১৯০ করেও রকিবুলের আক্ষেপ
শেষ ওভারে মোহামেডানের জেতার জন্য দরকার ছিল ৩০ রানের। আবাহনী পেসার কাজী অনিকের করা দিনের ১০০ নম্বর ওভারের প্রথম বলে ব্যাট ছোঁয়াতে পারলেন না কামরুল ইসলাম রাব্বি। উইকেটরক্ষক মোহাম্মদ মিঠুনের গ্লাভসে বল যাবার আগেই দৌড়ে স্ট্রাইকিং প্রান্তে চলে আসলেন রকিবুল হাসান।
পরের পাঁচ বলে প্রয়োজন ২৯ রান। তার মানে সব বলে ছক্কা হাঁকানো ছাড়া জেতা সম্ভব নয়। আর চার ছক্কার সাথে এক বাউন্ডারি হাঁকাতে পারলে ম্যাচ টাই। এমনই কঠিন সমীকরণ। অসম্ভব কিছু নয়। তবে খুব কঠিন। বাংলাদেশের কেন কোনো পর্যায়ের ক্রিকেটেই শেষ পাঁচ বলে পাঁচ ছক্কা হাঁকিয়ে ম্যাচ জেতার রেকর্ড নেই।
আজ বিকেএসপিতে কী সেই রেকর্ডটিই করতে চাচ্ছিলেন রকিবুল? অধরা সাফল্যের মাইলফলক ছুঁয়ে ইতিহাস গড়ার স্বপ্ন দেখছিলেন মোহামেডান অধিনায়ক? ৩৬৬ রান করতে নামার পর বিষয়টাকে অতিরঞ্জিত কিংবা আকাশ কুসুম কল্পনা মনে হতে পারে।
তবে কথা সত্য। আজ দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথের শেষ ওভারে এমন লঙ্কাকাণ্ড ঘটানোর চিন্তাই করেছিলেন রকিবুল। দিন শেষে নিজ মুখেই বললেন সে কথা, ‘শেষ ওভারে আসলে পাঁচ ছক্কা হাঁকানো ছাড়া জেতার কোনই পথ ছিল না। পাঁচ ছক্কা হাঁকাতে পারলে হয়ত জিতে যেতাম। আমি সে চেষ্টাই করেছি।’
এ ম্যাচের স্কোরলাইন না দেখে আর বিকেএসপির চার নম্বর মাঠে দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বীর মর্যাদা ও ঐতিহ্যও লড়াইয়ে আজকের চালচিত্র না দেখে যে কেউ এমন মন্তব্যকে বাড়াবাড়ি ভাবতে পারেন। হয়ত ভাবছেনও। কেউ কেউ হয়ত বলাবলি করছেন, আরে শেষ পাঁচ বলের সবকটায় কি আর ছক্কা হাঁকানো যায়?
তা যায় কি যায় না, সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে আজকের মাঠের চালচিত্র বলে, সেটা একদম অসম্ভব ছিল না। কারণ নিজে বলেছেন তিনি তার আগে দশ দশটি বিশাল ছক্কা হাঁকিয়েছেনও।
যার ছয়টিই ছিল অফস্পিনার শুভগত হোমের বলে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেননি রকিবুল। আবাহনীর তরুণ বাঁ-হাতি পেসার কাজী অনিকের বলে ডিপ স্কোয়ার লেগের ওপর দিয়ে ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে ক্যাচ দিলেন ডিপ স্কোয়ার লেগ বাউন্ডারি ৭ গজ সামনে দাঁড়ানো মনন শর্মার হাতে।
রকিবুল আউট হবার সঙ্গে নিভে গেল মোহামেডানের আশার প্রদীপ। স্কোরলাইন আবাহনী ৩৬৬। জবাবে মোহামেডান ৩৩৯। ব্যবধান ২৭। তারপরও ম্যাচ শেষে যত কথা রকিবুলকে নিয়ে। প্রথম সেশনের দুই সেঞ্চুরিয়ান লিটন দাস (১০৩ বলে ১৩৫) আর নাজমুল হোসেন শান্ত (১০০ বলে ১১০) আর শেষ অংশে ৫ উইকেট শিকারী আবাহনীর ভারতীয় বাঁ-হাতি স্পিনার মনন শর্মা- এদের কারো কথা উঠলোই না।
বিজয়ী আবাহনী ড্রেসিং রুম ও ভক্তরাও চির প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারানোর আনন্দে মেতে উঠলেন না। সবার মুখে কেবল রকিবুল বন্দনা, ‘কী ব্যাটিংটাই না করলেন রকিবুল!’ শুধু দর্শক ও সমর্থকদের প্রশংসায় ধন্য হওয়া নয়। ম্যাচ সেরার পুরস্কারটিও উঠলো তার হাতে।
দল জেতেনি তাতে কি? এমন বীরোচিত আর ঝড়ো (১৩৮ বলে ১৯০) ব্যাটিংয়ের পুরস্কার অবশ্যই ম্যাচ সেরা পারফরমার; কিন্তু তাতে কি আর মন ভরে? দিন শেষে ম্যাচ জিততে না পারার আক্ষেপ রকিবুলের কণ্ঠে। তবে একটা বিষয় উল্লেখ করার মত। জিততে না পারার জন্য অন্য কাউকে দায়ী করলেন না তিনি।
তার জায়গায় যে কেউ হলে বলতেন, সহযোগীদের কাছ থেকে যথাযথ সাপোর্ট না পেয়েই হেরেছি। স্কোরলাইন আর খেলার চালচিত্র তাই বলে। আবাহনীর পক্ষে লিটন দাস ও নাজমুল হোসেন শান্ত সেঞ্চুরি করেছেন। তিন তরুণ সাইফ হাসান (২৮), সাদমান (২৮) ও শুভাগত হোম (২৭ বলে ৪৮) আরও তিনটি কার্যকর ইনিংস খেলেছেন।
সেখানে মোহামেডানের রকিবুলের ১৯০ ছাড়া উল্লেখ করার মত স্কোর শুধু লঙ্কান আসালঙ্কার (৬৩)। তিনি ছক্কা হাঁকাতে পারেন। নিয়মিত না হলেও ২৫/৩০ রান করতে পারলে তার ব্যাট থেকে অন্তত গোটা দুয়েক ছক্কার দেখা মেলে। তাইতো তার নাম ‘ছক্কা মিলন’। সেই মিলনও ছিলেন নিষ্প্রভ।
মোহামেডান কোচ সোহেল ইসলামের আক্ষেপ, শেষ দিকে নাজমুল মিলন হাত খুলে খেলতে পারলেই হয়ত এ ম্যাচের দৃশ্যপট অন্যরকম হতে পারতো; কিন্তু অধিনায়ক একবারের জন্যও কাউকে দোষারোপ করেননি।
খেলা শেষে আসরের নামাজের ইমামতি করে ড্রেসিং রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে মিডিয়ার সামনে কথা বলতে গিয়ে বলে উল্টো আবাহনীর লিটন দাস ও নাজমুল হোসেন শান্তর প্রশংসা করলেন, ‘স্রষ্টাকে ধন্যবাদ। প্রশংসা করছি আবাহনীর লিটন ও শান্তর। ওরা খুব ভাল ব্যাটিং করেছে। আমাদেও ব্যাটিংও ভাল হচ্ছিল। তবে শেষ দিকে গিয়ে আর হলো না। সেই না পারাটা হতাশার অবশ্যই। আক্ষেপ থেকে গেল। ভাল খেলেও দলকে জেতাতে পারিনি। দুঃখ থেকে গেল।’
তার সামনে ছিল ডাবল সেঞ্চুরির সুযোগ; কিন্তু রকিবুল জানিয়ে দিলেন, ডাবল সেঞ্চুরির চিন্তা তার মাথায় ছিল না, ‘কোন ব্যক্তিগত টার্গেট ছিল না আমার। ২০০ করবো, এমন চিন্তা মাথায় আসেনি। ওই সময় আসলে ব্যক্তিগত টার্গেটের কথা না ভেবে আমি চেয়েছিলাম দলকে জেতাতে।’
বাংলাদেশের প্রথম শেণীর ক্রিকেটে একমাত্র ট্রিপল সেঞ্চুরি তার। সেই সুবাদে তার ব্যাট থেকে আসা ৩১৩ রানের ইনিংসটিই ঘরোয়া প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় ব্যক্তিগত ইনিংস। আজ বিকেএসপি মাঠে করা ১৯০ রান লিস্ট ‘এ’ ফরম্যাটে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদেরও মধ্যে সর্বোচ্চ রান।
দুটোর তুলনা করতে গিয়ে রকিবুলের কথা, ‘সীমিত ওভারের ফরম্যাটে এটাই আমার সেরা ইনিংস। আর ওটা প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে সেরা।’
মাঝে অবসরের ঘোষণা দিলেও ভিতরে ভিতরে এখনো জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন দেখেন রকিবুল, ‘জাতীয় দলের স্বপ্ন মাথায় আছে। তবে এখন আর সেটা নিয়ে চিন্তা করি না। এখন ভাবছি দল নিয়ে। মোহামেডানের মত ঐতিহ্যবাহি দলের অধিনায়ক হয়েছি। সেটা অনেক বড় গর্বের। চেষ্টা করছি দায়িত্ব পালনের।’
সাধারনতঃ তাকে এমন আক্রমণাত্বক খেলতে দেখা যায় না। তার ব্যাট থেকে এভাবে এক ম্যাচে ১০ ছক্কার রেকর্ডও নেই। এটা কি নতুন রকিবুল? এ প্রশ্নর জবাবে রকিবুলের চিবুক সোজা করা জবাব, ‘এটা আমার ন্যাচারাল গেম। আপনারা যদি পেছনে তাকান, তাহলে এমন ব্যাটিং দেখতে পাবেন। আমি আগেও এমন ব্যাটিং করেছি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আর সময়ের সাথে সাথে মানুষ শিখে। আমিও শিখেছি। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি তিন ফরম্যাটে খেলার জন্যই উপযোগি ক্রিকেটার আমি।’
এআরবি/আইএইচএস/এমএস