অবিস্মরণীয় জয়ের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ
একবার ভাবুন তো, বাংলাদেশ শততম টেস্টে শ্রীলঙ্কার মতো প্রতিষ্ঠিত শক্তিকে হারিয়েছে এবং খেলা হয়েছে রাজধানী ঢাকার মিরপুরের শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে। কী অবস্থা দাঁড়াতো তখন? বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের ফোয়ারা বইতো নিশ্চিত।
কল্পনা করুন- চোখের সামনে ভেসে উঠবে ২৫ হাজার ক্রিকেট অনুরাগীর উল্লাস। বিশাল লাল-সবুজ পতাকা উড়ছে গ্যালারি ও গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডে। চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়, শততম টেস্ট জয়টা শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে হলে কি হতো!
লাল-সবুজে একাকার হয়ে যেত গোটা হোম অব ক্রিকেট। ২৫ হাজার বাঙালির ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ ধ্বনিতে কেঁপে উঠতো মিরপুরের আকাশ-বাতাস। শুধু শেরেবাংলার কথা বলা কেন, বন্দর নগরী চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী, ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলি কিংবা খুলনার শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামের যে কোন মাঠে আজকের এ ঐতিহাসিক জয়ের দেখা মিললেও উৎসব-আনন্দের কিছু কমতি হতো না।
স্বাধীনতার মাসে ১০০ নম্বর টেস্টে জয়ের উল্লাসে মাতোয়ারা হয়ে উঠতো পুরো দেশ; কিন্তু কঠিন সত্য হলো, খেলাটা বহু দূরে। ভারত মহাসাগরের পাড়ে, কলম্বোর পি সারা ওভালে। যেখানে ২৫ হাজার বাঙালির গগনবিদারী চিৎকার, মুহুর্মুহু করতালি আর বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জয়োধ্বনি- মুশফিক-তামিম-সাকিবদের নামে স্লোগান যেন সোনার হরিণ।
পুরো কলম্বোয় প্রবাসী বাঙালির সংখ্যা নেহায়েত কম। হাতেগোনা অল্প ক’জন। সমর্থক বলতে প্রায় নিজ গরজ ও খরচে আসা ক্রিকেটপাগল টাইগার শোয়েব ও টাইগার মিলন। সাথে ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের দুই অন্তঃপ্রাণ সংগঠক ও বেঙ্গল টাইগার্সের ব্যানারে আসা দুই ক্রিকেট ভক্ত গোলাম ফারুক ফটিক ও রুবেল।
আর বাংলাদেশ হাইকমিশনের কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারী। গণনা করলে কুড়ি-পঁচিশজনের বেশি হবে না। অথচ সেই অল্প কজনই মাতিয়ে রেখেছিলেন পুরো পি সারা স্টেডিয়াম। প্রিয় জাতীয় পতাকা হাতে টাইগার শোয়েবের ‘সাবাশ বাংলাদেশ, এগিয়ে যাও বাংলাদেশ’- ঝাঁঝালো আর উদ্দীপক স্লোগানে কাঁপছিল পি সারার মাঠ ও আকাশ-বাতাস।
টাইগার মিলনের কিছুক্ষণ পরপর বাঘের ‘হালুম হালুম’ শব্দ শোনা যাচ্ছিল মাঠের চারদিক থেকেই। এরই মধ্যে শুরু হলো ঐতিহাসিক জয়ের পথে যাত্রা। শুরুতে খানিক ইতস্তত পা ফেলা। অল্প সময় ও সংগ্রহে দুই টপ অর্ডার সৌম্য সরকার ও ইমরুল কায়েসের ফিরে আসা।
তারপর তামিম ইকবালের হাল ধরা। সঙ্গে তরুণ সাব্বির। এই জুটিতে ভর করে এগিয়ে চললো বাংলাদেশ। লাঞ্চের পর তামিম ও সাব্বিরের ব্যাট যেন আস্থার প্রতীক হয়ে উঠল। মনে হলো তারাই পারবে।
তামিম-সাব্বিরের চওড়া ব্যাটে এগিয়ে চলার সময় বদলে গেল শোয়েব, মিলন, ফটিক-রুবেলসহ অল্প ক’জন বাঙালির স্লোগান। সবাই এক সাথে গাইতে শুরু করলেন, ‘আমরা করবো জয়, আমরা করবো জয়, আমরা করবো জয় একদিন। আহা মনের গভীরে, আছে প্রত্যয়, আমরা করবো জয় একদিন।’
কিন্তু আশির ঘরে গিয়ে হঠাৎ অধৈর্য হয়ে ছক্কা হাঁকানোর খায়েস হলো তামিমের। তাতেই সম্ভাব্য শতক হলো হাতছাড়া। কিছুক্ষণ পর ফিরে গেলেন সাব্বিরও (৪১)। ১৩১ রানে তামিম আর ১৪৩ রানে সাব্বির আউট হওয়ার পর মনে হলো মুশফিক-সাকিবই ম্যাচ শেষ করে দেবেন। বাকি অল্প কিছু রান তারাই করে ফেলবেন; কিন্তু সাকিব আউট হওয়ার পর একটু সংশয়-সন্দেহ।
এরপর জয় থেকে মাত্র ২ রান দূরে থাকতে হেরাথের বলে ফিরে গেলেন মোসাদ্দেকও। হাতে তখনো ৪ উইকেট। খেলা বাকি ১৬.১ ওভার। কাজেই বাড়তি চাপের কিছুই ছিল না। উইকেটে আসলেন মেহেদী হাসান মিরাজ। অপর প্রান্তে অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম।
লঙ্কান অধিনায়কের করা দুই বল ডিফেন্স করে তিন নম্বর ডেলিভারিকে হাঁটু মুড়ে সুইপ খেললেন মিরাজ। শর্ট ফাইন লেগে ফিল্ডার কুড়িয়ে বল ফেরত পাঠানোর আগে দুই রান। এরই সঙ্গে মুশফিক, তামিম ও সাকিবের বাংলাদেশও পৌঁছে গেল জয়ের বন্দরে। শততম টেস্টে মিললো বহুল কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের দেখা।
অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর পাকিস্তানের পর চতুর্থ দল হিসেবে ১০০ নম্বর টেস্ট জিতলো বাংলাদেশ। মিরাজের সুইপ ব্যাকওয়াড স্কোয়ার লেগ ফিল্ডারকে ফাঁকি দেয়া মাত্র মুশফিক আর মিরাজ মেতে উঠলেন উল্লাসে। এক হাতে ব্যাট আর অন্য হাত উঁচিয়ে সে কি বাঁধভাঙা উল্লাস দুজনার।
মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে ‘আর্তচিৎকারে ফেটে উঠলো- ‘ইয়ায়ায়া হু...। আমরা পারি। শততম টেস্ট জিতবো পণ করেছিলাম সে পণ রক্ষা হলো।’
তারপর পিচের মাঝখানে রাজ্যজয়ের আনন্দে উদ্বেলিত অধিনায়ক মুশফিক জড়িয়ে ধরলেন মিরাজকে। ততক্ষণে সৌম্য, মোসদ্দেক আর শুভাশিস আনন্দে দৌড়ে মাঠের ভিতরে। একে একে সাকিব, সাব্বির, মোস্তাফিজ, তাইজুলরাও যোগ দিলেন সে আনন্দের মিছিলে।
গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডে প্রেসিডেন্ট বক্সে বসা জাতীয় দলের দুই সাবেক অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু আর আকরাম খান আগেই নেমে এসে বাংলাদেশ ড্রেসিং রুমের সামনেই অবস্থান নিয়ে ছিলেন। বাংলাদেশের ড্রেসিং রুমের সামনের জায়গাটা রূপ নিল শেরেবাংলার গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডের সামনের এলাকায়।
ক্রিকেটার। কর্মকর্তা, সমর্থক আর সাংবাদিক সবাই মিলে মিশে একাকার। একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে মেতে উঠছেন। সবার চোখে মুখে রাজ্য জয়ের আনন্দ। পেশাদারিত্বের বাইরেও দেশপ্রেম বুঝি একেই বলে।
স্মরণীয় জয়ের পর সবার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নেয়ার পাশাপাশি এ সিরিজ কভার করতে আসা সাংবাদিকরাও ট্রফি হাতে ছবি তোলার প্রতিযোগিতাও চললো খানিক্ষণ। সংখ্যায় হাতেগোনা সমর্থক। তাতে কি! কলম্বোর পি সারা হয়ে উঠলো টাইগারদের বিজয় গাথা ভেন্যু।
এরই মধ্যে হঠাৎ ভেসে এলো কোরাশ, ‘আমরা করবো জয়, আমরা করবো জয়, আমরা করবো জয় একদিন। আহা বুকের গভীরে আছে প্রত্যয়, আমরা করবো জয় একদিন।’
সবার কান ও চোখ একদিকে স্থির হয়ে রইলো বাংলাদেশ ড্রেসিং রুমের দিকে। শততম টেস্টে অবিস্মরণীয় জয়ের পর অমন কোরাশ গাইলেন মুশফিক, তামিম, সাকিক, মোস্তাফিজ, মিরাজ, সাব্বির ও মোসাদ্দেকরাও।
এখন আর একদিন নয়, সত্যি টাইগাররা করলো জয়। হারলো রঙ্গনা হেরাথের লঙ্কা বাহিনী। সোনালী সাফল্যে মোড়া থাকল শততম টেস্ট।
এআরবি/আইএইচএস/পিআর