আকরামের বীরোচিত ইনিংসের ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট
এই তো আর মাস খানেক পরই বাংলাদেশ খেলতে যাবে আয়ারল্যান্ডে। জানেন কি এই আইরিশদের অখেলোয়াড়ীচিত আচরণ ও মানসিকতায় ভেস্তে যাচ্ছিল বাংলাদেশের বিশ্বকাপ স্বপ্ন। সেটা ছিল ১৯৯৭ সালের ২ এপ্রিল। কুয়ালালামপুরের রয়েল সেলাঙ্গার ক্লাব মাঠে আইরিশদের সঙ্গে গ্রুপ ম্যাচে অনায়াসে জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়েছিল আকরাম খানের দল। হাসিবুল হোসেন শান্ত (৩/২১), এনামুল হক মনি (২/২০) আর মোহাম্মদ রফিকের (২/২৪) সাঁড়াশি বোলিংয়ে মাত্র ১২৯ রানে অলআউট হয়েও বৃষ্টির পর কৌশল ও নানা ছলছুতোয় না খেলে বাংলাদেশের সম্ভাব্য জয় ছিনিয়ে নেয় আইরিশরা।
পাল্টা ব্যাটিংয়ে নেমে বাংলাদেশ বিনা উইকেটে ২৪ রান করার পর আইরিশরা বৃষ্টিতে আউট ফিল্ড ভিজে পিচ্ছিল হয়ে গেছে, এমন দাবি করে মাঠ ছাড়লে বাংলাদেশের নিশ্চিত জয় হাতছাড়া। এই ম্যাচের পয়েন্ট বণ্টন হওয়ায় বাংলাদেশের পথ চলা কঠিন হয়ে পড়ে। তখন হল্যান্ডের সঙ্গে জয় অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। আইরিশদের সঙ্গে পূর্ণ পয়েন্ট না পাওয়ায় ডাচদের সঙ্গে ম্যাচটি বাঁচা মরার লড়াই হয়ে যায় বাংলাদেশের।
নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে সেই অস্তিত্বের ম্যাচে টাইগারদের দিতে হয় সত্যিকার অগ্নি পরীক্ষা।
৪ এপ্রিল রাবার রিসার্চ ইনস্টিটিউট মাঠে বৃষ্টি বিঘ্নিত ম্যাচে আকরাম খানের বিরোচিত ব্যাটিংয়ে ডাচদের প্রবল প্রতিরোধ টপকে ৩ উইকেটের অবিস্মরণীয় বিজয়ে শেষ চারে পৌঁছে গিয়েছিল বাংলাদেশ। বৃষ্টি বিঘ্নিত ম্যাচে ডাচদের করা ১৭১ রানের জবাবে ১৫ রানে চার টপ অর্ডার আতহার আলী (৪) নাইমুর (০), সানোয়ার (০) ও আমিনুল ইসলামকে (৪) হারিয়ে চরম বিপাকে পড়ে আকরামের দল। দলের সংকটে ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন অধিনায়ক আকরাম খান নিজে।
পঞ্চম উইকেটে চট্টগ্রামের দুই যোদ্ধা আকরাম খান ও অভিজ্ঞ মিনহাজুল আবেদিনের ৫৫ রানের জুটিতে খাদের কিনারা থেকে ওঠা। তারপর আকরাম খানের ( ৯২ বলে ৬৮ রানে হার না মানা ইনিংস) একার লড়াইয়ে কঠিন সংগ্রামের পর জয়ের বন্দরে পৌঁছে যাওয়া। সাধারণত ম্যাচ জয়ে স্রষ্টার আনুকূল্য চান ভক্ত ও সমর্থকরা।
আর এই মাঠে ২০ বছর আগে ১৫ রানে ৪ উইকেট পতনের পর বাংলাদেশ ভক্ত ও সমর্থকরা বার বার বৃষ্টি চেয়েছিলেন। কারণ তারা ধরেই নিয়েছিলেন, বৃষ্টিতে এ ম্যাচ ধুয়ে মুছে গেলেই কেবল হার এড়ানো সম্ভব। অধিনায়ক আকরাম খানও বৃষ্টির আশায় গ্লাভস বদল ও পানি পানের অজুহাতে বার কতেক সময় ক্ষেপণ করতে গিয়ে আম্পায়ার ও ম্যাচ রেফারির রোষানলে পড়ছিলেন প্রায়।
এর মাঝখানে একটা কাজ হল। এক সময় বৃষ্টি আসলো। আবার থেমেও গেল। ডিএল ম্যাথডে বাংলাদেশের লক্ষ্য ছোট হয়ে গেল। ওভার কমলেও টার্গেট দাঁড়ালো ৩৩ ওভারে ১৪১। সেটা শাপে বরই হলো। ওভার কমে যাওয়ায় অলআউটের ভয় ডর কমলো খানিকটা। তখন বাংলাদেশ খেললো টি-টোয়েন্টি মেজাজে। আজ যার ভাইপো সীমত ওভারের ফরম্যাটে বাংলাদেশের আশা ভরসার কেন্দ্র বিন্দু সেই তামিম ইকবালের চাচা আকরাম খানের ব্যাটে বিদ্যুৎ খেললো।
নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি, কুয়লালামপুরের অদূরে রাবার রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মাঠে আকরাম খানের ক্যারিয়ার সেরা এবং সম্ভবত বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সব সময়ের কঠিন সংগ্রামী ইনিংসটি মাঠে বসে দেখার। দায়িত্ব নিয়ে বলছি, বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে মূল্যবান ইনিংস সেটা। এক কথায় আকরাম খানের ঐ ৬৮ রানের ইনিংস বেদির ওপর দাঁড়িয়ে আজকের বাংলাদেশের ক্রিকেট।
নান্দনিকতা ও সৃজনশীলতায় সেরা কি না? তা নিয়ে ছোট খাটো বিতর্ক হতেই পারে, তবে তীব্র চাপ সংকট এবং দেশের ক্রিকেটের গুরুত্ব বিবেচনায় সবচেয়ে কার্যকর সৃষ্টিশীল এবং সাহসী লড়িয়ে ইনিংস সেটা। একটা অদ্ভুত মিলের কথা বলি শুনুন, ১৯৮৩ সালে ভারত, ওয়েষ্ট ইন্ডিজকে ফাইনালে আর সেমিতে স্বাগতিক ইংলিশদের হারিয়ে প্রথমবার বিশ্বকাপ জিতলেও গ্রুপ পর্বে জিম্বাবুয়ের কাছে প্রায় হেরে বিদায় নিতে যাচ্ছিল। ১৭ রানে ইনিংসের অর্ধেকটা শেষ হবার পর হাল ধরেছিলেন তখনকার ভারত অধিপতি কপিল দেব।
তার ১৭৫ রানের অনবদ্য ও ঐতিহাসিক ইনিংসের ওপর ভড় করে ভারত চরম সংকট কাটিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে ঐতিহাসিক ও মহামূল্যবান ইনিংসটির কোন ভিডিও নেই। ঠিক একই ভাবে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে মূল্যবান ইনিংসটির কোন প্রামাণ্য দলিল বা ভিডিও ফুটেজ নেই। যে ফুটেজ হতে পারতো এদেশের ক্রিকেটের উত্তরণের সবচেয়ে বড় দলিল। সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন।
কিন্তু হায় সে ম্যাচের কিংবা আকরাম খানের বীরোচিত ও দল জেতানো ব্যাটিংয়ের কোন ভিডিও নেই। অথচ সেটাই দেশের ক্রিকেটের সফল সেনাপতি আকরাম খানের সাফল্যের দলিল। ২০ বছর আগে মালয়েশিয়ার মাটিতে নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে আকরাম খানের ব্যাট থেকেই বেড়িয়ে এসেছিল দেশের ক্রিকেটের হীরক খচিত ইনিংস। দলের বিপদে প্রয়োজনে যতটা ভালো খেলা সম্ভব, আকরাম ঠিক তত ভালই খেলেছিলেন। যে বল যেখানে খেলতে চেয়েছিলেন, সেখানেই গেছে। একবারের জন্য তাকে বিব্রত করতে পারেননি ডাচরা। আকরামের ব্যাট ফাঁকি দিয়ে বল প্যাডে লাগেনি। কিপারের গ্লাভসেও যায়নি। গভীর সমুদ্রে দিগবিদিকশূন্য জাহাজ যেমন সাহসী নাবিকের হাত ধরে বন্দরে ভেড়ে, নেদারল্যান্ডেসের কাছে অস্তিত্বের ম্যাচে ঠিক ঐ অবস্থায় পড়েছিল বাংলাদেশ।
এআরবি/এমআর/জেআইএম