বদলে যাওয়া বাংলাদেশের তিন রূপকার
কলম্বোর পি সারা ওভালে যেন উঠেছে বাংলাদেশের নতুন সূর্য। যে সূর্য রাঙিয়ে দিয়েছে এখন পুরো ক্রিকেট বিশ্বকেই। নিজেদের শততম টেস্টে এর আগে শুধু অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান আর ওয়েস্ট ইন্ডিজই জয় পেয়েছিল। সেই তালিকায় চতুর্থ দল হিসেবে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশও।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের বীজ যারা বপন করেছিলেন, যাদের হাত ধরে টেস্ট ক্রিকেটে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তাদের মধ্যে রয়েছেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক। বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টেই তার ব্যাট থেকে এসেছিল অনবদ্য সেঞ্চুরি। শততম টেস্টে অবিস্মরণীয় জয়ে গর্বিত সেই বুলবুল।
আইসিসির এশিয়ান অঞ্চলের গেম ডেভেলপমেন্ট কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আমিনুল ইসলাম বুলবুল বাংলাদেশের শততম টেস্টে জয় নিয়ে কলাম লিখেছেন আইসিসির অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে। মুশফিক-সাকিব এবং তামিম-বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের পেছনে তিন রূপকার- শিরোনামে লেখা কলামটি ঈষৎ সংক্ষেপিত আকারে তুলে ধরা হলো জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য...।
মিশন শ্রীলঙ্কা এখনও শেষ হয়নি। সফরকারী দল (বাংলাদেশ) এখনও ওয়ানডে সিরিজ জিততে পারে। তাহলে ২০১৯ আইসিসি বিশ্বকাপে সরাসরি খেলার পথে অনেক দূর এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের অবিস্মরণীয়, ঐতিহাসিক শততম টেস্টে বিজয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দেয়া উচিত দলের তিন প্রাণ ভোমরা সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহীম এবং তামিম ইকবাল। মুশফিকুর রহীম ছিলেন ফিনিশিং টাচে। যদিও তুলির শেষ আচড়টা দিয়েছিলেন তরুণ ক্রিকেটার মেহেদী হাসান মিরাজ। অপর প্রান্তে ছিলেন মুশফিকুর রহীম। সাকিব আল হাসান প্রথম ইনিংসে করেছিলেন অসাধারণ এক সেঞ্চুরি। যার কারণে প্রথম ইনিংসেই ১২৯ রানের লিড পেয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। আর তামিম ইকবালের অসাধারণ ব্যাটিং, যিনি সাব্বির রহমানকে নিয়ে গড়েছিলেন ১০৯ রানের অসাধারণ এক ইনিংস। নিজে ৮২ রান করে দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের জয় এনে দিয়েছিলেন।
এ তিন ক্রিকেটার তাদের ক্রিকেট জার্নি একসঙ্গে শুরু করেছিলেন আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপের মধ্য দিয়ে, ২০০৬ সালে এই শ্রীলঙ্কাতেই। এরপর থেকেই এই তিনজনই ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের তিন রূপকারে পরিণত হন। যদিও এই পরিভ্রমণ খুব সহজ ছিল না। কারণ বছরের পর বছর বাংলাদেশের জয়ের তুলনায় পরাজয়ের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং দিন দিন উন্নতি করে বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজন ছিল সিংহ হৃদয়ের। কারণ ক্রমাগত পরাজয় এবং হতাশা খুব সহজেই যে কারও স্বপ্ন এবং আবেগকে নষ্ট করে দিতে পারে।
আমি নিশ্চিত, আমার মতো বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকদের মনে আছে, ২০১২ এশিয়া কাপের ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে মাত্র ২ রানের ব্যবধানে পরাজয়ের পর কীভাবে মুশফিক কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। কীভাবে তার চোখের অশ্রুতে ভেসে গিয়েছিল সারা দেশের ক্রিকেটপ্রেমীর হৃদয়। ওই অশ্রুগুলো ছিল বড় ইভেন্টে কারও কারও সাফল্য তুলে নিয়ে আসতে না পারার করুণ অনুভূতি।
এ পর্যায়ে আমি নিজেও খুব গর্বিত এবং খুশি যে মানুষ আবার বাংলাদেশের ক্রিকেটের সঙ্গে থেকেছেন। সাহস ও উৎসাহ জুগিয়ে গেছেন। তবে সবচেয়ে বেশি থেকেছেন যেন মুশফিকই।
‘রোল মডেল’- শব্দটা দেখেছি খুব বেশি ব্যবহৃত হতে। অনেক সময় খেলাধুলায় এর অপব্যবহারও হয়। তবে আপনি যদি আধুনিক সময়ে বাংলাদেশের কোনো রোল মডেল খুঁজে বের করতে চান, কাউকে রোল মডেল বানাতে চান, তাহলে অবশ্যই আপনি চোখ বন্ধ করে তামিম, সাকিব এবং মুশফিককে রোল মডেল হিসেবে বাছাই করে নিতে পারেন।
এই তিন ক্রিকেটার মিলে খেলেছে ১৫০টার মতো টেস্ট। এর মধ্যে মুশফিক একাই খেলেছেন ৫৪টি। যার ৩০টিতেই দলকে নেতৃত্ব দিয়েছে সে। সুতরাং চোখ বন্ধ করেই বলে দেয় যায়, বাংলাদেশের টেস্ট পরিভ্রমণের দ্বিতীয়ভাগের (দ্বিতীয় জেনারেশন) মেরুদণ্ড হলেন এই তিনজন। এখন একবার ভাবুন তো! এই তিন চ্যাম্পিয়ন কয়টি টেস্ট জিতিয়েছে বাংলাদেশকে? সাতটি। দ্বিতীয় প্রজন্মে এরা বাংলাদেশকে সাতটি টেস্ট জেতাল (মোট ৯টির মধ্যে)। এই সংখ্যাটা সহজেই দুই সংখ্যায় চলে যেতে পারত, যদি আরও অভিজ্ঞ হতো দল, বিশেষ করে দ্বিতীয় ইনিংসে।
কেউ যদি খুব গভীরভাবে বাংলাদেশের সাম্প্রতিট টেস্ট পারফরম্যান্স পর্যবেক্ষণ করে দেখেন, তাহলে কলম্বো টেস্টে বাংলাদেশের জয়ের পর অবাক হবেন না। মাত্র কিছুদিন আগেই তো মিরপুরে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ। আগের ম্যাচে তারা হেরেছে মাত্র ২২ রানে। নিউজিল্যান্ডে ২ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে দারুণ খেলেছে তারা। যদিও দুটিতেই হেরেছে। তবে হেরেছে লড়াই করেই।
একইভাবে ভারতের বিপক্ষে এক ম্যাচের টেস্ট সিরিজেও দারুণ খেলেছে টাইগাররা। এরপর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এই সিরিজের প্রথম টেস্টে, গলেও দারুণ খেলেছে বাংলাদেশ। টেস্টের নিষ্পত্তি হয়েছে পঞ্চম দিনের শেষ মুহূর্তে গিয়ে। নিউজিল্যান্ড বলুন, ভারত বলুন কিংবা শ্রীলঙ্কা- তিন দেশেই তিনটি ভিন্ন ভিন্ন কন্ডিশনে খেলেছে বাংলাদেশ। সুতরাং নিজেদের মানিয়ে নেয়া, সম্ভাব্যতা তৈরি করা কিংবা নিজেদের প্রভাব তৈরি করার বিষয়ও থাকে এখানে, যা এখন সত্যি দারুণ ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, তরুণ প্রজন্ম এখন সাকিব-তামিম-মুশফিককে ঘিরে বুঝে ফেলেছে জয়ের স্বাদ কেমন। একটি টেস্ট বিজয়ের পর এর ধারণা, স্বাদ কেমন- সে বিষয়গুলো। ইংল্যান্ড এবং শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয়- দুটিই খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং দুটিই শক্তিশালী ও অভিজ্ঞ দুটি দলের বিপক্ষে এসেছে। এই দুটি জয়ের পর ছেলেদের এটা বুঝতে শিখিয়েছে যে, এবার আমরাও জিততে পারি। এই জয়ের স্বাদ আমরাও পেতে পারি।
ক্রিকেট এমন একটি খেলা যেটা প্রত্যয় এবং দারুণ আত্মবিশ্বাসের সমন্বয়। একই সঙ্গে নিজের অবস্থান নিয়ে কখনওই ভীত-সন্ত্রস্ত না থাকা। যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে, ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে অ্যাডিলেডে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের অসাধারণ জয়। যে জয়ের পর বাংলাদেশ দল নিয়ে আমাকে আরও বেশি আশাবাদী করে তোলে এবং চোখের সামনেই যেন দেখতে পাচ্ছিলাম তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।
অ্যাডিলেডের সেই সাফল্য এখন টেস্টেও অনুদিত হয়ে গেছে। টি-টোয়েন্টির প্রভাব শুরু হওয়ার পর থেকে টেস্ট খেলা হচ্ছে অনেকটা ওয়ানডে স্টাইলে। যেখানে রান রেট এখন প্রায় ৩.৫ -এর ওপরও উঠে যাচ্ছে। এটা এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। বাংলাদেশও একই অবস্থায় পৌঁছে গেছে। কারণ ওয়ানডেতেই সবচেয়ে ভালো খেলে টাইগাররা, যা টেস্টেও টেনে নিয়ে যেতে পেরেছে তারা।
আমরা প্রায়ই বলি ড্রেসিং রুমের শান্ত পরিবেশ এবং শক্তিশালী রিজার্ভ বেঞ্চের ব্যাপারে। বাংলাদেশ দলে এখন এটা রয়েছে। এজন্য অবশ্যই সব কৃতিত্ব কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের প্রাপ্য। তিনি ড্রেসিংরুমে দলের মধ্যে একতা এবং দারুণ সমন্বয় তৈরি করতে পেরেছেন। কেউ দল থেকে বাদ পড়ার ভয় থাকলেও সেটাকে আমলে না নিয়ে দলীয় দিকটাকেই বিবেচনা করছে। একই সঙ্গে দল নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যে নিয়মিত পরিবর্তন কিংবা পরীক্ষা-নীরিক্ষা এতে করে প্রমাণ হয়েছে প্রতিটি ম্যাচেই রিজার্ভ বেঞ্চ থাকছে অনেক শক্তিশালী।
বাংলাদেশ প্রায় সাড়ে ষোল কোটি মানুষের দেশ। প্রায় সবাইকেই শোনা যায় ক্রিকেট নিয়ে কথা বলতে। একটি দল সাফল্যের চূড়ায় যেতে হলে সরকার, সমর্থক, পৃষ্ঠপোষক এবং মিডিয়ার পক্ষ থেকেও সব সময় সহযোগিতা প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল সব সময়ই এটা পেয়ে আসছে এবং আমি নিশ্চিত এ কারণেই বাংলাদেশের সামনে আরও অনেক বেশি সাফল্য অপেক্ষা করছে।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এখন অনেক ভিন্ন একটি দল। কারণ উপমহাদেশের ভারত কিংবা পাকিস্তানের চেয়েও বাংলাদেশের স্টাইল ভিন্ন। ভারতের সব সময়ই ভালো কিছু স্পিনার থাকে। মাঝে মধ্যে দু-একজন ভালো পেসার পেয়ে থাকে। আর পাকিস্তানের সব সময়ই ভালো পেসার থাকে। মাঝে মধ্যে থাকে দু-একজন স্পিনার। কিন্তু বাংলাদেশের রয়েছেন দুই দিকেই সেরা বোলারদের সমন্বয়। ভালো পেসার এবং ভালোমানের স্পিনার। একই সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরাও প্রচলিত নিয়মের বাইরে ব্যাটিং করে মাঝে মধ্যে, যা দলের জন্যও বেশ উপকারী হচ্ছে।
পি সারা ওভালের এই জয় অবশ্যই ঐতিহাসিক এবং গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়ে ইতোমধ্যেই অনেকেই অনেক লেখা লিখে ফেলছেন। অনেকেই অনেক কথাও বলেছেন। যেগুলো আমি পড়ছি এবং শুনছিও বটে। তবে আমি খুব বিনয়ের সঙ্গে সবাইকে বলতে চাই, এখনও শ্রীলঙ্কা মিশন শেষ হয়ে যায়নি।
বাংলাদেশ দল এখন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ খেলবে। এই সিরিজে জিততে পারলে বাংলাদেশ ২০১৯ বিশ্বকাপে সরাসরি খেলার ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই ২০১৭ আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করে তাদের ভক্ত-সমর্থকদের গৌরাবান্বিত করে তুলেছে। যে সুযোগটা এলো প্রায় ১১ বছর পর। যদি স্বাগতিক শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজটা জিততে পারে, তাহলে ২০১৯ বিশ্বকাপে সরাসরি খেলার পথে অনেক দূর এগিয়ে যাবে টিম বাংলাদেশ।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডেতেও বাংলাদেশের রেকর্ড খারাপ নয়। কলম্বো টেস্টে জয়ের ধারাবাহিকতা তারা ওয়ানডেতেও নিয়ে যেতে পারবে আমার বিশ্বাস। কারণ, দলের মূল ক্রিকেটাররা রয়েছেন দারুণ ছন্দে। শ্রীলঙ্কাতেই বিশ্বকাপ নিশ্চিত করার দারুণ সুযোগ বাংলাদেশের। একই সঙ্গে আগামী দুই বছরের পরিকল্পনা সাজিয়ে তোলারও সুবর্ণ সুযোগ বাংলাদেশের সামনে, যা তাদের নিয়ে যাবে লর্ডস পর্যন্ত।
আইএইচএস/আরআইপি