আইপিএলে কুলির ছেলে কোটিপতি
এ যেন আরেকটি ‘স্লামডগ মিলিওনিয়ারে’র গল্প। বস্তির ছেলের জায়গায় শুধু পড়তে হবে কুলির ছেলে। বাকিটা একই। কুলির ছেলে থেকে এখন কোটিপতি। শুধুমাত্র আইপিএলের কল্যাণে। ছিলেন সাধারণ মানের এক পেসার। মূল অস্ত্রই ছিল তার গতি এবং ইয়র্কার। সেই সাধারণ মানের পেসারই এখন হয়ে উঠলেন অসাধারণ। গতি আর ইয়র্কারই তাকে পৌঁছে দিয়েছে অকল্পনীয় এক জায়গায়। সোমবার ব্যাঙ্গালুরুতে আইপিএল নিলাম পৃথিবীটাই পাল্টে দিল তার। কুলির ছেলে থেকে রাতারাতি হয়ে গেলেন কোটিপতি।
থাঙ্গারাসু নটরাজন। ভিত্তিমূল্য ছিল মাত্র ১০ লাখ রুপি। অচেনা এই পেসারকে কে নেবে সেটাই ছিল বড় প্রশ্ন। যদিও নেয়ও, তবুও তাকে কতটুকু দামেই বা নেবে? কে তার জন্য নিলামে লড়াই করবে? এতসব প্রশ্ন নিয়ে নটরাজন বসেছিলেন টিভি সেটের সামনে; কিন্তু কী আশ্চর্য ১০ লক্ষ রুপি থেকে দাম শুরু করে তার জন্য রীতিমত যুদ্ধে নামে ফ্রাঞ্চাইজিগুলো। শেষ পর্যন্ত কিংস ইলেভেন পাঞ্জব যখন তাকে জয় করতে সক্ষম হয়, তখন দাম উঠে গেছে আকাশে। ৩০ গুণ বেশি দাম। ৩ কোটি রুপি। নিঃসন্দেহে দশম আইপিএলের নিলামে সেরা চমক।
২৫ বছর বয়সী তামিল নাড়ুর বাম হাতি এক পেসার। মাত্র ৯টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলা হয়েছে তার। ৩৩.৪৪ গড়ে উইকেট নিয়েছেন ২৭টি। ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি খেলেছেন ৫টি। পারফরম্যান্স খুব বেশি উজ্জ্বল নয়। উইকেট নিয়েছেন মাত্র ৪টি। ইকনোমি রেটও অনেক ছড়া। ৮.২৯ করে। তবুও তাকে নিলাম যুদ্ধে অনেকটা লড়াই করে জিততে হয়েছে কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবকে।
কেন? একটাই কারণ, টানা ছয়টি ইয়র্কার। নামকরা বিখ্যাত কোনো পেসারও কখনও টানা ছয়টি ইয়র্কার দিতে পেরেছিল কি না সন্দেহ। তামিল নাড়ু প্রিমিয়ার লিগে দিন্দিগুল ড্রাগন্সের হয়ে ৭ ম্যাচে নিয়েছেন ১০ উইকেট। এর মধ্যে এক ম্যাচে নিয়েছেন ৪ উইকেট। গড় ১৯.৮০। ইকনোমি রেট ৭.৩৩। তবে সবার নজরে আসেন তিনি টুটি প্যাট্রিয়টসের বিপক্ষে সুপার ওভারে বল করে। এই এক ওভারে টানা ৬টি বল করেছেন তিনি ইয়র্কার। যার ফলে তার দলও অনায়াসে জয় পেয়ে যায়।
শুধু ইয়র্কার আর গতিই নয়, দারুণ অফকাটারও করতে পারেন তিনি। একই সঙ্গে রঞ্জি ট্রফিতে তামিল নাড়ু টিম যখন সেমিফাইনালে উঠেছিল, তখন তিনি হয়ে উঠেছিলেন দলের অপরিহার্য সদস্য।
নিলামের শেষে তাকে যখন ফোন করা হলো, তখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না, ‘আমি এখনও ভাবতেই পারছি না। আমার মাকে বলা মাত্র তো উনি কাঁদতে শুরু করে দিয়েছিলেন। বন্ধুরাও বলল, আজ ভাল কিছু খাওয়াতে হবে।’ এরপর দ্রুত বাস্তবে ফিরলেন নটরাজন, ‘এত দাম দেওয়ায় এখন প্রত্যাশাও অনেক থাকবে। সেই চাপটা আমায় নিতে হবে।’
বাম হাতি মিডিয়াম পেসার তিনি। ইয়র্কার দিতে ওস্তাদ। কিন্তু ক্রিকেটের এই উঠতি তারকা এক সময় ভেবেছিলেন বাবার মতোই তাকেও হয়তো কুলির কাজ করেই জীবন কাটাতে হবে হয়তো। ‘ক্রিকেটই আমাকে নতুন করে পথ দেখালো। আমি খুব গরীব ঘরের ছেলে। বাবা কুলি। মায়ের মুরগির মাংসের দোকান। আইপিএল তো দূরের কথা, রঞ্জি খেলতে পারব সেটাই এক সময় ভাবতে পারিনি,’- বললেন নটরাজন।
ছোটবেলায় মা-বাবা পড়াশুনোর চাপ দিলেও সালেমের পাড়ায় লুকিয়ে লুকিয়ে টেনিস বলের টুর্নামেন্ট খেলতে চলে যেতেন নটরাজন। সেই প্রসঙ্গ উঠতেই হাসতে শুরু করেন, ‘ছ বছর বয়স থেকেই টেনিস বল দিয়ে খেলতাম। পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে টেনিস বলের টুর্নামেন্টে খেলতে যেতাম,’ বলছেন প্রীতি জিনতাদের কিংস ইলেভেনের নতুন বোলার।
তামিলনাড়ুর সালেমে জন্মগ্রহণ করলেও তার প্রতিবেশী জয়প্রকাশের আবদারে চেন্নাইয়ে যান ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। সেখানে স্থানীয় এক ক্লাবের হয়ে খেলার পর টিএনপিএল (তামিলনাড়ু প্রিমিয়ার লিগের) স্কাউটদের নজরে আসেন তিনি, ‘টিএনপিএল আমার জন্য খুব বড় একটা মঞ্চ ছিল। সেখানে অনেক কিছু শিখেছি। নিজের ডেলিভারি আরও কী করে ভয়ঙ্কর করা যায়। ইয়র্কার আরও ভাল কী করে করা যায় সব কিছুই টিএনপিএলে শিখেছি। আইপিএলের ডেথ ওভারে আরও বেশি করে ইয়র্কার দিতে চাই,’ বলছেন নটরাজন।
তবে নটরাজনও বহু অন্ধকার দিন দেখেছেন। সালেমের স্থানীয় কিছু ক্লাবের হয়ে খেলার পর ২০১৪-১৫ মওসুমে রঞ্জিতে ডাক পান। বাংলার বিরুদ্ধে অভিষেক হয় তার। কিন্তু এরপরই বাদ পড়েন দল থেকে,‘খুব খারাপ সময় গিয়েছিল। প্রত্যেক দিন কাঁদতাম। ভাবতাম খেলতে পারব তো। টিএনপিএলে ভাল খেলার পর এবার রঞ্জি খেললাম। নিশ্চয়ই ভাল খেলেছি বলেই আইপিএলে সুযোগ পেলাম।’ সন্দেহজনক বোলিং অ্যাকশনের অভিযোগও উঠেছিল তার বিরুদ্ধে; কিন্তু প্রচুর পরিশ্রম করে সেই অ্যাকশন শুধরে নেন নটরাজন।
মিচেল জনসনের ভক্তের ফিনিক্সের মতো উত্থানের পিছনে নাম উঠে আসছে তার প্রতিবেশী জয়প্রকাশের। ‘জয়প্রকাশ স্যার আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। সব সময় উৎসাহ দিয়েছেন। এবার আইপিএলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদের সঙ্গে ড্রেসিংরুম ভাগ করে আরও শিখতে পারব,’ বলছেন নটরাজন। তার সেরা অস্ত্র কাটার। যে কারণে বাংলাদেশের মুস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে ইতিমধ্যেই তুলনা শুরু হয়ে গিয়েছে।
আইপিএল উড়ানে চড়ে কতদূর উড়তে পারবেন নটরাজন? এপ্রিল-মে মাসেই এর উত্তর পাওয়া যাবে।
আইএইচএস/পিআর