ব্যাটিং-বোলিংয়ে যত সমস্যা ‘ডেথ ওভারে’
বারবার, শতবার, হাজারবার, বহুবার বলা হয়, হচ্ছে প্রস্তুতি ম্যাচের ফল ধর্তব্য নয়। যে ধরনের ম্যাচের নামেই প্রস্তুতির গন্ধ, তাকে মূল লড়াই ভাবার কোন কারণ আছে কী? অতিবড় ক্রিকেট পণ্ডিতও বলবেন, না নেই। আর থাকার কথাও না। কারণ ক্রিকেটীয় পরিভাষা, ব্যাকরণ আর সংস্কৃতিতে কোন সফর, সিরিজ বা আসরের আগে দলগুলো যাতে নিজেদের প্রস্তুত করতে পারে সে দিকে লক্ষ্য করেই মূলত প্রস্তুতি বা প্র্যাকটিস ম্যাচের আয়োজন। কেউ কেউ আবার ওয়ার্ম আপ বা গা গরমের খেলাও বলে থাকেন।
এটা অনেকটাই নাটক মঞ্চস্থ হবার আগে স্টেজ রিহার্সেলের মত। নাট্যকার ও প্রযোজক নাটক মঞ্চায়নের আগে অভিনয় শিল্পীদের মান যাচাই করেন। সেট ঠিক আছে কী না খুঁটিয়ে দেখেন। সাউন্ড ও আনুসাঙ্গিক সব কিছু চলনসই আছে কি না, তাও পর্যালোচনা করেন। একই ভাবে ক্রিকেটে প্রস্তুতি ম্যাচে দলগুলোর কোচ এবং টিম ম্যানেজমেন্ট পাখির চোখে ক্রিকটারদের অ্যাপ্রোচ, অ্যাপ্লিকেশন আর পারফরমেন্স পরখ করেন। আর মূল লড়াইয়ের লক্ষ্য, পরিকল্পনা এবং একাদশ চূড়ান্ত করার আগে প্রস্তুতি ম্যাচ পায় অন্যরকম গুরুত্ব। তবে সেটা মূলত প্রস্তুতির নিরিখে। সে ম্যাচের জয়-পরাজয় ততটা মূখ্য নয়।
তবে এটা সত্যি কোন কোন সময় কোন সিরিজ বা আসরের ঠিক আগে প্রস্তুতি ম্যাচে ভালো পারফরমেন্স ও জয় দলকে চাঙ্গা করে। জায়গা মত ভালো খেলতে অনুপ্রেরণা জোগায়। টিম স্পিরিট বাড়ে। যেমন ২০০৭ সালে ওয়েষ্ট ইন্ডিজের মাটিতে বিশ্বকাপের ঠিক আগে গা গরমের ম্যাচে কিউইদের সঙ্গে জয়টা দারুণভাবে উজ্জিবীত করেছিল টাইগারদের।
বিশ্বকাপে মাঠে নামার আগে নিউজিল্যান্ডকে প্রস্তুতি ম্যাচে হারিয়ে সত্যিই বুক ভরা সাহস জন্মেছিল হাবিবুল বাশার বাহিনীর। এখন টাইগাররা যাকে তাকেই হারান। নিজেদের দিনে তামিম, সৌম্য, সাব্বির, মুশফিক, সাকিব, মাহমুদউল্লাহ, মাশরাফি ও মোস্তাফিজদের শৌর্য্য-বীর্য্যের কাছে হার মানে সব বড় বড় শক্তি।
কিন্তু ২০০৭ সালের বিশ্বকাপের আগের চিত্রটা এমন ছিল না। টাইগাররা আজকের মত টগবগে হয়ে ওঠেননি। তাই তখন কোন বড় শক্তিকে হারানো ছিল অনেক বড় কৃতিত্ব। সময়, পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতার আলোকে ২০০৭ সালের বিশ্বকাপের আগে ব্লাক ক্যাপ্সদের সঙ্গে প্রস্তুতি ম্যাচের জয়ও ছিল অনেক বড় প্রাপ্তি, অর্জন ও সাফল্য। তাতে দলের সাহস, উদ্যম বেড়ে গিয়েছিল বহুগুণে। সামর্থ্যের প্রতি আস্থা ও আত্ববিশ্বাসও হয়েছিল প্রবল। যার ফলশ্রুতিতে গ্রুপের প্রথম ম্যাচে ভারতকে হারিয়ে হৈ চৈ ফেলে দেয়া। আর সুপার এইটে গিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে আরেক অবিস্মরণীয় জয়।
এবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ঠিক আগে গত ২৪ মে আয়ারল্যান্ডের মাটিতে তিন জাতি আসরে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে ৫ উইকেটের স্মরণীয় জয়ের দেখা মিলেছে। প্রথমবার দেশের বাইরে হারানো এবং ওয়ানডে র্যাং কিংয়ে প্রথমবার ছয় নম্বরে প্রমোশন পাওয়া, দু`দুটি বড় অর্জন ও উৎসবে মেতে ওঠার পর্ব হলো উদযাপিত।
নিশ্চয়ই তাতে মাশরাফি বাহিনীর মনোবল ও উদ্যম বেড়েছে। শুধু ঘরের মাঠে নিজেদের অনুকূল কন্ডিশনে নয়, আমরা দেশের বাইরে ভিন্ন পরিবেশেও কিউইদের হারাতে পারি। ভালো খেলতে খেলতে আর সাফল্যের সিড়ি বেঁয়ে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা আর ওয়েষ্ট ইন্ডিজকেও র্যাং কিংয়ে পেছনে ফেলে ওপরে ওঠা সম্ভব, এ আত্ববিশ্বাসও এখন ভিতরে।
ইংল্যান্ডের মাটিতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির অফিসিয়াল ওয়ার্মআপ (তবে ওয়ানডে ইন্টারন্যাশনাল নয়) ম্যাচে পাকিস্তান ও ভারতের সঙ্গে প্রস্তুতি ম্যাচ দুটি নিয়েও ভক্ত, সমর্থকদের বাড়তি উৎসাহ আগ্রহ মূলত ঐ কারণেই। অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে এই গা গরমের ম্যাচ দুটি নিয়ে সবার আগ্রহ সত্যিই বেশি। সবার ধারণা ও বিশ্বাস এই দুই প্রতিবেশি ও সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের সঙ্গে প্রস্তুতি ম্যাচ জিততে পারলে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভালো করার বাড়তি রসদ মিলবে, এই বিশ্বাস থেকেই আসলে প্র্যাক ম্যাচ দুটিকে ঘিরে বাড়তি কৌতূহল ও আগ্রহ।
গতকাল (শনিবার) পাকিস্তানের সঙ্গে গা গরমের ম্যাচে সে আস্থা ও আত্ববিশ্বাস বাড়ানোর সুবর্ণ সুযোগও তৈরি হয়েছিল। বার্মিংহামের এজবাস্টনে একদম তীরে এসে তরী ডুবেছে। নিশ্চিত প্রায় জয় হাতছাড়া করেছে মাশরাফির দল। প্রায় পুরো ম্যাচে পাকিস্তানিদের ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে, তাদের ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়ে শেষ পর্যন্ত শেষ ছয় ওভারে আলগা বোলিং ও ক্যাচ মিসের মহড়াই হারের কারণ হিসেবে বেশি কথা হচ্ছে। আফসোস ও অনুশোচনার মাত্রাও বেশি।
তারপরও হতাশ ও হতোদ্যম হয়ে পড়ার কিছু নেই। মনোবল, আস্থা, আত্ববিশ্বাস বাড়ানোর রসদ থাকলেও শেষ কথা হলো এটা প্রস্তুতি ম্যাচ। যাতে জিতলে সাহস, উদ্যম ও অনুপ্রেরণা বাড়ে। কিন্তু হারলে সব হারানোর বেদনা গ্রাস করে না। বরং এটা কখনো কখনো ভূল ত্রুটি সংশোধনের উপযুক্ত ক্ষেত্র।
শনিবার পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের ম্যাচের পোস্ট মর্টেম করলেই বেড়িয়ে আসবে, টাইগারদের ফাঁক-ফোকর কোথায়? কিসে ঘাটতি? সবাই একমত হবেন, বাংলাদেশ হেরেছে এক জায়গায়। ব্যাটিং-বোলিং দুই বিভাগেই শেষ ভালো হয়নি। ব্যাটিংয়ে তামিম ইকবালের শতরান, ইমরুল কায়েসের অর্ধশতক আর মুশফিকের দ্যুতিমাখা ব্যাটিংয়ের পরও শেষ ভালো হয়নি।
শেষ ৫ ওভারে হাতে উইকেট থাকার পরও বাংলাদেশ করেছে মাত্র ৩৭ রান। আর সেখানে মাত্র দুই উইকেট হাতে থাকা অবস্থায় পাকিস্তান তুলেছে ৬৩ রান। আসলে এখানেই পার্থক্যের দেয়াল গড়ে উঠেছে। শুরুর ১০ ওভার বাদ দিলে যত সময় গড়িয়েছে, ততই ম্যাচে বাংলাদেশের প্রাধান্য ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইনিংসের মাঝামাঝি বাংলাদেশের স্কোর ছিল এক উইকেটে ১৬২। আর পাকিস্তানিদের সংগ্রহ ঠিক তিন উইকেটে ১৪৮।
৩০, ৩৫ এবং ৪০ ওভার শেষেও বাংলাদেশ ছিল পরিষ্কার এগিয়ে। ৩০ ওভার শেষে টাইগারদের রান যখন তিন উইকেটে ১৯৭, সেখানে পাকিস্তানের স্কোর ৫ উইকেটে ১৭৩। ৩৫ ওভারে গিয়েও সে ধারাই অব্যাহত ছিল। বাংলাদেশ ২৩৫/৩ আর পাকিস্তান ২০১/৫। ৪০ ওভারে গিয়ে দু`দলের রান পার্থক্যর সেই ব্যবধান একই থাকে বাংলাদেশ (২৬৮/৪) ও পাকিস্তান (২৩৩/৬)। ৪৫ ওভার শেষে বাংলাদেশের রান যখন ৩০৪, তখন পাকিস্তানিরা ৮ উইকেট হারিয়ে ২৭৯।
ক্রিজে দুই পেস বোলার ফাহিম আশরাফ আর হাসান আলী। ফাহিম আশরাফ এখনো আন্তর্জাতিক অভিষেকই হয়নি। আর ১৬ ওয়ানডেতে সাতবার ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়ে মাত্র ৩৩ রান করা হাসান আলীর সর্বোচ্চ ছিল স্কোর ১৩। ঐ ধ্বংসস্তুপের মধ্যে দাঁড়িয়ে কোন জুটি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেন, শেষ ছয় ওভারে ৮২ রান করে জিততে পারেন, তা ছিল সবার ধারনার বাইরে। এই দুই পাকিস্তানি
কিভাবে বাংলাদেশের সর্বনাশ ডেকে আনেন, তার একটি ছোট চালচিত্র দেখুন : সর্বনাশের শুরু হয় ৪৫ নম্বর ওভারে; যখন অফস্পিনার মিরাজ দুই বাউন্ডারি ও এক ছক্কা হজমসহ দিয়েছেন ১৯ রান। তারপর ৪৬ নম্বর ওভারে সাকিব ১৩, ৪৭ নম্বর ওভারে মাশরাফি দুই ছক্কা হজমসহ ১৬, ৪৮ নম্বর ওভারে শফিউল এক ছক্কা হজম সহ ১০, ৪৯ নম্বর ওভারে তাসকিন ১১ আর দিনের শেষ ওভারে মাশরাফি ৩ বলে ৬+৩+৪ = ১৩ রান দিয়ে বসেন। আর তাতেই নিশ্চিত প্রায় জয় হয় হাতছাড়া।
ওপরের তথ্য উপাত্ব পরিষ্কার সাক্ষী দিচ্ছে বাংলাদেশ হেরেছে ডেথ ওভারের ব্যাটিং ও বোলিংয়ে। হাতে পর্যাপ্ত উইকেট থাকা সত্বেও শেষ ৫/৬ ওভারে কেউ ২০০ স্ট্রাইকরেটে ঝড়ো ইনিংস খেলতে পারেননি। আর শেষ দিকে দুই পাকিস্তানি ফাহিম ও হাসান আলীর মত আনকোরা নবীন ও অনভিজ্ঞ উইলোবাজের ব্যাটিং সামলানো সম্ভব তোড় হয়নি।
তবে কি সেই তোড় সামলানোর অস্ত্র নেই বাংলাদেশের? আছে। ভুলে গেলে চলবে না, এ ম্যাচে ছিলেন না বাঁহাতি পেসার মোস্তাফিজুর রহমান। এ ম্যাচে তার অভাববোধ হয়েছে। অনেকেই বলেছেন, মোস্তাফিজের চতুর গতির পরিবর্তন মানে স্লোয়ার কাটার দলের অনেক বড় সম্পদ। ফাহিম আশরাফ আর হাসান আলীর বেপরোয়া ব্যাটিং থামাতে মোস্তাফিজের একটি স্লোয়ারই ছিল যথেষ্ঠ। পাশাপাশি রুবেল হোসেনকে খেলানোর কথাও মনে হয়েছে। বর্তমান ফর্মে তাসকিনের চেয়ে রুবেল ভালো অবস্থায় আছেন।
তবে কোচ ও টিম ম্যানেজমেন্ট তাসকিনকে একটু বেশি পছন্দ করেন। কিন্তু কঠিন সত্য হলো, শতভাগ ব্যাটিং উপযোগী পরিবেশে তাসকিনের অযথা গতি সঞ্চারের চেষ্টা বারবার বুমেরাং হয়। সেই জায়গায় রুবেল তুলনামূলক রক্ষণাত্মক। সে কারণেই রুবেলের বলে রান কম ওঠে।
এআরবি/এমআর/জেআইএম