শেরে বাংলায় নতুন মাটির ওপরে নতুন ঘাস
সবার জানা, এবার শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ঘরোয়া ক্রিকেটের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ আসর ঢাকা প্রিমিয়র লিগ হচ্ছে না। তার বদলে ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়াম এবং বিকেএসপির তিন ও চার নম্বর মাঠে নিয়মিত চলছে লিগের ম্যাচগুলো।
কেন মিরপুরের হোম অফ ক্রিকেটে লিগ হচ্ছে না? সে কারণও মোটামুুটি জানা- হোম অব ক্রিকেটের আউটফিল্ডের সংস্কার ও পরিচর্যার কাজ চলছে। ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু করা হয় স্টেডিয়ামের সংস্কার কাজ। এখনও চলছে সেই কাজ। স্টেডিয়াম সংস্কার কাজের কী অবস্থা, কিভাবে চলছে আউটফিল্ড প্রস্তুতির কাজ- তা পাঠকদের জানাতেই জাগো নিউজের বিশেষ এই আয়োজন।
একটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পরিচর্যা ও সংস্কার কাজের প্রসঙ্গ উঠলেই সবার আগে চলে আসে পিচ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার কথা। প্রথমেই জানিয়ে রাখি, ২০০৫ সালে নির্মিত শেওে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা অত্যাধুনিক।
এবার যে বিশাল কর্মযজ্ঞ হলো, সেখানে পিচ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার কোন কাজ হয়নি। কাজ করার প্রয়োজনও ছিল না। পিচ রয়েছে আগের মতই। পাশাপাশি যে পাঁচ-ছয়টি উইকেট আছে, তা সম্পুর্ণ অক্ষত রেখেই শুরু হয় মাঠের সংস্কার কাজ।
সেখানে ড্রেনেজ ব্যবস্থা অত্যাধুনিক ও কার্যকর আছে। তাই পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থারও কাজ হয়নি। মূলতঃ কাজ হয়েছে আউটফিল্ডের ওপরের স্তরের মাটি উপড়ে নতুন মাটি ও বালুর মিশ্রনে ওপরের ছয় ইঞ্চি আবরণ নতুন করে নির্মাণ। আর সাথে পুরনো ঘাস উপড়ে ফেলে দিয়ে নতুন দূর্বা ঘাস লাগানো।
সর্বশেষ খবর, ওপরের ছয় ইঞ্চি স্তরের মাটি অপসারণ এবং নতুন মাটি ও বালুর সংমিশ্রনের কাজ শেষ হয়েছে মাস খানেক আগেই। এরপর ঘাস লাগানোর কাজও শেষ হয়েছে কিছুদিন আগে। সর্বশেষ অবস্থা, মানে আজকের শেরে বাংলার অবস্থা হলো- ঘাস লাগানো শেষে মাঠের ৩০ গজে নতুন সবুজ মিহি দূর্বা ঘাস গজাতে শুরু করেছে।
প্রায় সাড়ে তিন মাস আগে (ফেব্রুয়ারি) শুরু হয়েছিল প্রাথমিক কাজ। ধারনা করা হচ্ছে আগস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হোম সিরিজ দিয়ে আবার মুখর হয়ে উঠবে শেওে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম।
এর আগে যে বিশাল কর্মযজ্ঞ হলো, তা নিয়ে জাগো নিউজের সাথে কথা বলেছেন বিসিবি পরিচালক ও গ্রাউন্ডস কমিটি চেয়ারম্যান হানিফ ভুঁইয়া। আলোচনার শুরুতেই হানিফ ভুঁইয়া জানালেন, আমরা হুট করেই কাজে হাত দেইনি। একটা সুদুরপ্রসারি লক্ষ্য ও পরিকল্পনায় মাঠের কাজ শুরু করেছি। কাজ শুরুর পর আমরা স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগিয়েছি এবং সবচেয়ে বড় কথা, এই প্রথম দেশি দূর্বা ঘাসের ব্যবহার করা হয়েছে মিরপুর স্টেডিয়ামে।
কাজের শুরুতে অস্ট্রেলিয়ান বিশেষজ্ঞের সরণাপন্ন হয়েছেন জানিয়ে হানিফ ভুঁইয়া বলেন, ‘মূল কাজে হাত দেবার আগে আমরা ও বিসিবির কিউরেটর কিংবা স্থানীয় বিশেষজ্ঞের সরণাপন্ন হইনি। আমরা লক্ষ্য করেছি, দেশের সব কটি মাঠের মত হোম অব ক্রিকেট শেরে বাংলার আউটফিল্ডের চেহারাও কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে উঠছে। ঘাসের ঔজ্জ্বল্যে মিহি ভাব কমে কেমন যেন খাপছাড়া লাগতো। তাই মাঠে কী ধরনের কাজ প্রয়োজন, তা জানতে বিসিবি গ্রাউন্ডস কমিটি সর্বপ্রথম অস্ট্রেলিয়ান বিশেষজ্ঞ সিয়াম স্মিথের সরণাপন্ন হই। যাদের প্রতিষ্ঠানের নাম ল্যাবো স্পোর্টস। এ বছরের শুরুর দিকে, গত ১৫ জানুয়ারি অস্ট্রেলিয়ান বিশেষজ্ঞ ঢাকা আসেন এবং শেরেবাংলার মাঠ খুঁটিয়ে দেখেন। তারপর কি কি করনীয়, সে সম্পকে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দেন। সেই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই মাঠের সংস্কার কাজে হাত দেয়া হয়েছে।’
প্রসঙ্গতঃ ২৬ ফেব্রুয়ারি জাগো নিউজে এই মাঠের সংস্কার ও পরিচর্যার কাজ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে বিসিবি গ্রাউন্ডস কমিটির ম্যানেজার আব্দুল বাতেনের মাধ্যমে জাগো নিউজের পাঠকরা আগেই জেনে গিয়েছিলেন, শেরে বাংলার অত্যাধুনিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা একদম ঠিক ও কার্যকর আছে। তাতে হাত দেবার প্রয়োজন নেই।
আজ বিসিবি গ্রাউন্ডস কমিটি প্রধানও সেটা জানালেন। পুরো মাঠের নির্মাণ শৈলি ও ড্রেনেজ সিস্টেমে হাত দেয়া হয়নি। শুধু আউট ফিল্ডের ওপরের স্তরের ৬ ইঞ্চি পরিমাণ মাটি কেটে নতুন মাটি ফেলা হচ্ছে। তাতে করে ওপরের স্তরে চেপে বসা বালু সরে যাবে। মাঠ আরও সজীব সতেজ হয়ে উঠবে।
হানিফ ভুঁইয়া আরও জানান, মাঝে কন্ট্রাক্টদের গড়িমসি ও গাফিলতিতে মাঠের ওপরের স্তরের মাটি উপড়ে নতুন মাটি ফেলার কাজে একটু বিলম্ব হয়েছে। সেটা দুই থেকে আড়াই মাসের মধ্যে শেষ করার কথা থাকলেও তিন মাস লেগেছে। এরপর শুরু হয় ঘাস লাগানোর কাজ। কলকাতার ইডেন গার্ডেন এবং অস্ট্রেলিয়া সিডনি স্টেডিয়াম থেকে এনে ঘাস লাগানোর কথা শোনা গেলেও হানিফ ভুঁইয়া জানান, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের কচি মিহি দূর্বা ঘাসই লাগানো হয়েছে।
গত ১মে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘাস লাগানোর কাজ শেষ হয়েছে। বিসিবি গ্রাউন্ডস কমিটির চেয়ারম্যানের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ঘাস লাগানো শেষ হবার পর খেলা উপযোগি হতে অন্তত ১০ সপ্তাহ সময় লাগে। এর অর্থ, মে-জুন শেষে জুলাইয়ের মাঝামাঝি শেরে বাংলার ঘাসের ওপর দিয়ে দৌড়ানো সম্ভব হবে।
এ বিশাল কর্মযজ্ঞর শুরু অসি বিশেষজ্ঞর প্রেসক্রিপশন মেনে; কিন্তু কাজ হয়েছে স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের তত্ত¡াবধান ও পরামর্শে। হানিফ ভুঁইয়া জানান, প্রকৌশল ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক অধ্যাপক কাজ করেছেন। তাদের পরামর্শও নেয়া হয়েছে। এরকম একটি ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শেষ করতে শেষ পর্যন্ত কত খরচ হতে পারে?
এ প্রশ্ন করা হলে বিসিবি গ্রাউন্ডস কমিটি প্রধান জাগো নিউজকে জানালেন, ‘সব মিলিয়ে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার মত খরচ হচ্ছে।’
হানিফ ভুঁইয়া আর কিছু না জানালেও ভিতরের খবর, অসি বিশেষজ্ঞ পরিকল্পনা জমা দেয়ার আগে স্থানীয় মাঠ পরিচর্যা ও সংস্কার নির্মাতা এক প্রতিষ্ঠান এই কাজে সাড়ে চার কোটি টাকা মূল্য হাঁকিয়ে বসেছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিন ভাগের এক ভাগ অর্থে এ কাজ সম্পাদিত হচ্ছে।
হানিফ ভুঁইয়া সে জন্য কৃতিত্ব দাবি না করলেও বোর্ডের অভ্যন্তরে তাকে বিশেষ সাধুবাদ জানানো হয়েছে। বিসিবি গ্রাউন্ডস কমিটির প্রধান ধন্যবাদ পেতেই পারেন। কিছু দিন আগেও কক্সবাজার স্টেডিয়ামে ঘাস লাগানো বাবদ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ২২ লাখ টাকা খরচ দেখিয়েছে। আর শেরে বাংলার বিশাল আউটফিল্ডে ঘাস লাগাতে কোন বাড়তি অর্থই খরচ হয়নি বলতে গেলে।
হোম অব ক্রিকেটের মাঠ কর্মীরাই সে কাজ করে দিয়েছেন। এখানেই শেষ নয়। এই প্রথম বিসিবি গ্রাউন্ডস কমিটি নিজেদের অর্থায়ন ও উদ্যোগে একটি নার্সারিও করতে যাচ্ছে। যা বোর্ডে অনুমোদন পেয়েছে।
হানিফ ভুঁইয়া জাগো নিউজকে জানালেন, ‘সব প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেট শক্তিরই নিজস্ব নার্সারি আছে। আমাদের ছিল না। আমরা কক্সবাজার স্টেডিয়ামের উত্তর-পূর্ব দিকে একটি নার্সারি গড়ে তোলার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। আশা করছি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ও ঈদের ছুটির পর ঐ নার্সারি তৈরির কাজে হাত দেয়া হবে। তারপর সেখান থেকে দেশের সব স্টেডিয়ামে ঘাসের চারা সরবরাহ করা হবে। আর ঘাসের জন্য বিদেশে ছোটাছুটি করতে হবে না। বিপুল অর্থও ব্যয় হবে না।
এআরবি/আইএইচএস/আরআইপি