রাব্বির বাড়ি আর স্কুলে আনন্দের বন্যা
গোলাম রাব্বির চেয়ে তার ছোট ভাই গোলাম রাফির বয়সের পার্থক্য ৩ মিনিট। নারায়ণগঞ্জের মদনগঞ্জের বশির উদ্দিন রতন আর মেহবুবা রতন দম্পত্তির চার ছেলের মধ্যে প্রথম দুজন রাব্বি আর রাফি যমজ। পৃথিবীতে তাদের আগমন আর তাদের জীবনের শুভ সংবাদ যেন সৃষ্টিকর্তাই এভাবে সাজিয়ে রেখেছিলেন।
৩ মিনিটের ব্যবধানে পৃথিবীতে আসা রাব্বি আর রাফির জীবনে সুখবরটিও এলো অল্প ব্যবধানে। সেটা একদিনের। ৬৪ দেশের একটি বাংলাদেশ, যেখান থেকে একমাত্র ক্ষুদে ফুটবলার হিসেবে রাশিয়া যাবে ৩ মিনিটের বড় ভাই রাব্বি। সোমবার পাওয়া এ খবরের আনন্দের রেশ কাটতে না কাটতেই মঙ্গলবারের খবর- রাফিকে পছন্দ করেছে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি)। দুদিনের ব্যবধানে এ দুটি খবরে রাব্বির বাড়ি আর তার স্কুলে বইছে আনন্দের বন্যা। যার বেশিরভাগ জুড়েই রাব্বির রাশিয়া যাওয়ার জন্য নির্বাচিত হওয়ার খবরে।
বয়স কেবল ১১ বছর পার হয়েছে। এ বয়সের ছেলেরা পড়াশুনার চেয়ে বরং খেলাধুলায় বেশি মগ্ন থাকে। রাব্বিরা দুই ভাইও তাই। রাব্বি তো কারও এক হাতে চকলেট ও আরেক হাতে ফুটবল থাকলে সে ফুটবলই নিয়ে নিতো।
মদনগঞ্জ হাজী ইব্রাহিম আলমচান মডেল স্কুল এন্ড কলেজের ছাত্র রাব্বি রাশিয়ার জন্য মনোনীত হওয়ার পর বুধবারই প্রথম গিয়েছিল স্কুলে। সহপাঠীদের অনেকে যার এ কৃতিত্বের কথা আগেই জেনেছিল। রাব্বি স্কুলে যেতেই তাকে ঘিরে সবার তো মহাআনন্দ। শুধু কি সহপাঠী? প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল আহমদ হালিম মজহার তাকে নিজের কক্ষে নিয়ে বসিয়েছেন তারই পাশে রাখা বিশেষ চেয়ারে এবং ছবি তুলেছেন।
‘আমার পাশের চেয়ারটি আসলে রাখা বিশেষ কোনো ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানে আসলে তাকে বসতে দেয়ার জন্য। আজ রাব্বিকে ওই চেয়ারে বসিয়েছি। ছবি তুলেছি। একপর্যায়ে স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য রবিউল ইসলাম রবি আসলে রাব্বিকে দুজনের মাঝে রেখে আবার ছবি তুলি। তার সহপাঠীদের ডেকে পেছনে দাঁড় করিয়েও তোলা হয় ছবি। আমরা অনেক আনন্দিত। আনন্দের পরিমাণটা ভাষায় বোঝাতে পারব না’- টেলিফোনের অন্য প্রান্ত থেকে বলছিলেন রাব্বির স্কুলের প্রিন্সিপাল।
প্রিন্সিপাল যখন নিজেই আবেগাপ্লুত তখন তার ছাত্ররাতো হবেই। কেবল রাব্বির শ্রেণিরই নয়, অন্য শ্রেণির ছাত্ররাও তার সঙ্গে ছবি তোলার প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। ‘আমরা অত্যন্ত খুশি। গভর্নিং বডি, শিক্ষক, কর্মচারী এবং অন্য শিক্ষার্থী সবাই আমরা এ সুসন্তানকে অভিনন্দন জানিয়েছি। রাশিয়া যাওয়ার আগে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে রাব্বিকে সংবর্ধনা দেয়া হবে। সে আমাদের গর্ব’- বলছিলেন প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল আহমদ হালিম মজহার।
ছেলের এমন অর্জনে বাবা-মা যেন খুশিতে আত্মহারা, ‘এটা কেবল আমার সুনাম নয়, সবার। পুরো দেশের হয়ে রাব্বি যাবে রাশিয়ায়। আমরা সবার কাছে দোয়া চাই, যাতে ওখানে গিয়ে দেশের সম্মান রক্ষা করতে পারে। খবর জানার পর থেকেই ওর মা তাকে অনেক কিছু শেখাচ্ছে। আমি ২৮ বছর বিদেশে ছিলাম। প্রথম পাঁচ বছর মালয়েশিয়ায়, পরের ২৩ বছর সৌদি আরবে। যখন ছুটিতে আসতাম তখন অনেকে বলতেন এবার দেশে থাক, সন্তানদের প্রতি নজর দাও। তারপর ২০১৩ সালের ২৮ মার্চ আমি সৌদি থেকে একেবারে চলে এসেছি ২৩ বছর থাকার পর। আমার রাব্বি ও রাফি দুজনই ভালো ফুটবল খেলে’- বলছিলেন রাব্বির বাবা বশির উদ্দিন রতন।
এইটুকু ছেলে বিদেশে যাবে। মায়ের মনটা কেমন করছে? তার খারাপ লাগছে না? ‘এটা আমাদের বিশাল পাওয়া। রাব্বি যাবে খারাপও লাগছে, আবার আনন্দও লাগছে। পেটের সন্তান, কাছে থাকবে না কিছুদিন। এ খারাপ লাগাটা শুধু আমার। আর খুশির বিষয়টা পুরো দেশের। এখন আমাদের একটাই চাওয়া, সবাই যেন রাব্বির জন্য দোয়া করে’- বলছিলেন রাব্বির মা মেহবুবা রতন।
খবরটি জানার পর থেকে রাব্বি আছে স্বপ্নের ঘোরে। বাবা-মা ছাড়া একা যাবা এতবড় দেশে। ভয় করছে না? তুমি কি মনে মনে রাশিয়াকে ভাবছ? ‘আমি কোনো ভয় পাচ্ছি না। কাল রাতে অনেক ভেবেছি। বিমানে উঠব, আবার নামব। অনেক মানুষ দেখব। নতুন বন্ধু হবে, এসব। যে মাঠে খেলব, সে মাঠটা মনে হয় অনেক বড় হবে। আজ স্কুলে গেলে সবাই আমার সাথে ছবি তুলেছে। প্রিন্সিপাল স্যারও। আমার জন্য একজন ইংরেজি শিক্ষক ঠিক করে দিয়েছেন প্রিন্সিপাল স্যার। আমাকে নাকি জামা-কাপড়ও দেবে যাওয়ার সময়’- প্রতিক্রিয়া জানাল রাব্বি।
রাব্বিকে স্কুল থেকে সংবধর্না দেয়ার পরিকল্পনার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। রাব্বির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল জানিয়েছেন, রাব্বির জন্য আমরা শার্ট, প্যান্ট ও জুতা বানিয়ে দেব। রাশিয়া যাওয়ার আগ পর্যন্ত স্কুলের একজন ইংরেজি শিক্ষককে তাকে আলাদা করে পড়ানোর জন্য দায়িত্ব দিয়েছেন। এছাড়া মোক্তার হোসেন নামক এক স্থানীয় ব্যক্তি রাব্বিদের বাসায় এসে তাকে বিনা পারিশ্রমিকে ইংরেজি শেখানোর কথা বলে গেছেন।
রাফি মাত্র ৩ মিনিটের ছোটো রাব্বির চেয়ে। হঠাৎ করে কেউ চিনতে পারবেন না কে রাব্বি আর কে রাফি। জন্মের পর থেকে এক সাথে বড় হয়েছে। তুমি চলে যাবা, রাফি কি বলে? ‘রাফি বলেছে, ভালো করে খেলবি। আর আমার জন্য বুট, জার্সি, ট্র্যাকস্যুট আনবি। আমার বন্ধুরাও বলেছে- তুই কিন্তু ভালো করে খেলবি। আর যা পাবি কিনে নিয়ে আসবি।’
তুমি কেমন ফুটবলার হতে চাও? ‘আমি জাতীয় দলে খেলতে চাই। আবাহনী, মোহামেডান, শেখ জামাল, শেখ রাসেলের মতো দলেও খেলতে চাই’- জবাব রাব্বির। জাতীয় দলের কোনো খেলোয়াড়ের নাম জান? রাব্বি বলেন, ‘হ্যাঁ, এমিলি, সোহেল রানা, মামুনুল, চুন্নু।’
চুন্নুর (আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু) গল্প রাব্বি শুনেছে তার বাবার কাছে, ‘বাবা বলেছেন, চুন্নু স্যারের কথা। সে আমাদের এখানকার। ভালো ফুটবল খেলতেন। আমি তাকে কখনও দেখিনি।’
আরআই/আইএইচএস/জেআইএম