মুরালিধরনের ৮০০ এবং সুনামির নীরব সাক্ষী নয়নাভিরাম গল
যত পাষাণ আর কঠিন হৃদয়ের মানুষই হোক না কেন, গল ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামের আশপাশে আসা মাত্র মন অন্যরকম মানে ভালো হয়ে যাবে। চরম বেরসিক মানুষও হয়তো ভাবাবেগতাড়িত হবেন। চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে।
আবেগ উচ্ছ্বাসে নিশ্চয় বলে উঠবেন, ‘ওহ ... কি সুন্দর জায়গা। কি চমৎকার নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ঘেরা স্টেডিয়াম!’ সত্যিই তা-ই!
আনুষঙ্গিক পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ধরে গল ইন্টারনাশনাল স্টেডিয়াম বিশ্বের সুন্দরতম স্টেডিয়াম। সৌন্দর্যে ঘেরা এক অপরূপ টেস্ট ভেন্যু! যার সৌন্দর্য চোখ জুড়িয়ে যায়। সত্যিই গল স্টেডিয়াম যেন অপরূপ সৌন্দর্যের প্রতীক। যার দু’দিকে চলমান সমুদ্র।
মাঠের দক্ষিণ দিকের পুরোটা জুড়ে ভারত মহাসাগর। আর পূর্ব দিকেও তা-ই। ভাবতে পারেন, সমুদ্র ঘেরা ভেন্যু তো আরও আছে। সেগুলো কি তাহলে গলের মতো নয়? নাহ, নয়। নয় এই কারণে যে, ভারত মহাসাগররের বিশাল জলরাশি আর কোনো ভেন্যুর এত কাছ দিয়ে প্রবাহিত হয়নি।
গজ-ফুটের হিসেব কষে বের করা কঠিন। চোখের হিসেবে মাঠ থেকে ৫০০ গজ পুরো হবে না। সবচেয়ে বড় কথা দক্ষিণ দিকে গল ফোর্ট শেষ হওয়ার পর মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের বেশ খানিকটা এলাকা খোলা। সেখান দিয়ে সমুদ্র দৃশ্যমান।
নীল জলরাশির বড় বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে তিরে। সমুদ্র গর্জন শোনা যায় মাঠের ভেতর থেকে। নীল জলের ঢেউ তিরে এসে লাগার আগে সাদা ফেনার মতো হয়ে যাচ্ছে। তিরে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য মন কেড়ে নেবে যে কোনো প্রকৃতিপ্রেমির। অজান্তে মন হারিয়ে যাবে ভারত মহাসাগরের বিশাল জলরাশিতে।
তারই খুব কাছে তৈরি ‘গল ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট স্টেডিয়াম।’স্টেডিয়ামের উত্তর দিকে প্রেস বক্সের ঠিক তিন তলায় বসে সেই বিশাল জলরাশি চোখে দেখা যায় অবিরাম। এমন সৌন্দর্যে ঘেরা স্টেডিয়ামের ইতিহাস দীর্ঘ। সেই সঙ্গে করুণ। বেদনার। দুঃখেরও।
এক যুগের অল্প সময় আগের কথা। মনে করে দেখুন, ২০০৪ সালে শ্রীলঙ্কায় কি ভীষণ সুনামিই না ঘটে গিয়েছিল! যাতে প্রচুর প্রাণহানি ঘটেছিল। ভারত মহাসাগরের এত কাছে, সুতরাং এই গলও হয়েছিল সেই সুনামির শিকার। সবচেয়ে দুঃখের কথা- সুনামির সময় এই মাঠে খেলায় ব্যস্ত ছিল বেশ কিছু শিশু-কিশোর। তাদের সলিল সমাধিও ঘটে সমুদ্রর সেই বিশাল ঢেউয়ের অতলে তলিয়ে।
যেহেতু মাঠের পূর্ব ও দক্ষিণে ভারত মহাসাগর, তাই গল স্টেডিয়াম তথা আশপাশের এলাকায় সমুদ্রের ১০/১২ ফুট উঁচু ঢেউ এবং জলরাশি চলে যায় পানির নিচে। কাজেই সুনামিতে শুধু প্রাণহানিই ঘটেনি, গল স্টেডিয়ামও আক্রান্ত হয় দারুণভাবে।
এ মাঠের ওপর দিয়েও বয়ে যায় অনেক বড় ঝক্কি। এক কথায়- মাঠের ‘বারোটা’ বেজে যায় তখন। ওই সুনামির ভয়াবহ আক্রমণ থেকে গল স্টেডিয়ামকে খেলা উপযোগী করে তুলতে দু’বছরেরও বেশি সময় লেগে যায়। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর সুনামির শিকার গল স্টেডিয়ামকে আবার নতুন করে ঢেলে সাজানো হয়।
প্রায় দেড় বছর স্টেডিয়ামে হাতই দেয়া হয়নি। ১৭ মাস পর ২০০৬ সালের ৮ মে স্টেডিয়ামকে আবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট উপযোগী করে তোলার কাজ শুরু হয়। সুনামিতে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি কাটিয়ে নানা স্থাপনা পুননির্মাণ ও সংস্কার কাজ শেষে আবার স্টেডিয়াম নতুন সাজে সজ্জিত হয় ২০০৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর।
সংস্কার ও পুননির্মাণ কাজ শেষে সুনামিতে আক্রান্ত গল স্টেডিয়ামের নতুন যাত্রাও শুরু হয় ওই দিন; শ্রীলঙ্কা আর ইংল্যান্ডের টেস্ট ম্যাচ দিয়ে। সাবেক লঙ্কান প্রেসিডেন্ট মহিন্দর রাজাপাকশে যার উদ্বোধন করেন। তারপর গল আবার চিরচেনা রূপে।
দক্ষিণ দিকে বিশাল গল ফোর্ট। যারও রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। সোয়া চারশো বছরের বেশি সময় আগে ১৫৮৮ সালে পর্তুগিজরা এ ফোর্ট নির্মাণ করে। ৪২৩ বছরের বেশি সময় ধরে এ ফোর্ট শ্রীলঙ্কার অন্যতম স্থাপত্য সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে সবার দৃষ্টি কাড়ে।
পূর্ব ও দক্ষিণে ভারত মহাসাগরে ঘেরা গল স্টেডিয়ামের পুরো নির্মাণ শৈলিতে উপমহাদেশীয় স্থাপত্য ছোঁয়া খুব কম। মাঠের প্রায় তিন দিক খোলা। সে অর্থে গ্যালারি নেই। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো মাঠের তিন দিকে গ্যালারি, হসপিটালিটি বক্স, ক্লাব হাউজের দেখা মিলবে না। ওসবের বালাই নেই। শুধু উত্তর দিকের প্রায় পুরোটা স্থায়ী কাঠামোর ওপর দাঁড়ানো।
গ্র্যান্ডস্ট্যান্ড, ভিভিআইপি, ড্রেসিং রুম, মিডিয়া সেন্টার, প্রেস বক্স ও টিভি রেডিও ধারাভাষ্য কক্ষও মাঠের উত্তরের স্থায়ী চারতলা ভবনের মধ্যে। এছাড়া মাঠের পশ্চিমের একাংশে অল্প জায়গার ওপরে ছাদ। সেখানে চেয়ার বসানো আছে। সাকুল্যে হাজার খানেক দর্শক খেলা দেখতে পারবেন। এর বাইরে তিন দিকেই প্রায় উঁচু মাটির ঢিবির মতো তৈরি।
তবে প্রচণ্ড গরম, আর্দ্রতাও যথেষ্ঠ। খোলা আকাশের নিচে মিনিট দশেক থাকা শক্ত। আর্দ্রতা বেশি বলে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মত এখানে শুয়ে বসে সান বাথ করা আর খেলা দেখার কেউ নেই। অল্প কিছু দর্শক খোলা আকাশের নিচে ওই টিলার মতো জায়গায় বসে-দাঁড়িয়ে খেলা দেখছেন।
এদিকে গল ফোর্টের মতো গল স্টেডিয়ামেরও রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। ১৮৭৬ সালে ঘোড় দৌড়ের জন্য নির্মিত হয় এ মাঠ। আর ক্রিকেট ভেন্যু হিসেবে যাত্রা শুরু প্রায় শতবর্ষ আগে, ১৯২৭ সালে। তারও অনেক পরে ১৯৪৫ সালে এই মাঠে প্রথম পিচ নির্মিত হয়। সেটাও ম্যাটিং উইকেট নয়। ন্যাচারাল টার্ফ। আর শ্রীলঙ্কার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের ভেন্যু হিসেবে এ গল মাঠ অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯৮৪ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি।
তারও ১৪ বছর পর ১৯৯৮ সালের ৩ জুন গল আন্তর্জাতিক ভেন্যুর মর্যাদা পায়। ওই দিন শ্রীলঙ্কার সপ্তম টেস্ট ভেন্যু হিসেবে অভিষেক ঘটে গলের। আর মাত্র ২২ দিন পর ১৯৯৮ সালের ২৫ জুন ভারত ও শ্রীলঙ্কার খেলা দিয়ে গল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়।
এখানেই শেষ নয়। গল স্টেডিয়ামের লম্বা চওড়া কাহিনী আরও বড়। এ মাঠের সঙ্গে জড়িয়ে আছে লঙ্কান ক্রিকেটের সব সময়ের সেরা তথা বিশ্বের সর্বকালের সেরা অফস্পিনার মুত্তিয়া মুরালিধরনের নাম। বলার অপেক্ষা রাখে না, টেস্টে প্রথমবারের মতো ৮০০ উইকেট শিকারি এ লঙ্কান অফস্পিনার।
সবচেয়ে বড় খবর, এই গল স্টেডিয়ামেই টেস্টে ৮০০ উইকেট পূর্ণ হয় মুরালিধরনের। সেটা ছিল ২০১০ সালের ২২ জুলাই। গোটা বিশ্ব উন্মুখ হয়েছিল কালজয়ী ও জীবন্ত কিংবদন্তি মুরালিধরনের ৮০০ উইকেট শিকারের দুর্লভ মুহূর্ত দেখার জন্য। অবশেষে আসে সে মাহেন্দ্রক্ষণ।
ভারতের বাঁহাতি স্পিনার প্রজ্ঞান ওঝাকে আউট করে প্রায় ৭ বছর আগে ওই ঐতিহাসিক সাফল্যের ফলক স্পর্শ করেন মুরালিধরন। আরেক লঙ্কান গ্রেট মাহেলা জয়বর্ধনে প্রথম স্লিপে দাঁড়িয়ে ওঝার ক্যাচটি তালুবন্দি করা মাত্র গল নয়নাভিরাম সৌন্দর্য আর সুনামির ভয়াবহ আক্রমণের শিকার গল স্টেডিয়াম এক অনন্য রেকর্ডেরও সঙ্গী হয়ে যায়।
এআরবি/এনইউ/আইএইচএস