‘একটি সুযোগের অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে আছি’
খুব বেশি পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। দুই বছরেরও কম সময় আগে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের পেস ডিপার্টমেন্টের অন্যতম নির্ভরতা। বাংলাদেশের পেস বোলিংয়ের কথা উঠলে অধিনায়ক মাশরাফির বিন মর্তুজার পর তার নামটিই উঠে আসতো সবচেয়ে বেশি।
এমনকি ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপেও বাংলাদেশ পেস বোলিংত্রয়ীর অন্যতম ছিলেন রুবেল হোসেন; কিন্তু সময়ের প্রবাহমানতায় রুবেল এখন বাংলাদেশের পেস বোলিংয়ের প্রধান তিনজনের বাইরে। এখন ওয়ানডেতে পেস ডিপার্টমেন্ট সাজানো হচ্ছে মাশরাফি বিন মর্তুজা, মোস্তাফিজুর রহমান ও তাসকিন আহমেদকে দিয়ে।
রুবেল হোসেন বাইরে পড়ে গেছেন। কখনো কখনো সমসাময়িক শফিউল আবার নতুন শুভাশিষ-কামরুল ইসলাম রাব্বিরাও তার আগে চলে গেছেন। যে রুবেলের প্রচন্ড গতি, এক্সপ্রেস ডেলিভারি, আচমকা লাফিয়ে ওঠা বল ও প্রচন্ড গতির ইনসুইং এবং ইয়র্কারে অনেক বড়বড় ব্যাটসম্যানের বুক কাঁপতো।
অনেক নামি-দামি উইলোবাজ উইকেট দিয়ে চলে এসেছেন, সেই রুবেল আজ একাদশের বাইরে। প্রহর গুনছেন ১১ জনে জায়গা পেতে। আয়ারল্যান্ডে তিন জাতি টুর্নামেন্ট ও চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি স্কোয়াডে রয়েছেন; কিন্তু জানা নেই ১১জনে থাকবেন কি না?
বাংলাদেশ কোন ম্যাচে চার পেসার নিয়ে মাঠে নামলেই শুধু একাদশে জায়গা হতে পারে তার। এ ছাড়া স্বাভাবিক ও চলমান ধারায় রুবেলের ১১জনে জায়গা পাওয়া কঠিন। কারণ এখন বাংলাদেশের পেসত্রয়ী মানেই মাশরাফি, মোস্তাফিজ ও তাসকিন।
এর বাইরে থেকে কারো ঢোকাও কঠিন। তাই তো দেশ ছাড়ার আগে রুবেল হোসেনের কথা, ‘এখন সুযোগের অপেক্ষায় থাকা ছাড়া আসলে আমার আর কিছুই করার নেই। আমি একটি সুযোগের অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে আছি।’
রুবেল কি সে সুযোগ পাবেন? অধিনায়ক মাশরাফি, বাঁ-হাতি মোস্তাফিজ ও তাসকিন- এই ত্রয়ীর পেস বিভাগে কি কোন পরিবর্তন আসবে? তা নিয়ে ছোটখাট বিতর্ক হতেই পারে। তবে সাম্প্রতিক সময়ের চালচিত্রকে মানদণ্ড ধরলে এ মুহূর্তে বাইরে থেকে ওই তিনজনে জায়গা করে নেয়া কঠিন।
তবে রুবেল হোসেনের সামনে সুযোগ ও অবকাশ দুই’ই আছে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আগে আয়ারল্যান্ডে আইরিশ ও কিউইদের বিপক্ষে দুটি করে ওয়ানডে। এছাড়া চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আগে একাধিক গা গরমের ম্যাচও রয়েছে।
সেই ম্যাচগুলোয় সুযোগ পেয়ে কোন বিধ্বংসী ও ম্যাচ ঘোরানো বোলিং স্পেল উপহার দিতে পারলে রুবেল আবার ১১ জনে ফিরতেও পারেন। রুবেলের কী এখন সে সামর্থ্য আছে? কেন থাকবে না? ইতিহাস ও পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, হ্যাঁ এই তো দুই বছর আগেও বাগেরহাটের এ গতি তারকা এক্সপ্রেস ডেলিভারি দিয়ে দল জিতিয়েছেন।
ঠিক ২৫ মাস আগের কথা, ২০১৫ সালের ৯ মার্চ অ্যাডিলেডে ইংলিশদের বিরুদ্ধে বিশ্বকাপের বিশাল মঞ্চে বাংলাদেশ পেয়েছিল ১৫ রানের অবিস্মরনীয় জয়। পেসার রুবেল সে জয়ের অন্যতম নায়ক। যদিও কাগজে-কলমে ম্যাচ সেরার পুরষ্কার উঠেছিল মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের হাতে। ১৩৮ বলে ১০৩ রানের দায়িত্বশীল ইনিংস উপহার দিয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ। মুশফিকুর রহিমও ৭৭ বলে ৮৯ রানের দারুণ ইনিংস খেলে রেখেছিলেন কার্যকর অবদান।
বাঁ-হাতি সৌম্য সরকারের ৫২ বলে ৪০ রানও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যান ও অলরাউন্ডার নামধারিদের আর কেউ কিছু করতে না পারলেও মাহমুদউল্লাহ, মুশফিক ও সৌম্যর হাত ধরে ২৭৫ রানের লড়াকু স্কোর পায় বাংলাদেশ।
ওই রান জয়সূচক পুঁজিতে রূপান্তরিত হয় রুবেলের দুর্দান্ত বোলিংয়ের কারণে। ইংলিশ ওপেনিং জুটি (মঈন আলি) রান আউটে ভাঙ্গলেও আরেক ওপেনার ইয়ান বেল ও আলেক্স হেলস দ্বিতীয় উইকেটে খেলার নিয়ন্ত্রণ প্রায় নিজেদের হাতের মুঠোয় নিয়ে ফেলেছিলেন।
কিন্তু ইয়ান বেলের ৮২ বলে ৬৭ রানের ইনিংসটির ইতি ঘটিয়ে রুবেলই ভাইটাল ব্রেক থ্রু এনে দেন। এরপর দ্বিতীয় স্পেলে ইংল্যান্ড অধিনায়ক মরগ্যানকে শূন্য রানে ফিরিয়ে দেয়া। আর নিজের শেষ ও ইংলিশ ইনিংসের ৪৯তম নম্বর ওভারের পর পর দুই বলে স্টুয়ার্ট ব্রড ও জিমি অ্যান্ডারসনের উইকেট উপড়ে ফেলা। ১৪০ কিলোমিটারের আশপাশে আসা একজোড়া প্রচন্ড গতির দুর্দান্ত ইয়র্কার লেন্থের ডেলিভারিতে হতবিহ্বল ব্রড ও অ্যান্ডারসন বোল্ড।
বাংলাদেশ পায় ১৫ রানের ঐতিহাসিক জয়। রুবেল কি আবারো এমন আগুন ঝরানো বোলিং করতে পারবেন? সময় প্রবাহে এখনো কি সে বারুদ আছে তার বোলিংয়ে? সেই ফিটনেস, তূলনামুলক কম উচ্চতা নিয়েও ১৪০-এর আশপাশে এক্সপ্রেস ডেলিভারি এবং সুইং ও ইয়র্কারে ব্যাটসম্যানের ভীত কাঁপিয়ে দেয়ার সেই ক্ষমতা কি এখনো আছে রুবেল হোসেনের?
রুবেলের সাথে কথা বলে জানা হলো, তার আত্ববিশ্বাস আছে পুরোপুরি। বাগেরহাটের এ সাহসী যুবার নিজের ওপর আস্থাও প্রবল। তাই তো মুখে আশাবাদি বক্তব্য, ‘আমি এখ পুরোপুরি ফিট। ফুল রানআপে এবং ফুল পেসে বল করতে পারছি। শ্রীলঙ্কায় একটি মাত্র প্র্যাকটিস ম্যাচে খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম। ভাল করতে পারিনি। তবে নেটে প্রচুর বল করেছি। বোলিং করার পর বোঝা যায় কতটা ফিট আছি, কেবল বোলিং হচ্ছে। তারপরও ঢাকা প্রিমিয়ার লিগেও ভাল বোলিং (তিন ম্যাচে ৯ উইকেট। এখন পর্যন্ত সেরা বোলিং ফিগার ৬/২১) করেছি। সব কিছু মিলে আমার মনে হয় আমি আল্লাহর রহমতে শতভাগ ফিট। এখন শুধু সুযোগের অপেক্ষায়। একটি সুযোগ পেলেই সেটাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবো।’
রুবেল মানছেন এক সময় তিনি ছিলেন অন্যতম নির্ভরতা; কিন্তু কিছু ব্যক্তিগত ঘটনা ও ইনজুরি তার স্বর্ণ সময়ে বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছিল, সে কথা মানতে এতটুকু দ্বিধা নেই, ‘এক সময় আমি ছিলাম অপরিহার্য্য সদস্য; কিন্তু এখন ১১ জনের বাইরে।’
বোঝা গেল খুব খারাপ লাগে। তারপরও সত্য উপলব্ধি, ‘কঠিন সত্য হলো, টিম কম্বিনেশনের জন্য আমি সুযোগ পাই না। মাঝখানে আমার কিছু প্রবলেম হইছে। ইনজুরিতেও পড়েছি। মোদ্দাকথা খারাপ সময় গেছে।’
কিন্তু সে খারাপ সময় পার করে আবার আলোর পথে দাঁড়াতে বদ্ধপরিকর রুবেল। জাগো নিউজের সাথে একান্ত আলাপে অনেক কথার ভীড়ে একটি সংলাপই বলে দেয়, আবার একাদশে ফিরতে মরিয়া। সব কিছু উজাড় করে দিতেও দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ।
‘আমি হাল ছাড়তে রাজি নই। অনেক কষ্ট করে এই পর্যায়ে উঠে এসেছি। আল্লাহর রহমতে অনেক কষ্ট করেই আজকের অবস্থানে। মাঝে কিছু ব্যক্তিগত ব্যাপার ও ইনজুরি মিলে খারাপ সময় গেছে। তাই বলে আমি আর এই জায়গা ছাড়তে চাই না। ৭০টা (আসলে ৬৯ ওয়ানডেতে ৮৮ উইকেট) আর ২৪টি টেস্ট খেলেছি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টিকে থাকতে হলে কি কি করতে হয়, কি কি লাগে, তা ভালই জানা ও বোঝা হয়েছে।’
২০১০ সালে ইংল্যান্ড সফরের অভিজ্ঞতাকেও সামনে নিয়ে আসেন রুবেল, ‘ইংল্যান্ডের মাটিতে ২০১০ সালেও দুটি ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা আছে। সবচেয়ে বড় কথা, আমি নিজেকে পুরোপুরি প্রস্তুত করেছি। ইংল্যান্ডে পেস বোলাররা সাহায্য পায়। ভাল জায়গায় বল ফেলতে পারলে সফল হওয়া যায়। সুযোগ পেলে সামর্থের শেষ বিন্দু দিয়ে চেষ্টা করবো জ্বলে উঠতে। দলের কাজে লাগে এমন স্পেল উপহার দিতে।’
এআরবি/আইএইচএস/জেআইএম