অনেক কিছু প্রমাণ করে দিয়েছেন হায়দরাবাদের দর্শকরা
ভিভিএস লক্ষ্মণ প্যাভিলিয়নের ডান পাশে মনসুর আলি খান পাতৌদি স্ট্যান্ড। তার পাশেই আব্বাস আলি বেগ স্ট্যান্ড। মনসুর আলি খান পাতৌদি স্ট্যান্ডের এক কোনে পত পত করে উড়ছে বাংলাদেশের বিশাল এক পতাকা। বাংলাদেশ ক্রিকেট সাপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসসিএ) ১০ জন সদস্য এসেছেন বাংলাদেশ-ভারত টেস্টে মুশফিকদের সমর্থন জানাতে। সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকদের দুই আইকন টাইগার শোয়েব এবং টাইগার মিলন। এ দু’জনের হাতেও পত পত করে উড়ছে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা।
বাংলাদেশে আজ বসন্ত। চারুকলায় চলছে বসন্ত বরণ উৎসব। সবার মনকেই যেন রাঙিয়ে গেছে ফাল্গুনি হাওয়া। হায়দরাবাদের বাতাসে বসন্তের আবহ আছে; কিন্তু এখানকার মানুষের মনে আছে কি না জানা নেই। রাস্তার মোড়ে মোড়ে কিছু অস্থায়ী ফুল বিক্রেতাকে দেখা গেলেও ঢাকার মত হলুদ শাড়ি, হলুদ পাঞ্জাবি পরা মানুষ এখানে একজনকেও দেখা যায়নি। হয়তো, দিনের কাজ শেষে ফুল কিনে নিয়ে গিয়ে প্রিয়জনকে উপহার দিতে অভ্যস্ত হায়দরাবাদের মানুষ। এর মাঝেও ক্রিকেটের রঙ কিন্তু হারিয়ে যায়নি হায়দরাবাদের মানুষের মন থেকে। শত ব্যস্ততার ফাঁকেও একদল সমর্থক ঠিকই উপস্থিত হয়ে গেছেন রাজীব গান্ধী ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। হয়তো বা বিরাট কোহলিদের জয় দেখার জন্যই।
স্টেডিয়ামে প্রবেশ পথের দৃশ্যটা প্রায় মিরপুরের মত। পতাকা, ফেস্টুন, মাথার ব্যান্ড, জার্সি- এসব বিক্রেতাদের যেন অস্থায়ী হাট বসেছে স্টেডিয়ামের প্রবেশ পথে। বিরাট কোহলির জার্সি বিক্রি হচ্ছে দেদারছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিক্রি হচ্ছে ধোনির জার্সি। রঙ নিয়ে ঘুরছে অনেকে। ভারতের পতাকা কিংবা বিরাট কোহলির নাম এঁকে দিচ্ছে সমর্থকদের গালে-মুখে।
হায়দাবাদ টেস্টের চতুর্থ দিন ছিল রোববার। ভারতে সাপ্তাহিক ছুটির দিন। হায়দরাবাদেও। এদিনই সবচেয়ে বেশি দর্শক উপস্থিত হয়েছিল রাজীব গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। প্রায় ৫৫ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতা সম্পন্ন স্টেডিয়াম এটি। কলকাতার ইডেন গার্ডেনের পরই দর্শক ধারণক্ষমতার দিক থেকে এই স্টেডিয়ামটি ভারতের সবচেয়ে বড়। রোববার উপস্থিত হয়েছিল প্রায় ২৪ হাজার দর্শক। হায়দরাবাদ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকেই জানানো হয়েছিল এ তথ্য। পুরো মাঠে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কারণে, মনে হচ্ছিল বুঝি পুরো গ্যালারিই ভরে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, একটা টেস্ট ম্যাচ দেখার জন্য বড় জোর ৫ থেকে ১০ হাজার দর্শক যেখানে আশা করা হয়, সেখানে ২৪ হাজার তো প্রত্যাশার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
মর্যাদা পাওয়ার পর গত ১৬ বছরে বাংলাদেশকে টেস্ট খেলার আমন্ত্রণ জানানোর সৌজন্যতা দেখায়নি ভারত। বারবার একটা বিষয়কেই কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছিল তারা। বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানালে নাকি ওটা হবে লস প্রজেক্ট। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান সিরিজ হবে না। গ্যালারিকে দর্শক আসবে না। ম্যাড়মেড়ে একটা সিরিজ হবে।
ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের এই গোঁয়ার্তুমির জবাব হায়দরাবাদ টেস্ট। এই একটি টেস্ট খেলার জন্যও কত বাহানা করেছে ভারত। ২০১৪ সালে যে টেস্ট অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা, সেটা কয়েক দফা পিছিয়ে অবশেষে ২০১৭ সালে এসে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তাও মাত্র এক টেস্টের সিরিজ। দেখতে দেখতেই সিরিজটি শেষ হয়ে গেলো। তার চেয়েও বড় কথা, বাংলাদেশ দেখিয়ে দিয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড কর্মকর্তাদের অতীত ধারণা সবই ছিল ভুল।
হায়দরাবাদ টেস্টের প্রথম দিন থেকেই দর্শকের ঢল নেমেছে উপ্পালের রাজীব গান্ধী ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। পুরনো প্রাচীন এই শহরটির সবগুলো রাস্তা যেন এসে মিশে গেছে উপ্পালে। মূল রাস্তা থেকে যে শাখা রাস্তা ধরে স্টেডিয়ামে প্রবেশ করতে হয়, সে রাস্তায় দাঁড়ানোর যায়গা নেই প্রথম দিন থেকে। দলে দলে দর্শকরা এসেছে টেস্ট ম্যাচ দেখতে। আবার হায়দরবাদের বেশ কিছু স্কুল বাস ভর্তি করে টেস্টের প্রতিটি দিনই গ্যালারিতে এসেছে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। এক এক কোনে তারা বসেছে এক সঙ্গে। তৈরি করেছে নানান রঙের আবহ। যেন রঙের বিস্ফোরণ।
হায়দরাবাদ টেস্টের প্রথম দিন দর্শক একটু কমই ছিল তুলনামূলকভাবে। ভারত টস জিতে ব্যাট করতে নামার পরই মূলত দর্শক আসা শুরু হয়। বিরাট কোহলির সেঞ্চুরির পর দর্শক সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১০ হাজার। দ্বিতীয় দিন দর্শকের ঢল নামে মূলতঃ কোহলির সেঞ্চুরির পর ক্রিজে টিকে থাকার কারণে। কোহলির ব্যাট থেকে মাঠে আসা প্রায ১৫ হাজার দর্শক মন ভরে দেখলো ডাবল সেঞ্চুরি।
তৃতীয় দিন দর্শক উপস্থিত হলো প্রায় ২১ হাজার। সাপ্তাহিক ছুটির আগেরদিন হওয়াতে দর্শক একটু বেশিই হয়েছিল। তার চেয়েও বড় কথা ম্যাচটিতে ধীরে ধীরে প্রতিদ্বন্দ্বীতা তৈরি হয়েছিল বেশ। এ কারণে দর্শকরাও উপভোগ্য ম্যাচটি দেখার জন্য উপস্থিত হলো মাঠে। ছুটির দিনে তো উপস্থিত হয়েছিল সবচেয়ে বেশি দর্শক। টেস্টের শেষ দিন আজ, ভারতে সপ্তাহের প্রথম দিন। কর্মব্যাস্ত দিন হওয়ার কারণে দর্শক উপস্থিতি তুলনামূলক কম। তাও প্রায় হাজার দশেক দর্শক উপস্থিত হয়েছে মাঠে। সকাল থেকেই তারা চিৎকার-চেঁচামেছিতে গ্যালারি ভরিয়ে তুলেছে তারা।
গ্যালারিতে উত্তেজনার তৈরির রশদে যেন একটুও কমতি নেই। কোহলির একটু নড়া-চড়াতেই গগনবিধারি চিৎকারে পুরো স্টেডিয়াম কাঁপিয়ে তুলছিল তারা। কোহলিও কম যান না, হাতের ইশারা পুরো গ্যালারিকে উত্তেজিত করে তোলেন। চেষ্টা করেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মনসংযোগে ছিড় ধরাতে।
মাঠের খেলায় দু’দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়নি ঠিক, তবে ভারতীয় কয়েকজন ক্রিকেটারকে মাঝে-মধ্যে বাজে অঙ্গভঙ্গি করতে দেখা গেছে। প্রথম ইনিংসে রবীন্দ্র জাদেজা হাফ সেঞ্চুরি করে যেভাবে ব্যাট ঘুরিয়ে উপহাস করেছেন, সেটা ছিল অনেকটা দৃষ্টিকটু। বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস শেষ হওয়ার পর কোহলির কিছু অঙ্গভঙ্গিও ছিল খুব বাজে। এসব খেলারই অংশ হয়তো। সবচেয়ে বড় কথা, হায়দরাবাদের দর্শকরা প্রমাণ করে দিয়েছে, বাংলাদেশ-ভারত টেস্টও উত্তেজনার বারুদ ছড়াতে পারে। টেস্টে প্রতিদ্বন্দ্বীতা তৈরি করতে পারে।
আইএইচএস/এমআর/আরআইপি