এমন মাইলফলক চাই সবাই যেন মনে রাখে : মুশফিক
তার সমসাময়িক মাহমুদউল্লাহ, সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবাল সবারই আগে ওয়ানডে অভিষেক হয়েছে। এর মধ্যে মাহমুদউল্লাহ টেস্ট ক্যারিয়ার শুরুর দুই বছর আগেই ( ২০০৭ সালের জুলাইতে) ওয়ানডে খেলতে শুরু করেন। সাকিবেরও টেস্ট অভিষেকের আট মাস আগে ওয়ানডে অভিষেক হয়। আর তামিম টেস্ট ক্রিকেটে যাত্রা শুরুর ১১ মাস আগেই ওয়ানডে অভিষিক্ত হন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম মুশফিকুর রহীম। মাত্র ১৮ বছর বয়সে টেস্ট দিয়ে শুরু হয় আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। উইকেটরক্ষক হিসেবে নয়। পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান হিসেবেই।
২০০৫ সালের ২৬ মে ক্রিকেট তীর্থ লর্ডসে অভিষেক হয় মুশফিকের। তারও ১৫ মাস পর শুরু ওয়ানডে ক্যারিয়ার। খালেদ মাসুদ পাইলটের মতো সব সময়ের অন্যতম সেরা কিপার উইকেটের পিছনে গ্লাভস হাতে দাঁড়ালেও মুশফিক শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবেই দলে এসেছিলেন। তার মানে ওই অতটুকু বয়সেই মুশফিকের ব্যাটিং প্রতিভা আকৃষ্ঠ করেছিল সে সময়ের অধিনায়ক, কোচ, নির্বাচক ও টিম ম্যানেজমেন্টকে।
তাদের হিসাব ভুল হয়নি। এক যুগ আগে লর্ডসে ক্যারিয়ার শুরু করা মুশফিক এখন সন্দেহাতীতভাবে টেস্টে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের সবচেয়ে মজবুত খুঁটি। ওয়ানডেরও অন্যতম নির্ভরতা। বাংলাদেশ দল যেখানেই টেস্ট-ওয়ানডে খেলুক, মুশফিক অন্যতম নির্ভরতা। টেস্টে তামিম (৩৬৭৭) ও সাকিবের পর (৩৪৭৯) তৃতীয় সর্বাধিক ৫৪ ম্যাচে ৩২৬৫ রান। সাকিবের সঙ্গে দ্বিতীয় সর্বাধিক পাঁচটি করে সেঞ্চুরিরও মালিক। ওয়ানডেতেও তামিম (৫২৫১) আর সাকিবের (৪৭৭৬) পর তৃতীয় সর্বাধিক ৪১১৯।
কিন্তু কেন যেন ইংল্যান্ডের মাটিতে তার রেকর্ড অত ভালো নয়। ইংল্যান্ডে তিন টেস্টে ছয় ইনিংসে রান মোটে ৬২। সর্বোচ্চ ১৯। ২০১০ সালে এক ম্যাচে ২২। একই ভাবে আয়ারল্যান্ডে তার ব্যাট সেভাবে কথা বলেনি। দুই ম্যাচে রান ২২। সর্বোচ্চ ১৩*।
তার ব্যাট যেখানে ভীষণ অনুজ্জ্বল, সেই আয়ারল্যান্ড ও ইংল্যান্ডে খেলতে যাবেন। নিজেকে কীভাবে তৈরি করছেন মুশফিক? ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের মাটিতে পরিসংখ্যান খারাপ ভেবে চিন্তিত? নাকি আগে ভালো করতে না পারার সব ব্যর্থতা ঝেড়ে মুছে এবার ভালো কিছু করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ? জানতে ইচ্ছা করছে খুব, তাই না। জাগো নিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপে অনেক কিছু নিয়েই খোলাখুলি কথা বলেছেন মুশফিক।
অনেক কথার ভিড়েও একটা বিষয় পরিষ্কার ইংল্যান্ডে আগের অনুজ্জ্বলতা কাটিয়ে এবার ভালো করতে মুখিয়ে মুশফিক। সামর্থ্যের সবটুকু উজার করে দিতেও প্রস্তুত। কথাবার্তায় পরিষ্কার, নিজেকে মেলে ধরতে মুখিয়ে আছেন এ ব্যাটসম্যান কাম উইকেটরক্ষক। সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সও ভালো। মাঝে টেস্টে কিপিং নিয়ে খানিক মানসিক উৎপীড়নে ছিলেন। পরে তা কেটে গেছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, শ্রীলঙ্কায় একদিনের ফরম্যাটে কিপার মুশফিকের পারফরম্যান্স ছিল বেশ ভালো। সেদিক থেকে একটা মানসিক প্রশান্তিও আছে।
এদিকে প্রিমিয়ার লিগের পারফরম্যান্সটাও দারুণ। এখন পর্যন্ত তিন ম্যাচে সর্বাধিক রান এসেছে তার ব্যাট থেকেই। সব মিলে মুশফিক আত্মবিশ্বাসী। নিজের সামর্থ্যের ওপর আস্থাও যথেষ্ট। তার বিশ্বাস, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আগে ইংল্যান্ডের সাসেক্সে যে প্রায় দুই সপ্তাহের অনুশীলন ক্যাম্প হবে, সেটা খুব কাজে লাগবে। যদিও আমাদের সঙ্গে আবহাওয়া ও উইকেটে ওখানে দুই সপ্তাহ চেষ্টা করব কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে।
উইকেট কিপিং প্রসঙ্গ উঠতেই সোজা সাপটা উচ্চারণ, ‘কে কিপিং করবে? সেটাতো ম্যানেজমেন্টের ওপর নির্ভর করবে। তারা যেটা ভালো মনে করবে সেটাই হবে। তবে আমি ওয়ানডেতে নিয়মিতই কিপিং করেছি। আর আমার মনে হয় শ্রীলঙ্কায় আমি ভালোই করেছি। কিপিং পার্ট নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। এ দায়িত্বটা আবার পেলে সাধ্যমতো চেষ্টা করব ভালো করতে এবং দলকে সার্ভিস দিতে।’
টেস্ট অভিষেকের পাঁচ বছর পর ২০১০ সালে ইংল্যান্ডে খেলতে গিয়েও নিজেকে মেলে ধরা সম্ভব হয়নি। কোনো বাড়তি উদ্যম, অনুপ্রেরণা ও সংকল্প?
মুশফিকের কথা, ‘হ্যাঁ। আমি এখনও আফসোস করি টেস্ট অভিষেকের পর ইংল্যান্ডে আমি প্রত্যাশা মেটাতে পারিনি। নিজে যে টার্গেট সেট করে গেছি, তা পূর্ণ হয়নি। ফিরে এসেছি অসন্তুষ্টি নিয়ে। এবার আর সেই ইংল্যান্ডে খেলা। তাও চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির মতো বড় আসরে। খুব স্বাভাবিকভাবেই সবার দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে সে আসরের দিকে। আমিও তাকিয়ে। অনেক বড় সুযোগ ও প্লাটফর্ম। আমি অনেক কনফিডেন্ট। এমন কিছু করে দেখাতে চাই যাতে সবাই আমাকে মনে রাখে।’
তার একান্ত বিশ্বাস ও আস্থা, আমি যদি নিজের সেরাটা খেলতে পারি তাহলে অবশ্যই ভালো কিছু করা সম্ভব। ইংলিশ কন্ডিশনে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড তুলনামূলক কঠিন ও শক্ত প্রতিপক্ষ কিনা?
মুশফিকের ধারণা, ‘কন্ডিশনের কথা চিন্তা করলে তুলনামূলক কঠিন। তবে তা নিয়ে চিন্তার কিছু দেখতে চান না। তার অনুভব, যেমন কন্ডিশনে খেলা হোক আর প্রতিপক্ষ যেই থাকুক না কেন, আমার মনে হয় আমরা আর আগের জায়গায় নেই। আমার বিশ্বাস ওয়ানডেতে এখন আমরা অন্যরকম দল। আমরা শেষ তিন বছর যে ক্রিকেট খেলেছি, তাতে এখন আর কাউকে ভয় বা সমীহর কিছু নেই। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, আমরা যদি সেরা ক্রিকেট খেলতে পারি তাহলে ৩০০ রান করে এবং তাড়া করেও জিততে পারি।’
ব্যাটসম্যানদের না হয় ৩০০ করার শক্তি আছে। বোলারদেরও কি যেকোনো দলকে আটকানোর পর্যাপ্ত সামর্থ্য ও শক্তি আছে? মুশফিকের দাবি, অবশ্যই আছে। আমাদের এমন বোলিংও আছে। ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের মাটিতে বিশ্বকাপেও আমাদের পেসাররা অসম্ভব ভালো বোলিং করেছিলেন। মাশরাফি ভাই, তাসকিন আর রুবেল কি দারুণ বোলিং করেছিল। এবার তার সঙ্গে মোস্তাফিজ যোগ হয়েছে। আর শফিউল আছে। আমার মনে হয় আমাদের বোলাররা বিশেষ করে পেসাররা ভালো স্পেল করতে পারে, তাহলে স্কোর বোর্ডে যে রানই করি না না কেন, বিশ্বমানের ব্যাটসম্যানদেরও চাপে ফেলার সামর্থ্য রাখেন আমাদের বোলাররা। ’
এবারের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি নিয়ে নিজের কোনো বিশেষ লক্ষ্য ও পরিকল্পনা?
‘অবশ্যই আমার ব্যক্তিগত লক্ষ্য ও পরিকল্পনা আছে। আমি জানি এটা খুব বড় আসর। বড় প্লাটফর্ম এবং নিজেকে মেলে ধরার খুব উপযোগী ক্ষেত্র। তাই চেষ্টা করেছি নিজেকে তৈরি করতে। নিজেকে উজাড় করে দেয়ার সব চেষ্টাই থাকবে। যে কয়টা ম্যাচ খেলার সুযোগ পাই না কেন, চেষ্টা থাকবে এমন কিছু করে দেখানোর, যাতে সবাই মনে রাখে। নিজে এবং দল হিসেবে এমন এক মাইলফলক স্পর্শ করতে চাই, যা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’
নিজের ওপর আস্থা তার প্রবল। নিজের ব্যাটিংয়ের মূল্যায়ন করতে গিয়ে মুশফিকের ব্যাখ্যা, এখন আমি অনেক পরিণত ও আত্মবিশ্বাসী। ধারাবাহিকতাও আগের চেয়ে অনেক বেশি। এসব কিছুই আমাকে ভালো খেলতে সাহস জোগাচ্ছে। অনুপ্রাণিত করছে। মনে হচ্ছে আমি পারব। যদি আমার নিজের সেরাটা খেলতে পারি তাহলে অবশ্যই ভালো খেলা এবং বড় স্কোর গড়া সম্ভব। শুধু আমার নয়, আমাদের সবারই বিশ্বের সেরা বোলিংয়ের বিরুদ্ধেও রান করার সামর্থ্য আছে।’
মুশফিকের শেষ সংলাপ বলে দেয়, তার ভেতরের অনুভূতি ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব এক্সাইটেড। অনেক রোমাঞ্চিত। অনেক উদ্বেলিত। ভালো করতে মুখিয়ে আছি।’ মুশফিকের আশা পূর্ণ হলে টিম বাংলাদেশেরই মঙ্গল। কারণ ইতিহাস ও পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, গত তিন-চার বছরে বাংলাদেশের অনেক অর্জন ও স্মরণীয় সাফল্যে মুশফিকের অবদান প্রচুর। কাজেই তার ব্যাট কথা বলা মানেই টিম বাংলাদেশের জ্বলে ওঠা।
এআরবি/এমআর/জেআইএম