আইপিএলে অটোচালকের ছেলের বাজিমাত
বাবা চালান অটো। অভাবের সংসার। ছোট বেলা থেকেই তাই মোহাম্মদ সিরাজ স্বপ্ন দেখতেন হায়দরাবাদের উপকণ্ঠে বাবা মোহাম্মদ গাউস এবং মা সাবানা বেগমের জন্য একটি বাড়ি তৈরি করবেন। কিন্তু তা কী আর সম্ভব! ছেঁড়া কাথায় শুয়ে চন্দ্র বিজয়ের স্বপ্ন দেখার মতই ব্যাপার যেন; কিন্তু সেই স্বপ্ন যখন বাস্তবেই ধরা দেয়, তাহলে ব্যাপারটা কেমন হয়!
অটো চালকের ছেলে এখন কোটিপতি। শুধুই ক্রিকেটের জন্য। মাল্টি বিলিওনিয়ার ক্রিকেট লিগ আইপিএলের সৌজন্যে। সোমবার ব্যাঙ্গালুরুতে অনুষ্ঠিত আইপিএল নিলামে বাজিমাত করেছেন হায়দরাবাদের ছেলে ২২ বছর বয়সী মোহাম্মদ সিরাজ। মাত্র ২০ লাখ রুপি ছিল তার ভিত্তিমূল্য। সেখান থেকে দরকষাকষি করতে করতে ঘরের ছেলেকে জয় করে নিয়েছে আইপিএলের বর্তমান চ্যাম্পিয়ন সানরাইজার্স হায়দরাবাদ, ২ কোটি ৬০ লাখ রুপিতে।
বাবা অটো চালাতেন। অভাব লেগেই থাকতো সংসারে। সেখানে যদি ছেলে ক্রিকেট খেলতে যায়, তাহলে তো সেটা বিলাষিতাই। এ কারণে মায়ের কাছে কম বকাবকি শুনতে হয়তি সিরাজকে। এমনকি মায়ের কাছে কখনও-সখনও প্রতিজ্ঞাও করতে হয়েছে ক্রিকেট ছাড়বে বলে; কিন্তু যার রক্তে একবার ক্রিকেটের নেশা ঢুকে গেছে, তাকে কী শত প্রতিজ্ঞার পরও ফেরানো যায়? যায়নি সিরাজকেও।
সেই সিরাজই সোমবারের আইপিএল নিলামে বাজিমাত করে বসলেন। সানরাইজার্স হায়দরাবাদ তাকে কেনার পরই ভাইরাল হয়ে গিয়েছে তার কাহিনি। আবার নিজেও একটি গল্প শোনালেন সিরাজ। ৫০০ রুপি থেকে কিভাবে তিনি হয়ে উঠলেন ২.৬ কোটি দামের ক্রিকেটার!
ক্রিকেট দিয়ে প্রথম উপার্জনের গল্প নিজেই বললেন সিরাজ, ‘হায়দরাবাদের একটি ক্লাব ম্যাচে প্রথম খেলতে গিয়েছিলাম আমি। মামা ছিলেন সেই ক্লাবের অধিনায়ক। ২৫ ওভারের ম্যাচে ২০ রান দিয়ে একাই ৯ উইকেট নিয়ে নিলাম। দেখে তো সবাই অবাক। এ কী করে সম্ভব? অধিনায়ক মামা তখন কী আর করবেন, পুরস্কার হিসেবে আমাকে দিলেন ৫০০ রুপি। সেই প্রথম ক্রিকেট দিয়ে আয় করলাম আর সেকি খুশি আমার! কিন্তু আজ যখন আমার মূল্য ২.৬ কোটি রুপিতে গিয়ে দাঁড়াল, সত্যিই আমি জবাবহীন।’
সোমবার রাতে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকাকে সিরাজ বললেন, ‘এত টাকা দিয়ে কোনও দল কিনবে আমাকে, ভাবিনি। আইপিএলে খেলার স্বপ্ন দেখতাম এত দিন। এ মওসুমে ঘরোয়া ক্রিকেটে যা পারফর্ম করেছি তার পর নিলামে কোনও দলে সুযোগ পাব এই আশায় ছিলাম।’
তার পরেই মনে পড়ে যায় সেই কষ্টের অতীত, ‘একটা সময় ছিল যখন ক্রিকেট ম্যাচ খেলে সামান্য কয়েকশো টাকাই পেয়েছি। আজ তাই আমার আইপিএলে দাম কোটি টাকায় উঠে যাওয়াটা বিশ্বাস হচ্ছিল না প্রথমে।’
বাইশ বছর বয়সি ডান হাতি এ পেসার ৪১ উইকেট নিয়ে হায়দরাবাদের হয়ে এবার রঞ্জি ট্রফির তৃতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি। ঘরোয়া ক্রিকেটে যে কারণে বাউন্সার দেওয়ার জন্য নামডাক আছে। ক’দিন আগে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ভারত ‘এ’দলের হয়ে প্রস্তুতি ম্যাচের দলে ছিলেন। পুরনো স্মৃতি মনে করে সিরাজ বলেন, ‘মা খুব বকাবকি করত। বাবা অটো রিক্সা চালায়। খুব কষ্ট করে সংসার চালিয়েছে; কিন্তু সব সময় উৎসাহ দিয়ে গিয়েছে আমাকে। এখন দু জনেই খুব খুশি’- বলেন ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন এ পেসার।
সঙ্গে যোগ করেন আরও সংগ্রামের কাহিনি, ‘একটা সময় গিয়েছে একটা ভালো জুতো ছিল না। আমার ইচ্ছে বাবা-মাকে খুব ভালো ভাবে রাখার। আর যাতে দু জনকে কষ্ট করতে না হয়।’ বলতে গিয়ে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করাই কঠিন হয়ে যায় যেন তার কাছে।
এ বার আইপিএলে লক্ষ্য কী? ‘আইপিএলে বিশ্বসেরা ক্রিকেটারদের সঙ্গে খেলার অভিজ্ঞতা হবে ভাবলেই একটা আলাদা উত্তেজনা হচ্ছে। আমি চাই, এবার দারুণ পারফর্ম করে জুনে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দলে জায়গা করে নিতে। দেশের জার্সিতে নামার চেয়ে বড় স্বপ্ন আর কী হতে পারে! আইপিএল নিলামের সাফল্য সেই পথেই এক পা এগনো বলতে পারেন।’
সিরাজের আদর্শ ক্রিকেটার অস্ট্রেলিয়ার বা হাতি পেসার মিচেল স্টার্ক। দিন কয়েক আগে ভারত ‘এ’ আর অস্ট্রেলিয়ার প্রস্তুতি ম্যাচে তার নায়কের সঙ্গে সামনা-সামনি কথা বলার সুযোগও হয়েছিল। সিরাজের প্রধান অস্ত্র ইনসুইং ও বাউন্সার। ইয়র্কারটাও অস্ত্রশালায় যোগ করতে চান আইপিএলের কথা ভেবে। কীভাবে ইয়র্কার আরও নিখুঁত করতে হবে, জানতে চেয়েছিলেন স্টার্কের কাছে। স্টার্ক উপদেশও দিয়েছেন। এবারের আইপিএলে অবশ্য স্টার্কের সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, স্টার্ক সরেই দাঁড়িয়েছেন টুর্নামেন্ট থেকে।
‘তাতে কী, অদূর ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেখা হয়ে যেতেই পারে আমার নায়কের সঙ্গে,’ বলছেন নিলামে ঝড় তোলা প্রতিশ্রুতিমান এই পেসার। হায়দরাবাদের সিরাজ তো জেনেই গেলেন, সব স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন থাকে না। কখনওসখনও সত্যিও হয়!
আইএইচএস/পিআর