মধ্যে ছিলেন তামিম ইকবাল। যিনি আগের দুই ম্যাচে দলের সেরা পারফরমার। ইংল্যান্ডের সাথে সেঞ্চুরি আর অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৯৫ রানের ইনিংস খেলা তামিম কাল ফিরে গেছেন শূন্য রানে।
ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৭৯ রানের লড়াকু ইনিংস উপহার দেয়া মুশফিকও ছিলেন প্রথম আউট হওয়া চারজনের কাতারে। এবারের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে আগের দুই ম্যাচে যাদের ব্যাট কথা বলেছে, যারা রান করেছেন- সেই তামিম-মুশফিক শুরুতেই সাজঘরে। সঙ্গে ওপেনার সৌম্য আর ওয়ান ডাউন সাব্বির।
এরকম ভাঙ্গাচোরা আর প্রতিকুল অবস্থায় নিজেকে স্বাভাবিক রাখা কঠিন। রাজ্যের মানসিক চাপ এসে ভর করে ভিতরে। দুই দিকে দুর্দান্ত বোলিং হচ্ছে। সাউদি প্রচন্ড জোরের ওপর বল সুইং করাচ্ছেন। বোল্ট-মিলনেও কম যাচ্ছেন না। যেমন গতি তেমন বাউন্স আর কিছু বল বিপজ্জনকভাবে এদিক ওদিক সুইং করছে।
এমন বোলিংয়ের বিরুদ্ধে উইকেট আগলে রাখাটাই দায়। তারওপর রানের তাড়া। জিততে হলে পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ পথ। এ যে ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে সাগর পাড়ি দেয়ার মত অবস্থা! ভড়কে যাবারই কথা।
কিন্তু সাকিব আর মাহমুদউল্লাহ চীনের প্রাচীরের মত অনঢ়। অনমনীয় থাকলেন। কোনরকম ভয়-ডর আচ্ছন্ন করতে পারেনি। অবিচল আস্থার প্রতিমূর্তি দু’জন। এরকম কঠিন সংকট, চাপ ও প্রতিকূল অবস্থায় এমন ইস্পাত দৃঢ়তা! চোখে দেখেও বিশ্বাস করা কঠিন।
কিন্তু বাস্তবে সে কাজটিই করে দেখিয়েছেন সাকিব ও মাহমুদউল্লাহ। সাকিব যে চাপের মুখে বড় ইনিংস খেলতে পারেন, প্রচণ্ড গতির ফাস্ট বোলিংয়ে এতটুকু বিচলিত হন না- তা আগেই জানা।
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। এ বছর জানুয়ারিতে ওয়েলিংটনে ট্রেন্ট বোল্ট আর টিম সাউদির ক্ষুরধার ফাস্ট বোলিংয়ের বিরুদ্ধে কি দারুণ ডাবল সেঞ্চুুরিটাই না হাঁকিয়েছিলেন সাকিব। ১৬০ রানে ইমরুল, তামিম, মাহমুদউল্লাহ আর মুমিনুল আউট।
সেই কঠিন চাপে সাকিব ত্রানকর্তা। সঙ্গে মুশফিকুর রহীম। পঞ্চম উইকেটে ৩৫৯ রানের রেকর্ড জুটি। যা টেস্টে যে কোন উইকেটে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পার্টনারশিপ। ৪১৮ মিনিটে ২৭৬ বলে ২১৭ রানের অবিস্মরণীয় ইনিংস সাকিব আল হাসানের।
এবার ওয়ানডেতেও চরম বিপদে জ্বলে উঠলো সাকিবের ব্যাট। তার মানে তারা পারেন। তবে সেটা হঠাৎ হঠাৎ...। এই ভাল খেলার দৃঢ় প্রত্যয় ও কঠিন সংকল্পটা যেদিন থাকে, সেদিন ঠিকই ভাল খেলেন সাকিব ও মাহমুদউল্লাহ।
শুধু ভাল খেলা নয়, চটকদার স্ট্রোক প্লে, চার-ছক্কার ফুলঝুড়ি ছোটানো আর একটি হাফ সেঞ্চুরিতেই দায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ নয়। আমাদের কাছে দল ও দেশবাসীর প্রত্যাশা অনেক বেশি। আগে ও পরে যখনই হোক, আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে ইনিংস বা ম্যাচের শেষ পর্যন্ত টিকে থাকা এবং দল জিতিয়ে সাজ ঘরে ফেরা।
কথাটা কানে লাগলেও সত্য, এই বোধ-অনুভবটা তুলনামুলক কম। এই অনুভব কম থাকার একটা বড় কারণ হলো, টিম বাংলাদেশে দায়িত্ব ও কর্তব্য ঠিকমত বন্টন করা নেই। একেক জনকে একেক সিরিজে একেক পজিশনে খেলানো হয়। এক সিরিজে মাহমুদইল্লাহ তিন কিংবা চারে খেলেন। আবার অন্য সিরিজে তাকে নামিয়ে আনা হয় ছয় কিংবা সাতে।
পজিশন স্থির না থাকায় ব্যাটসম্যানের অ্যাপ্রোচ-অ্যাপ্লিকেশন ও পারফরমেন্সে ধারাবাহিকতা কম। কাজেই ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং পজিশন ঠিক করা খুব দরকার। তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যও বেঁধে দেয়া প্রয়োজন। সেটা হলে দায় এবং তাগিদও বাড়বে।
তখন সাকিব আর মাহমুদইল্লাহর ব্যাট আরও ধারাবাহিক হবে। ম্যাচ শেষ করে সাজ ঘরে বিজয়ীর বেশে ফেরার দৃঢ় প্রত্যয় ও সংকল্পও বাড়বে। তাহলে আর কোন সংকটই থাকবে না। অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মত বাংলাদেশও অনুকুল-প্রতিকুল, সব পরিস্থিতিতে এভাবেই ম্যাচ জিতবে। জয়ের পাল্লাও আরও ভারী হবে।
এআরবি/আইএইচএস/আরআইপি