তামিমের মতো উইকেটের চরিত্র বুঝে খেলল না কেউ!
একই মাঠের সব উইকেটই যে একরকম হবে এমন কথা নেই। একই কিওরেটরের হাতে তৈরি, মাটি ও আনুসাঙ্গিক উপাদান-উপকরণও এক; কিন্তু তারপরও পাশাপাশি উইকেটের চরিত্র ভিন্ন হতে পারে। একটি ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি। কোনটা স্পোর্টিং। অন্যটি আবার হয়তো ফাস্ট বোলিং সহায়ক। কোনটা আবার স্পিনিং ট্র্যাক।
বিশ্বের সব ক্রিকেট মাঠের পাশাপাশি পিচের এমন ভিন্নতা আছে। বাংলাদেশের শেরে বাংলা, ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়াম, চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম আর খুলনার শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামেও এমন আছে। সেখানেও পাশাপাশি উইকেটের আচরণ ও চরিত্রে ভিন্নতা আছে।
ওভালে ইংল্যান্ড ও বাংলাদেশ যে পিচে খেলা হয়েছে তার সাথে একই মাঠের আজকের পিচের আচরণ, গতি-প্রকৃতির পার্থক্য পরিস্কার। ১ জুনের উইকেটটি ছিল শতভাগ ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি। আজ যে পিচে বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ হচ্ছে, তা অত ব্যাটিং সহায়ক নয়। আবার খুব যে বোলিং উপযোগি; তাও নয়।
এ উইকেটে একটু গতি কম। বল খানিক মন্থর গতিতে ব্যাটে এসেছে। টুর্নামেন্টের তৃতীয় দিন এ উইকেটেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার স্কোর ছিল ২৯৯। অসাধারণ ব্যাটিং করেছেন হাশিম আমলা আর ডু প্লেসিস। আমলার শতক (১১৫ বলে ১০৩) আর ডু প্লেসিসের (৭০ বলে ৭৫) ১৪৫ রানের বড় জুুটিতে ৩০০‘র দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল প্রোটিয়ারা। জবাবে লঙ্কান ইনিংস শেষ হয়ে গিয়েছিল ২০৩ রানে।
সে ম্যাচে লঙ্কানদের পথের কাঁটা হয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকান লেগস্পিনার ইমরান তাহির। মাত্র ২৭ রানে চার লঙ্কানকে সাজঘরে ফেরত পাঠিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার জয়কে সহজ ও বড় করে দেন ইমরান তাহির।
বোঝাই গেল উইকেটের আচরণ ও চরিত্র ঠিক ঠাউরে নিয়ে মাঠে নেমেছে অস্ট্রেলিয়া। অজি অধিনায়ক স্মিথ ও কোচ লেম্যান বুঝে ফেলেছিলেন, এটা একটু অন্য ধরনের পিচ। এখানে ফ্রি স্ট্রোক প্লে খুব সহজ হবে না। বল একটু থেমে আসতে পারে। তাই তো একাদশে দুই স্পেশালিস্ট স্পিনার ট্রাভিস হেড ও অ্যাডাম জাম্পা।
দু’জনে মিলে ১২ ওভারে তুলে নিলেন তিন উইকেট। লেগস্পিনার জাম্পার পকেটে জমা পড়লো দুটি। আর সাকিবের মুল্যবান উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের ইনিংসে শেষ পেরেক ঠুকে দিলেন অফস্পিনার হেড।
অন্যদিকে মাশরাফির দল হাঁটলো ভুল পথে। একাদশ সাজানো দেখে মনে হলো বাংলাদেশ উইকেট চিনতে কিছুটা ভুল করেছে। আর সে কারণেই পঞ্চম বোলার হিসেবে মেহেদী হাসান মিরাজ খেললেও ইমরুল কায়েস ঠিক থেকে গেছেন। বাদ গেছেন মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত।
এ জায়গাতে আবার ভুল। খানিক স্লো পিচ। এখানে বরং মোসাদ্দেক থাকলে একটা স্লো বোলিং অপশন বেশি থাকতো। মোদ্দা কথা, আবার একাদশ নির্বাচনে অদুরদর্শিতা ও ভুলের খেসারত।
তারপর ব্যাটিংয়ে নেমেও ভুল পথে হাঁটা শুরু করে বাংলাদেশ। বল একটু-আধটু সুইং করছে দেখে এবং বুঝেও সৌম্য অফস্ট্যাম্পের বাইরে অযথা খোঁচাখুঁচির চেষ্টা করলেন। সেটাই কাল হলো।
হ্যাজলউডের বলে অফস্ট্যাম্পের বাইরের বলে ব্যাট পেতে কট বিহাইন্ড হলেন সৌম্য। উইকেটে বল একটু দেরিতে আসে। সাইড শট খেলতে হবে একটু দেখে। সে চিন্তা না করে অফস্ট্যাম্পের বাইরে খাট লেন্থের বলকে ফ্ল্যাশ করতে গিয়ে কভার পয়েন্টে ক্যাচ দিলেন ইমরুল।
সময় নিয়ে একটু দেরিতে খেললে বল গালি আর পয়েন্টের মাঝখান দিয়ে সীমানার ওপারে চলে যেত; কিন্তু উইকেটের গতি না ঠাউরে একটু আগে খেলে ফেলার মাশুল দিলেন ইমরুল।
তামিম আবারও আস্থার প্রতিমূর্তি। একদিক আগলে রাখার কাজে মনোযোগী; কিন্তু এরপর খানিক ভাগ্য বিপর্যয়। সাকিব প্রশ্নবিদ্ধ লেগবিফোর উইকেটের সিদ্ধান্তের ফাঁদে। নির্ভরতার প্রতীক মুশফিকও এদিন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারলেন না। ফিরে গেলেন মাত্র ৯ রানে।
মিডিয়াম পেসার হেনরিকসের ভিতরে আসা ডেলিভারিতে পিছনের পায়ে লাগলো মুশফিকের। আম্পায়ার সঙ্গে সঙ্গে আঙ্গুল তুলে দিলেন। ঠিক প্রায় একই অবস্থায় বিদায় নিলেন সাকিব আল হাসানও।
৫৩ রানে তিন উইকেট খোয়া যাবার পর তামিম আর সাকিব খেলা ধরে ফেলেছিলেন প্রায়। ইনিংসের শুরুর দিকের ক্ষত সেরে নতুনভাবে ইনিংস সাজানোয় মনোযোগী হয়েছিলেন তামিম আর সাকিব।
কিন্তু আম্পায়ার নাইজেল লংয়ের এক সিদ্ধান্তে ঐ জুটি জমে ওঠার আগেই ভাঙ্গলো। অফস্পিনার ট্রাভিস হেডের রাউন্ড দ্যা উইকেট ডেলিভারি অফস্ট্যাম্পের অন্তত চার আঙ্গুল বাইরে পিচ করা ডেলিভারি অনেক দুর সামনে এগিয়ে খেলতে গিয়ে ব্যাটে আনতে ব্যর্থ হলেন সাকিব।
অফস্ট্যাম্পের বাইরে পিচ পড়া ডেলিভারি এবং অনেকদুর সামনে এগিয়ে খেলা- দুয়ে মিলে আম্পায়াররা এসব ক্ষেত্রে বেনিফিট অফ ডাউট ব্যাটসম্যানের পক্ষেই দিয়ে থাকেন। আম্পায়ার্স কল নট আউট থাকলেই হয়ত সাকিব ই যাত্রায় রক্ষা পেয়ে যেতেন।
কিন্তু নাইজাল লং তা না করে সোজা আঙ্গুল তুলে দিলেন। যেহেতু আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত, তাই রিভিউতে পেল বাড়তি গুরুত্ব। কপাল পুড়লো সাকিবের। তার মানে ৪৮ বলে ২৯ রান হয়ত আহামরি কিছু নয়। ওয়ানডেতে অনেক ভাল ভাল ইনিংস আছে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের; কিন্তু আজ তার ইনিংসটি লম্বা হলে দলের উপকারে আসতো। তা না হওয়ায় তামিম ও সাকিবের ৬৯ রানের জুটি ভাঙ্গলো।
আর তারপর সব যেন বালির বাঁধের মত ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে গেল। একদিক আগলে রাখার দায়িত্বটা অনেক্ষণ পালন করা তামিম শতরানের দোরগোড়ায় গিয়ে হঠাৎ ধৈর্য্য হারিয়ে ফেললেন। ফার্স্ট বোলার স্টার্কের খাট লেন্থের বলের ওপর চোখ সরিয়ে বাতাসে ভাসিয়ে পুল খেলতে গিয়ে নিজের উইকেট বিসর্জন দিলেন তামিম।
আউট হবার আগ পর্যন্ত যে ইনিংসটির পরতে পরতে প্রাণপন লড়াইয়ের দৃঢ় প্রত্যয়। ১১৪ বলে ৯৫ রানের সংগ্রামী ইনিংসটির শেষ হলো খানিক আলগা হাতে নেয়া শটে। তারপরও সাব্বির আর মাহমুদউল্লাহ দায়িত্ব নিয়ে খেলে তামিমকে সঙ্গ দিতে পারলে হয়ত রানটা আড়াইশর ঘরে নিয়ে যাওয়া যেত।
কিন্তু সাব্বির আর মাহমুদউল্লাহও তাড়াহুড়ো করলেন। দেখে মনে হলো রান তোলার অনেক তাড়া তাদের কাঁধে। দুজনই আউট হলেন লেগস্পিনার জাম্পাকে তাড়া করতে গিয়ে।
প্রথমে সাব্বির। একটু ওপরের দিকের ডেলিভারি। ভাবলেন- পেয়েছি। কভার ও এক্সট্রা কভারের ওপর দিয়ে চালানোর মোক্ষম ডেলিভারি। সোজা এক্সট্রা কভারে ক্যাচ চলে গেল।
আর মাহমুদউল্লাহ অফস্ট্যাম্পের বাইরের ডেলিভারি কাট করতে গেলেন শরীরকে বেশি দুরে সরিয়ে। ব্যাটের ভিতরের কানায় লেগে বল গিয়ে আঘাত হানলো উইকেটে। পরিষ্কার বোঝা গেল তামিম-সাকিব ছাড়া আর একজনও উইকেটের গতি-প্রকৃতি বুঝে উঠতে পারেননি। এটাকেও আগের ম্যাচের মত ৩০০ প্লাস রানের পিচ ভেবে ব্যাট ছুড়েছেন। আসলে এটা ছিল ২৬০-২৭০ এর পিচ। অথচ ইনিংস শেষ হয়ে গেল মাত্র ১৮২ রানে।
একটু দেখে ও রয়ে সয়ে উইকেটে সেট হবার চেষ্টা করলে এখানে রান করা যেত। তামিম ইকবালের ইনিংসটাই তার বড় দলিল; কিন্তু বাকিরা যে দেখেও ওই পথে হাঁটলেন না। তামিম ও সাকিবের জুটির মত আর একটি বড় জুটি হলেই কিন্তু রান আড়াইশো হয়ে যেত।
তা হলেই মাশরাফির দল জিতে যেতো, তা নয়। তবে লড়াই করার পুঁজি অন্তত হতো। তা না হওয়ার আফসোস থেকেই গেল ভক্তদের।
এআরবি/আইএইচএস