অবিস্মরণীয় জয়ের স্বপ্ন দেখতেই পারে বাংলাদেশ
‘ইস! আম্পায়ারিংটা যদি ভাল হতো, কিংবা কিছু সিদ্ধান্ত পক্ষে আসতো- তাহলে হয়ত আজকেই জয়ের পথে অনেকদুর এগিয়ে যেতে পারতো বাংলাদেশ।’
কলম্বোর পি সারা ওভালে চতুর্থ দিন শেষে বাংলাদেশ ভক্ত ও সমর্থকদের মুখে এমন কথা শোনা যাচ্ছে। ক্রিকেট খেলাটাই এমন। গৌরবময় অনিশ্চয়তার। সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র খেলা, যেখানে অনেক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্যেও ঘুরে ফিরে ‘যদি’ ‘তবে’ চলে আসে।
কি হলে কি হতো- তা নিয়ে দিন বা খেলা শেষে সবচেয়ে বেশি কথা হয়। আজ যেমন বাংলাদেশের বোলারদের ঘুরে দাড়ানোর গল্প ছাপিয়ে দিন শেষে যত কথা আম্পায়ারিং আর রিভিউ নিয়ে। অথচ শনিবার পি সারায় মোস্তাফিজ-সাকিব কী দারুণ বোলিংটাই না করেছেন।
ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখুন, আজ লাঞ্চের পর যেভাবে টাইগাররা বল হাতে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, গত পাঁচ মাসে চার টেস্টে এমন কামব্যাক করার একটি নজিরও নেই। ঠিক এ রকম অবস্থায় যতই সময় গড়িয়েছে, ততই বোলিংয়ের ধার কমেছে। ফিল্ডাররাও খেই হারিয়ে ফেলেছেন; কিন্তু আজ ছিল ব্যতিক্রম।
ব্যতিক্রম তো হবেই। টাইগাররা যে শততম টেস্টকে সোনালী সাফল্যে মুড়িয়ে রাখতে মুখিয়ে! তাই তো প্রাণপন চেষ্টা, দেখি না লঙ্কানদের হাত থেকে খেলা ঘোরাতে পারি কি না?
লাঞ্চের সময় লঙ্কানদের স্কোর ১ উইকেটে ১৩১। বাংলাদেশের চেয়ে ২ রানে এগিয়ে। হাতে নয় উইকেট। যারা এরই মধ্যে লম্বা সময় উইকেটে থাকার এবং বড়-সড় ইনিংস খেলার সামর্থ্যরে প্রমাণ দিয়েছেন, সেই কুশল মেন্ডিস আর চান্দিমালদের কেউ আউট হননি।
ইস! কি যে হবে? সমর্থকদের মনে চিন্তার কালো মেঘ। ঠিক সে রকম অবস্থায় দারুণভাবে খেলায় ফিরে আসলো মুশফিকের দল।
গত বছর অক্টোবরে ঢাকার শেরে বাংল স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জেতার পর আজই সম্ভবত সেরা বোলিং করেছেন টাইগার বোলাররা। ওই ম্যাচে ইংলিশদের প্রথম ইনিংসে ২৪৪ রানে অলআউট করার পর দ্বিতীয় ইনিংসে১৬৪‘তে বেঁধে ফেলে ১০৮ রানের ঐতিহাসিক জয়ের দেখা মিলেছিল বাংলাদেশের।
পি সারা ওভালে শততম টেস্টে প্রথম ইনিংসে ১২৯ রানে এগিয়ে যাবার পর হেরাথের দল যখন উল্টো বাংলাদেশকে চাপে ফেলার পথ খুঁজে পেয়েছিল, ঠিক তখন আঘাত মোস্তাফিজের। সারা দিন আম্পায়ারদের সিদ্ধান্ত পক্ষে যায়নি তেমন। আক্ষেপ-হতাশা আছে রিভিউ নিয়েও। তারপরও কঠিন সত্য হলো বাংলাদেশের ভাগ্য খুলেছে সেই রিভিউতেই।
মোস্তাফিজের বলে কুশল মেন্ডিসের ব্যাটে ছুঁয়েছে কী ছোঁয়নি। অধিনায়ক মুশফিক বল গ্লাভসে নিয়েই আবেদন করলেন। আম্পায়ার কট বিহাইন্ড দিলেন না। তাৎক্ষনিক রিভিউ চেয়েই মিললো ফল। কট বিহাইন্ড।
সেই শুরু। করুনারত্নে একদিক আগলে রাখলেও বাঁ-হাতি পেসার মোস্তাফিজ আর সাকিবের স্পিন ঘূর্ণিতে লঙ্কানরা ব্যাকফুটে চলে গেল অল্প সময়ের মধ্যেই। মোস্তাফিজের বলে ডান দিকে মাটিতে শরীর ফেলে চান্দিমালের অসাধারন ক্যাচ ধরে লঙ্কানদের হতোদ্যম করলেন অধিনায়ক মুশফিক।
তারও পরে কিপার ডিকভেলার ক্যাচটি দলকে চাঙ্গা ও উজ্জীবিত করার টনিক হয়ে গেল। সাকিবের বলে রিভার্স সুইপ করতে গেলেন ডিকভেলা। বল বেরিয়ে যাচ্ছিলো; কিন্তু উইকেটের ওপর হুমুড়ি খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মুশফিক অসামান্য দক্ষতা ও চপলতায় তা ধরে ফেললেন।
এরপর সেঞ্চুরিয়ান করুনারত্নেকে অফস্ট্যাম্পের বাইরে টার্নে পরাস্ত করে স্লিপে ক্যাচ দিতে বাধ্য করা সাকিব মেতে উঠলেন উৎসব আনন্দে। সাধারনতঃ তেমন আনন্দ উল্লাস প্রকাশ না করলেও করুনারত্নেকে ফিরিয়ে সাকিব দু’হাত শূন্যে ছুড়ে, শূন্যে ঘুষি মেরে বুঝিয়ে দিলেন, ‘আরে চলে যাও সাজঘরে!’
ওপরের সবগুলোই উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত হবার দাওয়াই। তাই তো দিন শেষে আম্পায়ারিং নিয়ে হতাশা ও আক্ষেপ যাই থাকুক না কেন, টিম বাংলাদেশ চাঙ্গা। মাঠ ছেড়ে সন্ধ্যায় যখন টিম বাসে ওঠার পথে সাজঘর থেকে একেকজন যখন বেরিয়ে আসছিলেন, তখন সবার চোখ-মুখে একটা অন্যরকম আভা, আলোর ঝিলিক।
এ আভা যেন ভোরের সূর্য্য উদয়ের আগের ‘রঙিন আলো’। যা পুব আকাশকে করে দেয় আলোকিত। সবার শরীরি ভাষা বলে দিচ্ছিল, তারা জয়ের কথাই ভাবছেন। না ভাবার কোনই কারণ নেই।
খেলাটা এখনো টাইগারদের হাতে। হেরাথের দল এগিয়ে ১৩৯ রানে। তাদের হাতে আছে দুই উইকেট। দুই বোলার লাকমাল আর পেরেরা ক্রিজে। এরপর আছেন শুধু ল²ন সান্দাকান।
বাংলাদেশ শিবিরের আশা, আগামীকাল রোববার সকাল সকাল লঙ্কান ইনিংসের লেজ মুড়িয়ে দেয়া যাবে। চতুর্থ দিনের খেলা শেষে অভিষেক হওয়া মোসাদ্দেক জানিয়ে গেলেন, তাদের লক্ষ্য লঙ্কান ইনিংসকে দেড়শোর আশপাশে বেধে ফেলা। কোনভাবেই যাতে ১৬০ রানের বেশি টার্গেট না হয়।
যদি শেষ পর্যন্ত তাই হয়, লক্ষ্যটা যদি দেড়শোর আশপাশে থাকে তাহলে মুশফিকের দল জয়ের আশা করতেই পারে। ইতিহাস জানাচ্ছে, দু‘শোর বেশি (২০০৯ সালে গ্রানাডায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ২১৫) রান তাড়া করার রেকর্ডও আছে টাইগারদের।
চতুর্থ দিন শেষে উইকেটের যা অবস্থা, তাতে লক্ষ্যটা দেড়শো ছাড়িয়ে গেলেও ভড়কে যাবার কিছু নেই। আজও উইকেট মোটামুটি স্বাভাবিকই ছিল। সাধারনতঃ চার দিনের পিচে কিছু না কিছু ফাটল সৃষ্টি হয়। পি সারায় তা হয়নি। বল বিপজ্জনকভাবে লফিয়ে ওঠেনি। নিচুও হয়নি। টার্ন হয়েছে অল্প-বিস্তর।
আজ শেষ দিন পিচের চরিত্র অতিনাটকীয় পরিবর্তন না হলে বাংলাদেশের চিন্তার কারণ সামান্যই। এখন দেখার বিষয়, লঙ্কান ইনিংস কাল শেষ দিন কতক্ষণ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। সকালে শুরুর পরপর থামিয়ে দিতে পারলে তো কথাই নেই। প্রথম আধঘণ্টার মধ্যে শেষ করতে পারলেও চলবে।
তখন হয়ত ওই ১৬০ রানের মতই টার্গেট দাঁড়াবে। সময় মিলবে ৮০ ওভারের মত। ঠান্ডা মাথায় ধৈর্য্য ধরে লক্ষ্যে পৌঁছানোর পর্যাপ্ত সময় ও অবকাশও মিলবে। তখন ওভার পিছু লক্ষ্য দাঁড়াবে ২ করে।
তামিম, সৌম্য, ইমরুল, মুশফিক, সাকিব, সাব্বির, মোসাদ্দেকরাও দেখে-বুঝে খেলার সময় পাবেন। তার আগে কাল (রোববার) সকাল-সকাল বাকি দুই উইকেটের পতন ঘটাতে হবে। কাল সকালে আর ২০-২৫ রানের মধ্যে লঙ্কান ইনিংসের শেষ দুই উইকেটের পতন ঘটাত পারলেই হয়ত শততম টেস্টে মিলবে স্মরনীয় জয়ের দেখা।
এআরবি/আইএইচএস