তুলে রাখা বিজয় উৎসব কি ডাম্বুলাতেই হয়ে যাবে?
সময়ে কত কিছুই না বদলে যায়। ক্রিকেট যত অনিশ্চয়তায় ভরা খেলাই হোক না কেন, ২৫ মার্চ মাশরাফি বাহিনীর অমন ঝকঝকে তকতকে টিম পারফরম্যান্সের পর কেউ আর বাংলাদেশের সিরিজ হারের কথা মুখেও আনছেন না। সবার একটাই কথা, মাশরাফি বাহিনী ঠিক এমন খেললেই চলবে। আর কিছুই করতে হবে না।
উপরের দিকে তামিম-সৌম্য আর সাব্বিরের যে কোনো একজন বড় আর একজন ৪০ থেকে ৫০ রানের ইনিংস খেললেই হয়ে যাবে। সঙ্গে মুশফিক-সাকিব মাঝের অংশে আর মাহমুদউল্লাহ ও মোসাদ্দেক ফিনিশ করলে ব্যাটিং নিয়ে চিন্তা থাকবে না। বোলিংটাও ঠিক আছে। শুরুতে মাশরাফি-মিরাজ ব্রেক থ্রু এনে দেবেন। পরে তাসকিনের এক্সপ্রেস ডেলিভারি আর কাটার মাস্টার মোস্তাফিজ সুইং, স্লোয়ার আর কাটারের মিশেলে বিভ্রান্তি ছড়াবেন সঙ্গে সাকিব আল হাসান স্পিন ম্যাজিক। ফিল্ডিংটাও হতে হবে অমন চোস্ত। আগের ম্যাচে সৌম্য, মিরাজ আর শুভাগত যেভাবে চার-চারটি কঠিন ক্যাচ অসামান্য দক্ষতায় ধরে ফেলেছেন, এমন হলে আর কথাই নেই।
মঙ্গলবার ২৮ মার্চ, একই মাঠে ঠিক সেই বাংলাদেশকেই দেখতে চান ভক্ত ও সমর্থকরা। সবার ধারনা, এর চেয়ে ভালো হলেতো কথাই নেই। এমন টিম পারফরমেন্স হলেই জয়ের কেতন উড়বে আবার। এখন টিম ম্যানেজমেন্ট আর ক্রিকেটারদের দুটি দায়িত্ব। প্রথম কোন রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা না চালিয়ে ঐ কম্বিনেশন ধরে রাখা। আর ক্রিকেটারদের যেন আত্ন তুষ্টি চলে না আসে।
ডাম্বুলার উইকেট, মাঠ ও লঙ্কান বর্তমান দলটির সঙ্গে প্রথম ম্যাচের একাদশ একম লাগসই। মাশরাফি, তামিম, সাকিব, মুশফিক আর মাহমুদউল্লাহর মত অভিজ্ঞ, প্রচুর ওয়ানডে খেলা পারফরমার দলটির পঞ্চ পান্ডব। যারা জানেন, কখন কার সঙ্গে কোথায় কি করতে হবে? সঙ্গে পাশাপাশি সৌম্য, সাব্বির আর মোসাদ্দেকের মত তিন তিন জন প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান। যারা টগবগ করে ফুটছেন।
তামিম, মুশফিক আর সাকিব খেলতে খেলতে হাত পাকিয়ে ফেলেছেন। হাত খুলে খেলা, দলের ও সময়ের প্রয়োজনে ধরে খেলা, ধীরে ধীরে সিঙ্গেলস-ডাবলসসে খেলে খেলে ইনিংস সাজানো আর এক সময় খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে ওঠার কাজটি সবাই ভালো পারেন। তাই তো টেস্টে ৮ বলে ১৯ করা সাকিব দলের প্রয়োজনে ঠিক প্রথম ওয়ানডেতে পঞ্চাশ করেছেন একটি মাত্র বাউন্ডারি হাঁকিয়ে।
একই কথা প্রযোজ্য মাহমুদউল্লার বেলায়ও। একটু দেরিতে সৌরভ ছড়িয়েছে তার ব্যাট। টেস্টে বাদ পড়লেও ওয়ানডেতে তিনি যে দলের অন্যতম সম্পদ, তা শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট বোর্ড সভাপতি একাদশের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি ম্যাচ আর প্রথম ওয়ানডেতেই বোঝা গেছে। যে কোন বোলিং শক্তির বিরুদ্ধে মাথা সোজা করে ব্যাট চালনার পর্যাপ্ত সামর্থ্য আছে তাদের। প্রথম ম্যাচে তিনজনই সামর্থ্যের প্রমাণ রেখেছেন।
এর সঙ্গে মোস্তাফিজের মত বিশ্বমানের পেসার। যার কাটার, স্লোয়ার ঠিকমত বুঝে উঠতেই অনেক বড় বড় ব্যাটসম্যান খাবি খাচ্ছেন। সঙ্গে অফস্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজ। বয়স অল্প, কিন্তু প্রকৃতিগতভাবেই পরিণত। কোথায় কার বিরুদ্ধে কোন লাইন ও লেন্থে কেমন বল করতে হবে, তা বেশ ভালোই রপ্ত আছে এ ২০ বছরের যুবার। আরও আছেন দ্রুত গতির বোলার তাসকিন। বাড়তি গতি সঞ্চার ও হঠাৎ হঠাৎ কিছু এক্সপ্রেস ডেলিভারি ছোড়ার ক্ষমতা আছে তার।
অধিনায়ক মাশরাফি দলটির অন্যতম বড় সম্পদ। একজন সত্যিকার নেতা। কথা-বার্তা, আচার আচরণে সহযোগিদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্র। সময়ে বন্ধু। কখনো বড় ভাই। আবার কোন কোন সময় কড়া অভিভাবক। দলকে এক সুতোয় গেঁথে রাখার অসাধারণ ক্ষমতা আছে নড়াইলের এ ৩৩ বছর বয়সী যুবার। সঙ্গে ভালো খেলতে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করতে পারেন। সবার বিশ্বাস, আস্থা ও ভালোবাসার জায়গা ‘মাশরাফি ভাই।’ যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন সত্যিকার অর্থেই ‘টিম বাংলাদেশ। ’
সবাই কম বেশি অবদান রাখছেন। টপ অর্ডারে বড় ইনিংস খেলার মত পারফরমার আছে কয়েকজন। তামিম এখন অনেক পরিণত। নিজের ইচ্ছে ও শট খেলার দূর্নিবার আকাঙ্খা ও প্রবল ইচ্ছেকে দমন করে এখন দলের প্রয়োজনে উইকেট আগলে রাখার কাজটিও খুব ভালো শিখেছেন। প্রথম ওয়ানডের সেঞ্চুরি তারই প্রামাণ্য দলিল।
সৌম্যও আগের চেয়ে পরিণত। শট খেলার পাশাপাশি উইকেটে থাকার কাজটিও শিখেছেন। সাব্বির ‘ড্যাশিং ব্যাটসম্যানের প্রতিমূতি। ক্রিকেট ব্যাকরণের সব শটই আছে এ তরুণের। বুক ভরা সাহস। খালি শট নির্বাচনটা একটু ভালো হলে দলের অন্যতম সেরা সম্পদ বনে যাবেন রাজশাহীর এ তরুণ।
মুশফিক-সাকিব আর মাহমুউল্লাহ খেলে খেলে হাত পাকিয়ে ফেলেছেন। দলের প্রয়োজনে যখন যার ভূমিকা যেমন হওয়া উচিৎ, তারা তা পালন করা শিখেছেন। করে দেখাচ্ছেনও। সঙ্গে মোসাদ্দেক আগের ম্যাচেই দেখিয়েছেন শেষ দিকে কি করে রানের গত বাড়াতে হয়? তার সঙ্গে মাশরাফি, মোস্তাফিজ, তাসকিনের সাজানো পেস আক্রমণ। সাকিব-মিরাজের সাজানো স্পিন ডিপার্টমেন্ট।
ব্যাকআপও বোলারও ভালো; মাহমুদউল্লাহ আর মোসাদ্দেক। প্রয়োজনে তারাও হাত ঘোরাতে পারেন। ব্রেক থ্রু আনার ক্ষমতাও আছে। দরকার ছিল ফিল্ডিং ব্যাকআপ। আর ক্যাচ লুফে নেয়া। সে কাজ দুটিও প্রথম ম্যাচে দারুণ হয়েছে। অনেক দিন পর একটি ম্যাচ, যেখানে বাংলাদেশের ফিল্ডাররা চারচারটি দর্শনীয় ক্যাচ ধরেছেন। যার দুটি আবার দ্বাদশ ব্যক্তি শুভাশিসের। একটা দলের ১২ নম্বর ক্রিকেটার কারো বদলি হিসেবে ফিল্ডিংয়ে নেমে যখন একজোড়া কঠিন ক্যাচ অসামান্য দক্ষতায় ধরে ফেলেন, তখন বুঝতে হবে দলটির টিম স্পিরিট তুঙ্গে। সত্যিই মাশরাফি বাহিনীর টিম স্পিরিট তুঙ্গে। তাইতো এটাই সময়ের সেরা দল। আদর্শ একাদশ।
এমন একদল উপল থারাঙ্গারা অনভিজ্ঞ ও অপরিপক্ক বাহিনীকে হারাবে সেটাইতো স্বাভাবিক। এখন আত্মতুষ্টি চলে না আসলেই হয়। ‘আমরা লঙ্কানদের এ দলটির চেয়ে সবদিক থেকে ভালো। এ বোধ উপলব্ধি আর আত্মবিশ্বাস থাকুক, ক্ষতি নেই। কথা একটাই, মাঠে সামর্থ্যে প্রয়োগটা যেন ঘটে। এ দলটি যা পারে, মাঠে তার স্ফুরণ ঘটলে আর সমস্যা হবার কথা নয়।
আগামীকাল (মঙ্গলবার) ২৮ মার্চ এই রনগিরিতে যদি ৭২ ঘন্টা আগের বাংলাদেশকে দেখা যায়, তাহলে হয়তো জয়রথ থাকবে সচল। সিরিজ হয়ে যাবে নিশ্চিত। সিরিজ বিজয়ের তুলে রাখা উৎসবটা ডাম্বুলাতেই হয়ে যেতে পারে ; কি বলেন? তাই না?
এআরবি/এমআর/এমএস