ব্যস্ত সফর শেষে বাড়ি ফেরার আগে টাইগারদের অন্যরকম এক দিন
ঘড়ির কাটা তখনও সকাল ১১টা স্পর্শ করেছে মাত্র। ক্রাইস্টচার্চ ব্যস্ত। টিম বাংলাদেশ ক্রাইস্টাচার্চের যে হোটেলে আছে, গ্লস্টার রোডের সেই ‘রদেভু’র নারী রিসিপশনিস্ট যারপরনাই ব্যস্ত। চেক ইন ও চেক আউট টাইম। এরকম সময় রদেভু হোটেলের লিফট থেকে বেরিয়ে আসলেন সাকিব আল হাসান। পরনে ঘরোয়া পোশাক; কমলা রঙের গোল গলার টি-শার্ট আর ট্রাউজার্স।
লবিতে স্বদেশি সাংবাদিকদের দেখে সৌজন্য বিনিময়ের পর একটু হালকা পায়চারি করতে বেরিয়ে গেলেন হোটেলের বাইরে। তারপর যতই সময় গড়াতে থাকল ধীরে ধীরে তামিম, সাকিব ও মাহমুদউল্লাহদের হোটেল রূপ নিল বাংলাদেশ থেকে আসা সাংবাদিকদের মিলন ক্ষেত্রে।
হঠাৎ সাংবাদিকরা সবাই টিম হোটেলে? কোন অনুষ্ঠান কিংবা আনুষ্ঠানিকতা? না, না। ওসব কিছু না। কোচ চণ্ডিকা হাথুরুসিংহে কথা বলবেন মিডিয়ার সাথে। তাই সাংবাদিকদের সবাই সকাল সকাল ছুটে এসেছেন টিম হোটেলে। আগামীকাল ক্রাইস্টচার্চ থেকে কোচ চলে যাবেন তার বর্তমান নিবাস অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। সেখানে প্রায় সপ্তাহ খানেক ছুটি শেষে ৩১ জানুয়ারি নাগাদ বাংলাদেশে ফিরবেন।
তার আগে আর হেড কোচ চণ্ডিকা হাথুরুসিংহেকে পাওয়া যাবে না। তাই আজ সকালে সব সাংবাদিকের গন্তব্য রদেভু হোটেল। এবারের নিউজিল্যান্ড সফর বিশেষ করে টেস্ট সিরিজের পারফরম্যান্স ও ফল নিয়ে তার অনুভূতি, চিন্তা-ভাবনা ও অনুভব জানতেই আসলে টিম হোটেলে আসা।
নিয়মিত অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম নেই। আঙ্গুলের ইনজুরি নিয়ে শেষ টেস্ট খেলতে না পেরে দেশে ফিরে গেছেন। ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক তামিম ইকবালও গতকাল দ্বিতীয় টেস্ট শেষে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলে ফেলেছেন। ১৭ /১৮ মিনিটের কথোপকেথনে অনেক কথাই বলেছেন ক্রাইস্টচার্চ টেস্টের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক ।
শেষ টেস্টে অনুজ্জ্বল পারফরম্যান্স ও না পারার জন্য অনুতপ্ত তামিম ব্যর্থতার সব দায় দায়িত্ব নিজের কাঁধেও তুলে নিয়েছেন। বাকি ছিল কোচ হাথুরু। আগের দিন রাতেই মিডিয়া ম্যানেজার রাবিদ ইমাম জানিয়ে দিয়েছিলেন, যেহেতু কোচ সিডনি চলে যাবেন, টিমও দেশের উদ্দেশে যাত্রা করবে বুধবার কাক ডাকা ভোরে। তাই মঙ্গলবার সকাল ১১ টায় হোটেল লবিতে বাংলাদেশের প্রচার মাধ্যমের সাথে কথা বলবেন কোচ হাথুরুসিংহে।
সাবাদিকরা সবাই সকাল ১১ টার মধ্যে হোটেল লবিতে চলে আসলেও দেখা নেই কোচ হাথুরুর। এদিকে ম্যানেজার রাবিদ ইমাম জানালেন- তিনি মিটিংয়ে বসছেন। আসতে অন্তত আধ ঘণ্টা দেরি হবে। প্রথমে ভাবা হচ্ছিল কোচ বুঝি ক্রিকেটারতের সাথে মিটিং করছেন। পরে সাকিবই জানালেন, কই না তো; আমাদের সাথে কোনো মিটিং হয়নি। কোন মিটিং হওয়ার কথাও না।
পরে জানা যায় কোচিং স্টাফদের নিয়ে বসেছিলেন হাথুরু। ধারণা করা যাচ্ছে, ভারত সফরের আগে শেরেবাংলায় যে দু’তিন দিনের ছোট্ট অনুশীলন ক্যাম্প হবে, সেই ট্রেনিং সিডিউল করলেন কোচ। এদিকে মিটিং শেষে তার আসতে আসতে প্রায় ঘণ্টা খানেক লাগল।
ততক্ষণে ঘড়ির কাটা দুপুর সাড়ে বারোটা অতিক্রম করেছে। একে একে রদেভুর লবি সরব হয়ে উঠল ক্রিকেটারদের কলতানে। ধীরে ধীরে রুম থেকে বেরিয়ে আসলেন, সদ্য অভিষেক হওয়া নাজমুল হোসেন শান্ত। টেস্ট সিরিজে সুযোগ না পাওয়া বাঁহাতি স্পিনার তাইজুল ইসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে একে একে চলে আসলেন তামিম ইকবাল, মাহমুদউল্লাহ, মোস্তাফিজ, মেহেদী হাসান মিরাজ, তাসকিন আহমেদ ও কামরুল ইসলাম রাব্বি।
দীর্ঘ সফর শেষ। এবার বাড়ি যাবার পালা। রাত পোহালেই ফ্লাইটে অকল্যান্ড। সেখান থেকে সিঙ্গাপুর হয়ে রাজধানী ঢাকা। ফ্লাইট বিলম্ব না হলে আগমাী কাল ২৫ জানুয়ারি বুধবার বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা ৪০ মিনিটে টিম বাংলাদেশের হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছানোর কথা।
ক্রিকেটারদের কেউ এক বেলা ফুরসত পাননি। হয় খেলা, না হয় প্র্যাকটিস। কিংবা টিম মিটিং। এগুলোর ফাঁকে ফাঁকে শুধু লাঞ্চ আর ডিনারে নিজেরা দল বেঁধে পছন্দ মাফিক রেস্টুরেন্টে যাওয়া। এর মধ্যে তামিম ইকবাল প্রতিদিনই একটি গ্রুপকে নিয়ে বের হতেন। মোস্তাফিজ, তাইজুল, মিরাজ, শান্ত দেশে ফেরার আগে মমিনুল হক এ গ্রুপের নিয়মিত সদস্য।
আজও তামিম সেজেগুজে কালো জ্যাকেট জিন্সের প্যান্ট ও স্যু পরে লবিতে এসেছেন লাঞ্চে যাওয়ার উদ্দেশে।
মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, নাজমুল শান্ত, মেহেদী হাসান মিরাজ ও মোস্তাফিজের সাথে সেই লাঞ্চে যাওয়ার ইচ্ছে তাইজুল ইসলামেরও। কিন্তু ঘরোয়া পোশাকে নীচে নেমে আসা তাইজুলকে স্যান্ডেল পরা দেখে তামিম বললেন, যা স্যু পরে আয়। আমরা যে অভিজাত হোটেলে খেতে যাব, সেখানে আবার স্যু ছাড়া ঢোকা নিষেধ।
ওদিকে এক দল যখন দুপুরের খাবার থেকে নতুন রেস্টুরেন্টের খোঁজে, সাকিব আল হাসান তখন লবিতে একা বসে মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্রাউজিংয়ে ব্যস্ত। লাঞ্চ শেষে যে যার মতো হালকা শপিংয়ে বেরিয়ে পড়া। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, সৌম্য সরকার, কামরুল ইসলাম রাব্বি আর তাসকিন আহমেদকে দেখা গেল ওয়েস্ট ফিল্ড শপিং মলে।
মোদ্দাকথা, দীর্ঘ সফর শেষে এবার ঘরে ফেরার পালা। ক্রিকেটাররাও অনেকদিন পর একদিন সত্যিকার ছুটির আমেজে। সমালোচকরা নিশ্চয়ই এতটুকু পড়ে ভাবছেন; ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টির পর দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে চরমভাবে পর্যুদস্ত হওয়ার পরও বুঝি নির্বিকার ক্রিকেটাররা। কারো কো প্রতিক্রিয়া নেই। হতাশা ও ব্যর্থতার গ্লানি গায়ে স্পর্শ করেননি। তাই বুঝি অভিজাত রেস্তোরায় লাঞ্চ-ডিনার ও শপিংয়েই ব্যস্ত ক্রিকেটাররা।
আসলে মোটেই তা নয়। সবার মাঝেই কম-বেশি হতাশা ও অতৃপ্তি কাজ করছে। কারো মুখেই সে অর্থে হাসির ফলগুধারা নেই। তামিম, সাকিব, মাহমুদউল্লাহ থেকে শুরু করে নুরুল হাসান সোহান, নাজমুল হোসেন শান্ত ও কামরুল ইসলাম রাব্বি- সবার সাথে না লেখার শর্তে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বেরিয়ে আসল একটা সত্য- সবাই না পারার বেদনায় দগ্ধ।
সবার কথার সারমর্ম এক- আসলে ফল দেখে পুরো সফর ও সিরিজগুলোকে মূল্যায়ন করা ঠিক হবে না। চেষ্টা ছিল ভালো করার। কখনো কখনো সে চেষ্টা সফলও হয়েছে। কিন্তু সে চেষ্টার ফসল ঘরে তোলার সম্ভব হয়নি। এ অতৃপ্তি নিয়েই ঘরে ফেরা।
দেশে গিয়েও বিশ্রাম নেই। ২৬-৩০ পাঁচদিন ক্লান্তি-অবসাদ কাটিয়ে আবার ৩১ জানুয়ারি ভারত সফরের জন্য প্র্যাকটিস।
এভাবেই ক্রিকেটারদের অবিরাম চলা ফেরা। এ পথ চলা শুরু হলো সবে। এরপর ফেব্রুয়ারিতে ভারতের হায়দরাবাদে এক ম্যাচের টেস্ট নিরিজ। মার্চ-এপ্রিলে শ্রীলঙ্কা সফর। তার পর মে জুনে আয়ারল্যান্ড ও ইংল্যান্ড সফর।
এআরবি/এনইউ/এমএস